২২তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এবং সংকটাপন্ন রাজনীতি

14

মিয়া জামশেদ উদ্দীন

রাজনীতির আকাশে কালো মেঘ ঘণীভূত; বিশেষ করে রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে এ সমস্যা উদ্ভূত। সাথে আভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাওয়া। এতে সামগ্রীকভাবে অর্থনীতির ওপর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। তবে সব কিছুর ঊর্ধ্বে নাগরিক জীবনের মৌলিক অধিকারসমূহ সম্মত রাখা- যেন ভ‚লুণ্ঠিত না হয় দেশের উন্নয়ন ধারা।
গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত ভোটাধিকার। একথা অস্বীকার করার জো নেই? ইদানিং আভ্যন্তরীণ রাজনীতি যে অবস্থায় উপনিত- বিশেষ করে ক‚টনৈতিক আচার-আচরণ শিষ্টাচার বহির্ভূত; এমন কি রাজনৈতিক এজেন্ডা নিয়ে মাঠে নেমেছে। এসব নিয়ে রাজনৈতিক দলের সাথে রফাদফায় বৈঠক করে চলছে। এটি স্বতঃস্ফূর্ত কিনা, নাকী বলেকয়ে ডেকে আনা; বলতে হয়, নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা করা। এটি কোনভাবেই গণতন্ত্রের জন্য সুখময় বয়ে আনবে না, রাজনীতিতে এটি বাজে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
তবে দেখতে হবে নাগরিক জীবনের অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে কি-না। সর্বপ্রথম দেশ ও জনগণকে সুরক্ষা দেয়া। এমনিতে অতিরিক্ত ১০ লক্ষ রোহিঙ্গাশরণার্থীর চাপ সহিতে হচ্ছে; তার সাথে ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধে বৈশ্বিক চাপ বাড়ছে। বিশেষ করে অর্থনীতি ও রাজনীতি টালমাটাল অবস্থা। সঙ্গে অত্যধিক জনসংখ্যা নিয়ে মুহ্যমান অর্থনীতি। এ অবস্থায় নিশ্চয়তা ছেদ না ঘটে দু’ মুঠো আহার যোগানে। এরপরও এ টালমাটালে ধস নামার সমুহ শঙ্কা ওড়ে দেয়া যায় না। তাতে মানবিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা থেকেই যায়! এমতাবস্থায় খেয়াল রাখতে হবে দু’ পরাশক্তির দ্ব›দ্ব ও অবস্থান।
তবে তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে সহনিয় অবস্থা কতটুকুবা রাখা যায়? বিশেষ করে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পের সরঞ্জাম খালাসকে কেন্দ্র করে আবারও মুখোমুখি ওই পরাশক্তি দু’ দেশ। এ দ্ব›দ্ব দক্ষিণ এশিয়াতেও দৃশ্যমান হয়ে উঠে; এদিকে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা পাওয়া ওই জাহাজ ‘বুশরা’ নির্বিঘেœ এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়ত করতে দেখা যায়; অথচ জাহাজটি ওই নিষেধাজ্ঞা মোটেই কেয়ার করছে না; সেক্ষেত্রে মাল খালাসের বিষয়টি ছিল দেশটির জন্য গৌণ? তারপরও মাল খালাসের ওপর কেন-বা চাপাচাপি Ñ যা কিনা একটি স্বল্পোন্নত দেশের জন্য বুমেরাং।
২০০৯ সালে রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। তখন বৈশ্বিক রাজনীতি স্বাভাবিক ছিল। অন্যদিকে ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হয় ২০২২সালে ২ ফেব্রæয়ারি। এটি কবে থামবে তারও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরঞ্চ নানাভাবে একে অন্যকে ঘায়েল করতে মরিয়া হয়ে উঠে। দেশ দু’টি খাদ্য, জ্বালানিসহ অর্থনীতি ও রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বসে। এসব নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে হাঁফিয়ে উঠে শিল্পোন্নত দেশগুলোও। অবশ্য ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের প্রেক্ষাপট ভিন্নতর। আর এ কি-না একটি নামমাত্র বিদ্যুৎপ্লানের সরঞ্জাম খালাসে এই বাধসাধ। ২.৪ গিগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ‘ক্ষুদ্র’ আকৃতির বিদ্যুৎপ্লান। নিয়মিতভাবে এই নির্মাণকাজ অব্যাহত থাকলে ২০২৩ সালে প্লানটির একটি ইউনিট উৎপাদনে যাওয়ার কথা রয়েছে। রাশিয়ার রোসাটোম স্টেট অ্যাটমিক এনার্জি কর্পোরেশন এ নির্মাণ কাজের ঠিকাদারী করছে। প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ১,১৩,০৯২,৯২ কোটি টাকা। পাবনার ঈশ্বরদীর রূপপুরে এই নির্মাণযজ্ঞ চলছে। তবে আমেরিকার এ নিষেধাজ্ঞা আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মারাত্মকভাবে প্রভাব পড়ে। