৩৪ কোম্পানির শিল্প গ্রুপ পিএইচপি পরিবার

110

পূর্বদেশ ডেস্ক

সুফি মিজানুর রহমানের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কাঞ্চন গ্রামে। বাবা সুফি মোহাম্মদ দায়েম উদ্দিনের কাপড়ের ব্যবসা ছিল। চট্টগ্রামে ব্যবসা শুরুর আগে ১৯৬৪ সালে মাসিক ১০০ টাকায় নারায়ণগঞ্জের জালাল জুট ভ্যালি কোম্পানিতে করণিকের চাকরি করতেন সুফি মিজানুর রহমান। নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজে স্নাতকে পড়তেন তখন। জালাল জুট ভ্যালিতে চাকরি করা অবস্থায় এক বন্ধু খবর দিলেন, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানে (বর্তমানে সোনালী ব্যাংক) ‘জুনিয়র ক্লার্ক’ পদে লোক নেবে। পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণও হন। নিয়োগপত্র হাতে নিয়ে ব্যবসায়ী বাবার হাতে তুলে দিলেন। কিন্তু বাবা খুশি হলেন না। বললেন, মাস্টার্স শেষ করলে আরও অনেক চাকরি পাওয়া যাবে। বাবাকে রাজি করাতে না পেরে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দ্বারস্থ হলেন তিনি। প্রধান শিক্ষক খুশি হলেন। ওই শিক্ষকই চাকরি করে পড়াশোনা করা যাবে বলে সুফি মিজানের বাবাকে বোঝালেন। শিক্ষকের কথায় রাজি হন বাবা।
ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানে ‘জুনিয়র ক্লার্ক’ পদে ১৬৩ টাকা মাসিক বেতন-ভাতায় নিয়োগপত্র নিয়ে সুফি মিজানুর রহমান নারায়ণগঞ্জ থেকে রওনা দেন চট্টগ্রামে। ১৯৬৫ সালের ১৯ মার্চ যোগ দেন ব্যাংকটির চট্টগ্রাম লালদীঘি শাখায়। অন্যদের চেয়ে কাজ বেশি করতে শুরু করলেন। চাকরিরত অবস্থায় ব্যাংকিং ডিপ্লোমাও করলেন ইনস্টিটিউট অব ব্যাংকার্স ইন পাকিস্তান থেকে। ১৯৬৫ সালে বিকমের ফলাফল ঘোষণা হয়। ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন কলেজে ৪৬ জন বা ১৩ শতাংশ পাস করল। প্রথম শ্রেণিতে একজনও নেই। সবাই দ্বিতীয় শ্রেণি। এই তালিকায় ছিলেন সুফি মিজানুর রহমান। পাস করার পরই ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংকে (বর্তমানে পূবালী ব্যাংক) জুনিয়র অফিসার পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে দরখাস্ত করলেন।
চাকরি করা অবস্থায় ১৯৬৭ সালের ৪ জুলাই বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন। নারায়ণগঞ্জে বিয়ে হলো। বিয়ের এক মাস পর ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের (বর্তমান পূবালী ব্যাংক) নিয়োগপত্র হাতে পান। কিন্তু বিপত্তি বাধল ব্যাংকের নিয়ম। তখন এক ব্যাংকের লোক আরেক ব্যাংকে যোগদান করতে পারত না। তবে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের কর্মকর্তারা তাঁকে যোগদানের সুযোগ দিলেন। ১৯৬৭ সালের সেপ্টেম্বর বা অক্টোবর মাসে বর্তমান পূবালী ব্যাংকের চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগে যোগ দেন তিনি। বেতন মাসে ৮০০ টাকা।
দেশ স্বাধীনের পর লোভনীয় সেই চাকরি ছেড়ে দেন। হাতে থাকা ১ হাজার ৪৮৩ টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। প্রথমবার এজেন্টের মাধ্যমে জাপান থেকে গাড়ির টায়ার আমদানি করে বিক্রি করলেন। লাভ শতভাগ। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি সুফি মিজানুর রহমানকে। কাপড়, খাদ্য, যন্ত্রপাতি, গুঁড়া দুধ, তেল-যেটিই আমদানি করেন, সেটিতেই শুধু সাফল্যের দেখা পান। আমদানি বাণিজ্যে লাভ হলেও তাঁর স্বপ্ন ছিল অনেক বড়। নব্বই দশকে বাণিজ্য থেকে পাওয়া মুনাফার টাকায় একের পর শিল্পকারখানা গড়েছেন।
প্রায় ৪৯ বছর আগে মাত্র ১ হাজার ৪৮৩ টাকা দিয়ে যে ব্যবসা শুরু করেছিলেন, এখন তাঁর শিল্পকারখানা ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৪। ঢেউটিন, ফ্লোট গ্লাস, কৃষি, মৎস্য, পরিবেশবান্ধব জাহাজভাঙা কারখানা, টেক্সটাইল, জ্বালানি পণ্য, গাড়ি সংযোজনসহ ১১ খাতে ব্যবসা রয়েছে পিএইচপি পরিবারের।
পিএইচপি পরিবার এখন অনেক খাতেই নেতৃত্ব দিচ্ছে। জাহাজভাঙা শিল্পের দুর্নাম ঘুচিয়ে পরিবেশবান্ধব জাহাজ ভাঙার নেতৃত্ব এখন তাদের হাতে। দেশের সবচেয়ে বড় প্রতিফলিত কাচশিল্পে ১ নম্বরে পিএইচপি। গাড়ি সংযোজন কারখানায়ও নেতৃত্ব দিচ্ছে এই পরিবার। ঢেউটিনশিল্পে শীর্ষ দুইয়ে আছে তাদের নাম। বিশ্বব্যাংক গ্রæপের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) ২০২০ সালে বাংলাদেশের বেসরকারি খাত নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে আয়ের দিক থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে এমন ২৩টি কোম্পানির তালিকায় পিএইচপির অবস্থান দেখানো হয় ১১তম। আর পিএইচপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গ্রুপের বার্ষিক লেনদেন এখন ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি।
সুফি মিজানুর রহমান বলেছেন পিএইচপি পরিবারের ১১ হাজার কর্মীর কথা। একসময় ব্যাংকের লোভনীয় চাকরি ছেড়ে এখন ১১ হাজার পরিবারের কর্মসংস্থান করেছেন তিনি। সুফি মিজানুর রহমানের সাত ছেলে, এক মেয়ে। বিদেশে পড়াশোনা শেষে দেশে এসে সাত ছেলে বাবার গড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর হাল ধরেছেন। বাবার কঠোর পরিশ্রমে গড়ে তোলা পিএইচপি পরিবারকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। ব্যবসায় সাফল্যের পাশাপাশি অনেক পুরস্কার পেয়েছেন সুফি মিজানুর রহমান। ২০২০ সালে বাংলাদেশের দ্বিতীয় শিল্পপতি হিসেবে পেয়েছেন একুশে পদক। ৭৯ বছর বয়সেও কঠোর পরিশ্রম করেন। কঠোর পরিশ্রম, সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস ও কাজে একাগ্রতা থাকলে সাফল্য অবশ্যম্ভাবী বলে বিশ্বাস তাঁর। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ দিনে আট ঘণ্টা পরিশ্রম করে। অসাধারণ হতে হলে ১৬ ঘণ্টা পরিশ্রম করতে হবে। না হলে সাফল্যের দেখা মিলবে না।