৩ টাকায় হোমিওপ্যাথি, ৫ টাকায় এলোপ্যাথি আর ২০ টাকায় ঝাড়ফুঁক

11

লায়ন মো. আবু ছালেহ্

বেশি দিন আগের কথা নয়, ৮০ ও ৯০ এর দশকে আমার জন্মস্থান পটিয়ার চিকিৎসা ব্যবস্থায় নিম্ন বিত্ত ও মধ্যবিত্তদের জন্য যে দুজন মানুষ অনন্য অবদান রেখেছেন তাঁদের একজন হলেন পটিয়ার ডাক বাংলোতে হোমিওপ্যাথি ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম আর একজন হলেন পাঁচুরিয়ার ডা. চিত্ত রঞ্জন দত্ত। সে সময়ে গরীবের ডাক্তার হিসেবে পরিচিত ছিল দু’জনেই। তবে ডা. জহুরুল হক, ঘোড়া ডাক্তার, ডা. সামশুল আলম, ডা. সা ই ম ফজির, ডা. আবুল হাশেম, ডা. তারাপদ, ডা. মোঃ আলী, ডা. নাছির উদ্দিন, ডা. নির্মল কান্তি শীল (সুনীল ডা.) এই চিকিৎসকরা সে সময় পটিয়ার আপামর জনসাধারণের চিকিৎসা সেবার অবদান রেখেছেন। সবার প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা রেখেই আমার লেখাটির উত্তরণ ঘটাচ্ছি। ৩ টাকায় হোমিও চিকিৎসা ও ঔষধ দিতেন ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম। ওনার চেম্বারে নারী পুরুষ রোগীর লম্বা লাইন থাকত সব সময়। মহিলাদের জন্য পেছনে আলাদা রুম ছিল বসার। পুরুষরা সামনে বসত। যেকোন রোগের চিকিৎসা ৩ টাকায় হত। আমি নিজেও একবার আমার হাতের আঁচিল এর জন্য চিকিৎসা করেছি ৩ টাকায়। এবং আমার আঁচিল সম্পূর্ণ চলে গিয়েছিল। এখনও চেম্বার আছে ওনার ছেলে চিকিৎসা দেন।
আর অন্যদিকে শহরের টাকার জীবনকে বেছে না নিয়ে গ্রামের গরীব দুঃস্থ দের জন্য অনন্য মানবিক ডাক্তার ছিলেন চিত্ত বাবু, ফিস ৫ টাকা। টাকা না থাকলেও কেউ চিকিৎসা থেকে বাদ যায়নি। এমনও দেখা গেছে প্রাথমিক ভাবে ওনাকে রোগী দেখানোর পর শহরে বড় ডাক্তার দেখিয়ে একই ঔষধ প্রেসক্রিপশনে লিখেছেন। রোগ নির্ণয়ের জন্য নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলি সম্পূর্ণ ভাবে প্রয়োগ করেছেন। সহজে কোন পরীক্ষা নিরীক্ষা করাতেননা। আমার সেজ খালাম্মা ছিলেন ওনার একনিষ্ঠ ভক্ত।
সে সময়ে গ্রন্থ বিদ্যা বা চিকিৎসকের চেয়ে বড় বিদ্যা ছিল তান্ত্রিক বিদ্যা ও যাদু বিদ্যা। এই বিদ্যার বিশ্বাসী ছিল মহিলারা তাদের বিশ্বাসের কারণে এসব ভন্ডরা বোকা বানানোর কাজ গুলো করত। একদিন এক আত্মীয় আমাকে নিয়ে এক তান্ত্রিকের বাড়িতে গেল। মেয়ের বিয়ের জন্য। তান্ত্রিক মেয়েটিকে নিমপাতা দিয়ে ঝেড়ে দিল। ফি নিল ২০ টাকা। আমি ওনাকে বললাম আচ্ছা আমার জ্বর হলে কি করতে হবে? আপনার কাছে ঝাড়ফুঁক করব নাকি প্যারাসিট্যামল খাব? তিনি বললেন প্যারাসিট্যামল খাবেন। তখন আমি বললাম কেন আপনার ঝাড়ফুঁকে যদি সামান্য জ্বর সাড়াতে না পারে তাহলে কিসের বৈদ্য আপনি? সেদিন আমাকে তিনি চরম শত্রু হিসেবে দেখলেন।
হঠাৎ মেজ মামীর ফুসফুস ক্যান্সার ধরা পড়ল। শহরে দুইজন চিকিৎসক তাঁর চিকিৎসা দিচ্ছেন। এর মধ্যে একজন মহিলা আত্মীয় ওনাকে পরামর্শ দিয়েছেন ঝাড়ফুঁক বৈদ্য’র কাছ থেকে চিকিৎসা নিতে। অলৌকিক ভাবে যেদিন সে তান্ত্রিক ওনাদের ঘরে আসে আমিও গিয়ে পড়ি। এসব দেখেই মাথা তেলে বেগুনে চটে গেল আমার। তাকে বললাম আপনার ২০ টাকায় যদি ক্যানসার ভাল হতো তাহলে বড় বড় ডাক্তারেরাতো বসে থাকতে হতো। তখন তিনি আমাকে উত্তর দিলেন ২০ টাকায় কি ক্যান্সার ভাল হয়? আমি জিজ্ঞেস করলাম কত টাকায় হয়? তান্ত্রিক উত্তর দিল ১২০ টাকায়। আমিতো হাসতে হাসতে শেষ। উল্লেখ্য সে সময় ১০০ টাকায় ১ কেজি গরুর মাংস ও পরিপূর্ণ সবজির বাজার সম্পন্ন করা যেত। মেজ মামী এর কিছুদিন পর ইন্তেকাল করেন। উপরের এই তিনজনের মধ্যে কেউ এখন বেঁচে নেই। কিন্তু প্রজন্ম পেরিয়েও তাঁদেরকে স্মরণ করছি কর্মে।
এখনও আধুনিক যুগে চিকিৎসা বিজ্ঞানের চেয়েও তান্ত্রিক বৈদ্যদের ফি বেশি। সূত্রের অনুসার তারা একটি তাবিজের জন্য নেয় ১০-২০ হাজার! অথচ কত আধুনিক প্রযুক্তিতে চিকিৎসা দেওয়া হয় এখন। এসবের ১০ ভাগও তখন ছিলনা। তবুও আমাদের গোঁড়ামি কুসংস্কার দূর হলনা।