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে তীব্র খাদ্য সংকটের সম্ভাবনা। রীতিমত ইউরোপসহ শিল্পোন্নত দেশগুলোও হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাচ্ছে। দেশগুলো তীব্র জ্বালানি সংকটে পড়ে। তেল ও গ্যাসের যোগানও সংকুচিত হয়ে আসে। ওই বিদ্যমান অবস্থা থেকে কোনোভাবেই আমরাও মুক্ত নই। তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বেড়ে গেছে। এরমধ্যে নতুন করে এ নিষেধাজ্ঞা। যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। তারপরও পরাশক্তিধর দেশ আমেরিকা ঘুণাক্ষরে দ্বিধা করেনি পদক্ষেপটি নিতে। যা প্রত্যক্ষভাবে একটি দেশের উন্নয়নে বাধা দেয়ার সামিল। ১৩ দিন ধরে ভারতের হলদিয়া বন্দরে রাশিয়ার ঐ জাহাজ অবস্থান করে। প্রথমদিকে কিছুটা আশার আলো জাগায়। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ওই বন্দরে সরঞ্জাম খালাস করেই সড়ক পথে আনার কথা; আর এজন্য দ্বিগুণ অর্থদÐও গুণতে হতো! তারপরও ইচ্ছা পোষণ করা হয় Ñ যখনি একটি সম্ভাবনা দেখাদেয়, ঠিক তখনি দেশটি বেঁকে বসে। অর্থাৎ এবার ভারত ওই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকা জাহাজের মালামাল খালাসে অসম্মতি জানায়; তাদেরও সাফ কথা বিষয়টি তাদের নয়, তারা খামাখা কেন-বা গায়ে জড়াবে। এত করে ১৫ জানুয়ারি রাশিয়ার ওই জাহাজ মালামাল খালাস না করে ফিরে যায়। তবে ভারতের এ নীতি দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে মারাত্মক প্রভাব পড়বে। তবুও বন্ধুপ্রতিম দেশ হিসেবে সহমর্মিতা ও আস্থার ছেদ ধরবে না, এমনটা আশা করা যায়।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামে পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে ভারতের ভ‚মিকা অনস্বীকার্য। সেক্ষেত্রে দেশের কাঠামো ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে এগিয়ে আসে দেশটি। ধারণা ছিল, ভারত তৃতীয় পরাশক্তি দেশ হিসেবে, তৃতীয় কোন শক্তির চোখ রাঙ্গানিতে নমনীয় হবে না, অনেকটা নিঃসংকোচিত্তে এগিয়ে যাবে। হয়তো দেশটির তা হয়ে উঠেনি। তবে ভারত ইচ্ছে করলে অন্তত একটি সুরাহা করতে পারতো। যাকগে, সেই কথা নাইবা বললাম। ছোট্ট দেশ হিসেবে অনেক কিছু সহিতে হয়; অনেকটা নিরবে মার খাওয়ার সামিল।
সর্বশেষ আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার ফলে রূপপুর পারমাণবিক ওই বিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণসামগ্রী খালাসের ছাড়পত্র মিলেনি। তবে আশার আলো যে একেবারে ক্ষিণ হয়ে গেছে, তাও না। তাতে সরকার যে হাল ছেড়ে দিয়েছে, তাও না। ওই নিষেধাজ্ঞা কবলিত জাহাজের পরিবর্তে, দ্বিতীয় একটি জাহাজে মাল পরিবহন ও খালাসে আপত্তি থাকার কথা নয়; তারপরও বলতে হয় অর্থদÐমতো ঘাড়ে চাপবে অত্যধিক ব্যয়। অথচ তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে, বাংলাদেশ বরাবরই সংযম প্রকাশ করে আসছে। তবে আমেরিকার ওই নিষেধাজ্ঞাকেও উপেক্ষা করেনি। ইচ্ছে করলে তা করে দেখাতে পারতো; কেন জানি ওই পরাশক্তিধর দেশকে বরাবরই অধিকতর সমীহ এবং সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়ে আসছে। মনে রাখতে হবে নিষেধাজ্ঞা কবলিত জাহাজটি অপর পরাশক্তিধর দেশ রাশিয়ার; অথচ রাশিয়া নেটো, ইউরোপ ও আমেরিকার তুমুল বিরোধীতা সত্তে¡ও ইউক্রেনের ওপর হামলা করে বসে; উদ্ভূত এ পরিস্থিতি পারমাণবিক বোমা হামলার সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেয়া যায় না। এতে করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধামামা-রণহুংকার বেজে উঠে। অথচ দেশটি মাল খালাসে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার কথা বলে- দেশটি মাল খালাসে বাধা দিলে ছেড়ে দেবে না বলে হুঁশিয়ারী দেয়। তাহলে তো এই সাব-কন্টিনেন্টাল হয়ে উঠবে পরাশক্তিধর দেশ দু’টির রণক্ষেত্র। অর্থাৎ যুদ্ধের ময়দানভূমি। অনেকটা মুখোমুখি অবস্থানে এসে যায়; তার সাথে ভারতের অবস্থাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। হঠাৎ ভারত মাঝ পথ থেকে সরে আসে। এতে ¯œায়ূচাপ সাময়িকভাবে শীতিল হয়। এরমধ্যে ইউরোপ ও আমেরিকারসহ শিল্পোন্নত দেশগুলো বুঝতে পারে Ñ ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধাবস্থা আরো র্দীঘ, আরো জটিল হয়ে উঠতে পারে। হয়তো সরাসরি পরাশক্তিধর দেশ দুটি যুদ্ধে জড়াবে; এতে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি আরো জটিল হয়ে উঠবে। হয়তো রাশিয়া শেষ রক্ষায় পারমাণবিক বোমার মতো বিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহার করতে উদ্যত হবে। দৃশ্যত অনেকটা তা হয়ে উঠেছে। ছোট্ট-ছোট্ট এসব ঘটনাবহুল সমস্যা নিয়ে মারমুখি হয়ে উঠবে রাশিয়া। যদিওবা আদৌ কারো পক্ষে এ পরিস্থিতি সমর্থন যোগ্য নয়। একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ওইসব বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছে।
আপাতত বৈশ্বিক রাজনীতিতে যেসব দেশ মুখোমুখি। চিন, তাইওয়ান, ভারত, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ইজরাইল, ফিলিস্তান, ইরান, আমেরিকা, নেটো ও রাশিয়া। এসব দেশ নিয়ে সীমান্তরোধ, বাণিজ্য ও সমরাস্ত্র অবস্থানে পরাশক্তিধর দেশগুলো মুখোমুখি। রাজনীতির এই মেরুকরণে রাশিয়া ও আমেরিকা সর্বক্ষেত্রে সাপে নেউলে অবস্থা। আর নেটোর আধিপত্য ঠেকাতে গিয়ে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়া যুদ্ধে জড়ায়। অন্যদিকে পুঁজির চরম আগ্রাসনে নয়া উপনিবেশ গড়ে তোলার এক ধরনের মানস তীব্রতরভাবে কাজ করছে।
এদিকে ভূ-গত রাজনীতিতে ‘১০ ডিসেম্বরে’র রণহুংকার ক্ষমতাসীনরা ভালোই ঠেকিয়েছে। অনেকটা শাসক দল রাজনীতির মাঠ নিয়ন্ত্রণ রেখেছে। তারপরও যে ঝুঁকি নেই, তা বলছি না। ক্ষমতাসীনরা বরাবরই কৌশলী। পাল্টা হুংকারে মাঠ তাতিয়ে রাখে এবং পজিটিভ প্রচারণার মধ্যে দিয়ে অনুক‚ল জনমত ভাগিয়ে নেয়ার যে স্বচ্ছ অবস্থা সৃষ্টি হয় তা অনেকটা বাজিমাত।
চলতি বছরের মাঝামাঝিতে ২২তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। পার্লামেন্ট সদস্যদের সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। আপাতত একক সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে ক্ষমতাসীন দলের নিশ্চিত অবস্থা রয়েছে। একক প্রার্থী দেবে ক্ষমতাসীন দলটি। এমনিতে আভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক রাজনীতি অনুক‚লে নয়। উত্তপ্ত হয়ে উঠছে রাজনীতির মাঠও। আগামী জানুয়ারিতে পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তাই প্রস্তুতিতে কোনপ্রকার হেরফের হওয়ার সুযোগ নেই, সর্বদাই সতর্ক অবস্থানে ক্ষমতাসীন দল। তাই একটু থেকে একটু হলেই হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, শক্তহাতে হাল ধরতে হবে। অভিজ্ঞ, বিচক্ষণ, বুদ্ধিদীপ্ত ও দুঃসাহসিক হতে হবে। আবেগে নয়, বাস্তবিক পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দিতে হবে। এরমধ্যে ডজনখানেক সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম শোনা যাচ্ছে। খোদ জাতির জনকের কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহেনা, অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী এমপি, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি, আমির হোসেন আমু এমপি, স্পিকার শিরিন সুলতানা, আ.ক.ম মোজাম্মেল হক ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মশিউর রহমান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও রাষ্ট্রপতি হিসাবে চিন্তা-ভাবনায় রাখা যেতে পারে। এক্ষেত্রে রাজনীতিতে চমক সৃষ্টি হবে, এবং একইসাথে পটপরিবর্তনও আসবে। নতুন মেরুকরণ দেখা দিবে রাজনীতির হিসাবনিকাশেও। এধাক্কা বিরোধী শিবিরেও ছুঁইবে। অবশ্য সংবিধানসম্মত হতে হবে এ পরিবর্তন। প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হলে সংসদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে। তখন সংসদের উপনেতাকে প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচিত করতে হবে নতুন করে সংসদ সদস্যদের ভোটে। অর্থাৎ পার্লামেন্ট অক্ষুন্ন থাকবে। তবে রাজনীতির পরিভাষা হলো- রাজনীতিতে শেষ বা অসম্ভব বলতে কিছু নেই।
লেখক : কবি, কলামিস্ট ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক