৪ বছরে ২০ বছরের দ্বিগুণ প্রকল্প পেয়েছেন নাছির

151

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের গত ২০ বছরের মধ্যে চার বছর দায়িত্ব পালনকালে সবচেয়ে বেশি প্রকল্পের অনুমোদন পেয়েছেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। গত বিশ বছরের তুলনায় এই চার বছরের অনুমোদন হয়েছে দ্বিগুণের বেশি প্রকল্প। যার ৬০ শতাংশই বাস্তবায়নের শেষ পথে। এর সুফল হিসেবে আগামী ৬ মাসের মধ্যে দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখা যাবে নগরীতে। এমনটায় দাবি করেছেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। সাবেক মেয়র প্রয়াত এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর দায়িত্ব পালনের ১৫ বছর ও মোহাম্মদ মনজুর আলমের ৫ বছরসহ মোট ২০ বছরে সিটি কর্পোরেশন প্রকল্প পেয়েছিল ২ হাজার ২৪৩ কোটি টাকার। আর মেয়র আ জ ম নাছিরের ৪ বছরে প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে ৫ হাজার ৩০৬ কোটি টাকার। এছাড়াও অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে আরও ৩ হাজার ১৬৪ কোটি টাকার প্রকল্প।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে আ জ ম নাছির উদ্দীনের দায়িত্ব গ্রহণের ৪ বছর পূর্তির শেষ দিন আজ। বর্ষপূর্তি উপলক্ষে নগরীর রীমা কনভেনশন সেন্টারে আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় জামালখান ওয়ার্ডের জনতার মুখোমুখি হবেন মেয়র নাছির।
নিজের চার বছরের কাজের মূল্যায়ন করতে গিয়ে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন পূর্বদেশকে বলেন, ‘নগরবাসী সাথে থাকলে কোনো চ্যালেঞ্জই চ্যালেঞ্জ নয়, যে কোনো লক্ষ্যকে ছুঁয়ে যেতে পারবো। সিটি কর্পোরেশনের কাজে দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে।’
১৯৯৪ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত চসিকের মেয়র ছিলেন এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। তাঁর দায়িত্বকালীন সময়ে সিটি কর্পোরেশন প্রকল্প পায় ১৫ বছরের মধ্যে ১ হাজার ২৫৯ কোটি টাকার। পরবর্তীতে বিএনপি থেকে নির্বাচিত মেয়র মনজুর আলমের ৫ বছরে অনুমোদন হয় ৯৮৪ কোটি টাকার প্রকল্প। সেই তুলনায় মেয়র নাছিরের প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে অনেক বেশি। দেশের অর্থনীতির সক্ষমতা বৃদ্ধি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতাকে কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন তিনি। মেয়র আরও বলেন, আমাদের মন্ত্রণলায় ছাড়াও বিএমডিএফ, জাইকা ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্প অনুমোদনে সচেষ্ট ছিলাম।
সিটি কর্পোরেনের আইন অনুযায়ী মেয়রের মূল কাজ তিনটি। নালা-নর্দমা ও সড়ক সংস্কার, পরিচ্ছন্নতা, এবং শহর আলোকিত করা। এই তিনটি কাজে মেয়র নাছির কতটুকু সফল বা ব্যর্থ? তার সমষ্টিগত মূল্যায়ন করতে সময় রয়েছে আরও ১ বছর।
বিগত চার বছর দায়িত্ব পালন ও নির্বাচনী ইশতেহার নিয়ে পূর্বদেশের সাথে কথা বলেন মেয়র।
আলোকায়নে শতভাগ সফলতার পথে :
নগরীতে আলোকায়নযোগ্য সড়ক রয়েছে ১ হাজার ১৮৪ কিলোমিটার। তারমধ্যে মোট ১ হাজার ৪৩ কিলোমিটার সড়কে বাতি রয়েছে। অর্থাৎ অবশিষ্ট রয়েছে ১৪১ কিলোমিটার। এদিকে গত ৯ জুলাই এলএইডি বাতির স্থাপনে ২৬১ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। এই প্রকল্পের অধীনে ৪৬৭ কিলোমিটার সড়কে সোড়িয়াম বাতির বদলে বসানো হবে এলইডি বাতি। তবে ওই সরানো সোড়িয়াম বাতিগুলো নগরীর অবশিষ্ট সড়ক ও নতুন আবাসিকে সংযোজন করা হবে। ফলে নগরীর অবশিষ্ট সবকটি সড়কে বসবে বাতি। এর মাধ্যমে শতভাগ আলোকায়নের পথে যাচ্ছে সিটি কর্পোরেশন।
সিটি মেয়র নাছির বলেন, আগে সোডিয়াম বাতি দিয়ে শহরে আলোকায়নের ব্যবস্থা করা হত। আমার আমলে নগরীতে প্রথম এলইডি ‘কনসেপ্ট’ প্রয়োগ করি। যেটাতে বিদ্যুৎ খরচ অনেকাংশে কম, আলো বেশি ও ব্যবস্থাপনা খরচ তুলনামূলক অনেক কম। অনুমোদিত প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে প্রায় ৬০ শতাংশ সড়কে এলইডি বাতি বসবে। বাকি সড়কগুলো পর্যায়ক্রমে এলইডি বাতির আওতায় আনা হবে। আর যেখানে বাতি নেই বা নতুন সড়ক তৈরি হয়েছে, সেখানে সরানো বাতিগুলো বসানো হবে।
সমালোচনায় পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম :
বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গত চার বছরে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এসব উদ্যোগের একটি গৃহস্থালী বর্জ্য অপসারণে গৃহীত ‘ডোর টু ডোর ময়লা অপসারণ’ কার্যক্রম। একইসঙ্গে শহরের প্রধান সড়কগুলোর পাশে ময়লা ফেলার জন্য স্থাপিত ‘কন্টেইনার’ অপসারণ এবং ওয়ার্ড পর্যায়ে স্থাপিত ‘ডাস্টবিন’ অপসারণ। গৃহীত উদ্যোগগুলোর বেশিরভাগ বাস্তবায়িত হয়েছে দাবি করে চসিকের মেয়র বলেছেন, পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমে অনেক দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে। পুরোটা বদলে দিতে আমাদের সময় লাগবে। আমরা সে পথেই হাঁটছি।
তবে নগরবাসীদের কেউ কেউ চসিকের পরিচ্ছন্ন কার্যক্রমে ইদানিং কিছুটা ধীরগতি এসেছে বলে মন্তব্য করেছেন। তাদের দাবি, মাঝখানে চসিকের পরিচ্ছন্ন কার্যক্রমে যে গতি এসেছিল তা এখন কমে গেছে। অর্থাৎ পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম নিয়ে কর্পোরেশনের উদ্যোগী মনোভাবে গতি কমে যাওয়ায় এ সমালোচনা।
মেয়র আরও বলেন, আমি দায়িত্ব নেওয়ার আগে মূল সড়কে ডাস্টবিন ছিল ১ হাজার ৩৫০টি। যার কারণে শহরজুড়ে যত্রতত্র ময়লা ও উৎকট গন্ধ বিরাজ করত। এখন প্রায় ৭শ ডাস্টবিন মূল সড়ক থেকে সরানো হয়েছে। বাকিগুলো পর্যাক্রমে সরানো হচ্ছে। তাছাড়া আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ডাস্টবিনের জায়গায় বাগান করেছি ৩০টিরও অধিক। আগে দিনে ময়লা সরানো হত, এখন রাতে সরানো হয়। যাতে নগরবাসীর কষ্ট না হয়। এছাড়াও বাড়ি বাড়ি গিয়ে ময়লা সংগ্রহ করতে প্রায় বিনামূল্যে বিন দিয়েছি।
আবাসিকে ময়লা সংগ্রহের জন্য টাকা নেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেন, ব্যাপারটা আমরা অবগত। তবে বাস্তবতা হলো ভিন্ন। বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় আমাদের পরিচ্ছন্ন কর্মীদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। তারা নিজেদের ব্যবস্থপনায় ময়লা সংগ্রহ করে কর্পোরেশনের নির্ধারিত ডাস্টবিনে রাখেন। সেক্ষেত্রে আমরা তো আবাসিক এলাকার পরিচালকদের জোর করতে পারি না? তবে পরিচ্ছন্নতার সফলতা যতটুকু আমাদের উপর নির্ভর করে, তার চেয়ে বেশি নির্ভর করে নগরবাসীর সচেতনতার উপর। কেননা তারা সচেতন না হলে আমাদের সবধরনের চেষ্টা বৃথা যাবে। তাদের নির্দিষ্ট সময়ে ময়লা ফেলায় অভ্যস্থ হতে হবে। এজন্য আমরা জনগণকে সবসময় সচেতন করে যাচ্ছি। আশা করছি এমন সময় আসবে যখন সচেতন নগরবাসীর সাথে শতভাগ পরিচ্ছন্ন নগরী হবে চট্টগ্রাম।
শতভাগ পাকা রাস্তার পথে :
নগরীতে ১ হাজার ৩০ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। এসব সড়কের পুরোটাই পাকা হওয়ার পথে বলে দাবি করেছেন কর্পোরেশনের প্রকৌশল বিভাগ। ইতোমধ্যে নগরীর সড়ক নেটওয়ার্কিং উন্নয়নে ১ হাজার ২০৩ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়েছে ২০১৭ সালের সার্ভের উপর। এরমধ্যে নতুন সড়ক তৈরি হয়েছে বিভিন্ন আবাসিকে। এছাড়াও এয়ারপোর্ট রোড় সম্প্রসারণ ও ড্রেন তৈরির জন্য ২ হাজার ৭ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে আর কোনো সড়ক কাঁচা থাকবে না।
এ বিষয়ে মেয়র বলেন, আমাদের শহরের রাস্তাগুলো পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা হয়নি। একটি রাস্তার বিভিন্ন অংশে হরেক মাপ। অনেক রাস্তার পাশে ড্রেন করা হয়নি। ফলে আমাদের ড্রেনেজ ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়। শতভাগ পাকার পাশাপাশি সড়কের প্রশস্ততা, পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে আরেকটি প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। সেটি শীঘ্রই অনুমোদনের কথা রয়েছে।
নির্বাচনী ইশতেহার কতটুকু বাস্তবায়ন হলো :
শুধু মেগাসিটি নয়, জলাবদ্ধতা নিরসনকে প্রধান সমস্যা এবং চট্টগ্রামকে ক্লিন ও গ্রিন সিটিতে পরিণত করার প্রতিশ্রæতি সম্বলিত ৩৬ দফার নির্বাচনী ইশতেহারও ছিল মেয়র নাছিরের। দায়িত্বপালনকালীন নিজের দেয়া প্রতিশ্রæতিগুলো প‚রণে ‘সর্বোচ্চ চেষ্টা’ করেছেন। এর ফলে সাফল্য এসেছে বলে মনে করেন তিনি। অবশ্য আইনগত বাধ্যবাধকতার কারণে শতভাগ সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়নি বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
৩৬ দফার মধ্যে স্বপ্নের গ্রিন মেগাসিটি নির্মাণ, জলাবদ্ধতা নিরসন, ডিজিটাল চট্টগ্রাম, শিশুবান্ধব শহর, ভিক্ষাবৃত্তি এবং দারিদ্র্য বিমোচন, পথচারীদের জন্য গণশৌচাগার ব্যবস্থা, ৯৫ সালে প্রাণীত ড্রেনেজ মাস্টার প্লানকে যুগোপযুগী করা, পরিচ্ছন্ন্ নগরী গড়া, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর আমলে নেয়া আয়বর্ধক প্রকল্পগুলো চলমান রাখা, নগরীকে সবুজ করা তথা পাহাড় রক্ষা ও বনায়ন করা ও শিক্ষার প্রসার ছিল অন্যতম।
