২০২২ এর আহবান “হৃদয়ের যত্নে হৃদয়বান হোন” ডা. প্রবীর কুমার দাশ

38

 

হৃদয় তথা হৃৎপিন্ড মহান সৃষ্টিকর্তার এক অনন্য সৃষ্টি। তা শরীরের এমন এক অঙ্গ যা আপনি সরাসরি স্পর্শ করতে পারেন যা আপনি সরাসরি শুনতে পারেন। হৃৎপিন্ড দিয়েই জীবনের শুরু; এবং তা থেমে যাওয়া জীবনাবসান। শরীরবৃত্তীয়ভাবে তা শরীরের অন্যসব অঙ্গকে রক্ত তথা জীবনী শক্তি যোগায়। মনস্তাত্তি¡কভাবে হৃৎপিন্ড আবেগের উৎস, সাহসের ঠিকানা, ভালোবাসার উৎপত্তিস্থল এবং আত্মার আশ্রয়স্থল বলে মনে করা হয়। বিভিন্ন কৃষ্টি ও ধর্ম বিশ্বাসেও আবেগ অনুভূতি ও ভালোবাসার সাথে হৃৎপিন্ডের সম্পর্কের কথা উদ্ধৃত হয়েছে।
বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে মৃত্যুর প্রদান কারণ হৃদরোগ। এই মৃত্যুর শতকরা ৭০ ভাগই ঘটে বাংলাদেশসহ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশ সমূহে। অধিকন্তু এখানে হৃদরোগ ছোবল মারে তুলনামূলকভাবে কম বয়সে, যখন আক্রান্ত ব্যক্তিগণ তাদের উৎপাদনশীলতার শীর্ষে অবস্থান করে। বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর শতকরা ৩০ ভাগ হৃদরোগজনিত কারণে। এখানে কেন বাড়ছে হৃদরোগ?
বিগত দশকগুলোতো দক্ষিণ এশিয়া দেশগুলোতে হৃদরোগ দ্বিগুণ বেড়েছে। যদিও তা আমেরিকা ও অন্যান্য উন্নত দেশে অর্ধেকে নেমে এসেছে। উন্নত বিশে^ তা সম্ভব হয়েছে হৃদরোগ গবেষণা ও তার প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সাফল্যমন্ডিত করার মাধ্যমে। হৃদরোগ বর্তমানে বাংলাদেশের বিকাশমান মহামারী। তার জন্য দায়ী কারণগুলো হচ্ছে:
– দ্রিত নগরায়ন ও গ্রামীণ জীবনের বদলে শহরে জীবনধারা বেছে নেয়া
-খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন চর্বি ও উচ্চক্যারী সমৃদ্ধ খাবার, অতিরিক্ত ভাজাপোড়া খাবার, প্রক্রিয়াজত খাবার, ফাস্টফুড কোমল পানীয় গ্রহন। তার পাশাপাশি প্রয়োজনের তুলনায় কম শাকসবজি ও ফলমূল গ্রহণ।
-ধূমপান, সাদা, জর্দ্দা ও অন্যান্য তামাকজাত দ্রব্য সেবন
– ডায়াবেটিসের ক্রমবর্ধমান প্রকোপ
-উচ্চ রক্তচাপ খাবারে উচ্চ লবণ গ্রহণ ও অসচেতনতা এই সমস্যাকে জটিল করে তুলেছে।
-অলসজীবন যাত্রা ও ব্যায়ামের অভাব
-মেদ বাহুল্য
-মানসিক চাপ ও অস্থিরতা।
-হৃদরোগ ও তার ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান সম্পর্কে সচেতনতার অভাব প্রতিরোধে করণীয় ঃ-
-পারিবারিক উদ্যোগ-স্বাস্থ্যসম্মত খাবার তৈরী, রান্নায় উপযুক্ত তেল ব্যবহার (সয়াবিন, অলিভ ওয়েল কিংবা সরিষার তেল), রান্নায় তেল ব্যবহার সীমিত করণ। ডুবো তেলে তৈরী খাবার পরিহার করুন। ঘি, ডালডা, পাম অয়েল, বনস্পতি, মার্জারিন বর্জন করুন। বাচ্চাদের স্কুল টিফিনে ফাস্টফুডের পরিবর্তে তাজা ফল, সবজি, কোমল পানীয় পরিবর্তে পানি, কম ননীযুক্ত দুধ, চিনিমুক্ত তাজা ফলের রস দিন। গৃহ পরিবেশ ধূমপান মুক্ত রাখুন। মানসিক চাপ কমান, পর্যাপ্ত ঘুমও বিশ্রাম নিশ্চিত করুন, চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থা করুন, পরিবারের সবাই কর্মমুখর থাকুন, ব্যায়ামও মেডিটেমনের অভ্যাস করুন।
-সামাজিক উদ্যোগ-ব্যায়াম ও শরীরিক কসরতের জন্য পার্ক, খেলার মাঠ, নদীর পাড়, সমুদ্র সৈকতে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিশ্চিত করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলাধুলা ও শরীর চর্চার ব্যবস্থা করা, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পরিবেশন, স্কুল পরিবেশ ধূমপান মুক্ত রাখা ও সেখানে ক্ষতিকারক খাবার বিক্রি নিষিদ্ধ করা। হৃৎ সুস্থতা বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সচেতন করা। কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পরিবেশন করা ও শরীরিক ফিটনেস কর্মসূচি গ্রহণ। খাবার দোকানে খাবার লেভেলে উপাদান উল্লেখ করা। বিভ্রান্তিমূলক বিজ্ঞাপন বন্ধ করা। ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করা। খাদ্যমান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার তৎপরতা বৃদ্ধি করা। হৃদরোগের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি ও তার প্রতিরোধে সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে কর্মসূচি গ্রহণ। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় হৃদরোগ প্রতিরোধে বার্তা প্রচার। সামাজিক প্রসিদ্ধ ব্যক্তিগণ, সেলিব্রেটিগণ, সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টিতে অবদান রাখতে পারেন। স্বনামধন্য হৃদরোগ বিশেষজ্ঞগণের জীবনাচরণ, ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গের উপদেশ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।

রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উদ্যোগ : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্যশিক্ষণ ব্যুরোর মাধ্যমে এ প্রয়োজনীয় বার্তা জনগণকে পৌঁছানো, বিশ্ব হার্ট দিবসকে জাতীয় দিবস হিসাবে ঘোষণা করে কর্মসূচি গ্রহণ। হৃৎ-হিতকর খাবার বিক্রয় ও বিপণন উৎসাহিত করা, হৃদরোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী খাবার, যেমন ট্রান্সফ্যাট সমৃদ্ধ মচমচে বিভিন্ন খাবারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ কিংবা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, ধূমপান বিরোধী আইনের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা, পাঠ্যপুস্তকে হৃদরোগ প্রতিরোধে করণীয় বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা ও ছাত্রছাত্রীদের এ বিষয়ে সচেতন করে তোলা।
আসুন আমরা প্রাণঘাতি হৃদরোগ সম্পর্কে সচেতন হই এবং তা প্রতিরোধে সচেষ্ট হই এবং সকলের জন্য সুস্থ ও উৎপাদনশীল জীবন নিশ্চিত করি।
লেখক : হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও সেক্রেটারি জেনারেল চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশন, ও আর নিজাম রোড, চট্টগ্রাম।