এ প্রসঙ্গে মেয়র নাছির পূর্বদেশকে বলেন, আমাদের দেশে নির্বাচনের সময় ইশতেহার দিতে হয়। সেটা একটা নিয়মের মত। ইশতেহার নিয়ে কথা বলতে গেলে দুটো বিষয় সামনে আসে। তারমধ্যে একটি দায়িত্বগ্রহণের আগে এবং আরেকটি দায়িত্ব গ্রহণের পর। ইশতেহারের সবগুলো একজন মেয়র হিসেবে চাইলেও সম্ভব না। কেননা সিটি কর্পোরেশন একটি সীমাবন্ধ আইন দ্বারা চালিত হয়। এর বাইরে গেলে সেটা অবৈধ হিসেবে পরিগণিত হবে। জলাবদ্ধতার উদাহরণ টেনে মেয়র বলেন, আমার নির্বাচনের অন্যতম ইশতেহার ছিল জলাবদ্ধতা নিরসন। সেজন্য আমরা স্টাডি করে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিলাম এবং সেটা অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছিল। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ একটি প্রকল্প অনুমোদন পায়। সেক্ষেত্রে আমার আর কিছু করার থাকে না। তবে মেয়র হিসেবে জলাবদ্ধতা নিরসনের অন্যতম প্রয়োজন নালা পরিষ্কার রাখা। আমরা সেটা ক্রাশ পোগ্রাম করে পরিষ্কার রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। সেক্ষেত্রে আমাদের কোনো গাফিলতি নেই। তাছাড়া আমাদের যা ড্রেনেজ সিস্টেম রয়েছে, তা পর্যাপ্ত নয়। তাই নতুন প্রকল্পে নতুন ড্রেন করার পরিকল্পনা দিয়েছি। আবার একটি নগরীতে কমপক্ষে ১২ শতাংশ জলাধার থাকতে হয়। সেক্ষেত্রে আমাদের শহরে ১ ভাগও নেই। তাই আমাদের একটি প্রকল্প ছিল, বহদ্দারহাট বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী পর্যন্ত খাল খনন। এতদিন টাকা ছাড়ের কারণে ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় ছিল প্রকল্পটি। এখন পুরো টাকা দিয়ে দিয়েছে। ফলে আর কোনো বাধা রইল না। আমরা যতদ্রæত সম্ভব প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবো। জলাবদ্ধতা নিরসনে যতুটুক আমার করা সম্ভব তা করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
আয়বর্ধক প্রকল্প নিয়ে মেয়র বলেন, আগের ধারায় বাড়ানো হয়েছে আয়বর্ধক প্রকল্প। শাহ আমানত মার্কেট, শপিং কমপ্লেক্সে খালি জায়গায় মার্কেট নির্মাণসহ আরও অনেক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
ডিজিটাল চট্টগ্রামের বিষয়ে বলেন, আমরা নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে ওয়াইফাই জোন স্থাপন করেছিলাম। অভিভাবকদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সেই সেবাকে অনেকটা গুটিয়ে নিয়েছি। তবে স্মার্টসিটি করতে ২৬০ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এছাড়াও নগরীতে আইটি ভিলেজ, হাইটেক পার্ক স্থাপন হচ্ছে সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে। ডিজিটাল সেবা নিশ্চিতে ডিজিটাল ম্যাপ তৈরির কাজ চলছে। অন্যদিকের রাজস্ব আদায়ে অটোমেশন ও কর্পোরেশনের অভ্যন্তরীণ কাজ ডিজিটাল করা হয়েছে। কয়েকমাসেই আমারা ই-ফাইলিং জগতে প্রবেশ করবো। তখন পুরো সেবাটাই ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিতে পারবে নগরবাসী।