১৯৭১-২০২৩: বাংলাদেশের অগ্রগতির হালখাতা

81

অমল বড়ুয়া

১. বাংলাদেশ বিশ্ব বিস্ময়। ঊনিশ একাত্তর সালে নয় মাস কঠোর কঠিন যুদ্ধে বীরত্বের স্বাক্ষর রেখে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে বিশ্ব মানচিত্রে উন্মেষ ঘটে বাংলাদেশ নামক এক স্বাধীন সার্বভৌম দেশের। লড়াই-সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা পাওয়া এ দেশটি শুরুতেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে তকমা পায়। ৭০’র দশকে স্বাধীন বাংলাদেশকে খাদ্য ঘাটতি, দুর্ভিক্ষ আর প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত এক জনপদ হিসেবে চিনেছে বিশ্ববাসী। ৩০-লক্ষ শহীদের প্রাণ আর রক্তের বিনিময়ে জন্ম নেওয়া এই বাংলাদেশকে আজকের অবস্থানে আসতে অতিক্রম করতে হয়েছে হাজারো প্রতিবন্ধকতা। যুদ্ধ বিধ্বস্ত, প্রায় সর্বক্ষেত্রে অবকাঠামোবিহীন সেদিনের সেই সদ্যজাত জাতির ৫১ বছরের অর্জনের পরিসংখ্যানও নিতান্ত অপ্রতুল নয়।
স্বাধীনতার পর বিগত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের যেসব অর্জন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়া ফেলেছে তারমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিগ্রস্ত দেশের প্রতিনিধি হিসেবে নেতৃত্ব দেয়া, তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের শীর্ষে উঠে আসা, শান্তিরক্ষা মিশনে ব্যাপক অংশগ্রহণ, অর্থনৈকি প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। জঙ্গীবাদ দমনে সাফল্যের দিকটিও প্রশংসা পেয়েছে। তাছাড়া সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ৮টি লক্ষ্যের মধ্যে শিক্ষা, শিশুমৃত্যুহার কমানো এবং দারিদ্র-হ্রাসকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য উন্নতি প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছে। এতে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবমতে, বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে প্রতিহাজারে শিশুমৃত্যুর সংখ্যা ছিলো ১৫৩জন। যেটি ২০১৮ সালে এসে প্রতিহাজারে মাত্র ২২জনে নেমে আসে। এছাড়া বিবিএস ১৯৮১ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর সংখ্যা দিয়েছে প্রতিহাজারে ২শ ১২জন। যেটি ২০১৮ সালে হয়েছে প্রতিহাজারে ২৯। ১৯৯১ সালে মাতৃমৃত্যুর হার ছিলে ৪.৭৮ শতাংশ। সেটি এখন ১.৬৯ শতাংশে নেমে এসেছে। ‘জাতীয় শিশুনীতি-২০১১’ প্রণয়নের মাধ্যমে সুরক্ষিত করা হয়েছে শিশুদের সার্বিক অধিকারকে। দেশের ৪০টি জেলার সদর হাসপাতাল এবং ২০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্থাপন করা হয়েছে ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেল। দুঃস্থ্, এতিম, অসহায় পথ-শিশুদের সার্বিক বিকাশের জন্য স্থাপন করা হয়েছে ১৫টি শিশু বিকাশ কেন্দ্র।
স্বাস্থ্যখাতকে যুগোপযোগী করতে প্রণয়ন করা হয়েছে ‘জাতীয় স্বাস্থ্য নীতিমালা-২০১১’। তৃণম‚ল পর্যায়ের দরিদ্র মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে গড়ে তোলা হয়েছে ১২হাজার ৭৭৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক। ৩১২টি উপজেলা হাসপাতালকে উন্নীত করা হয়েছে ৫০শয্যায়। মেডিকেল কলেজ ও জেলা হাসপতালগুলোতে ২-হাজার শয্যা সংখ্যাবৃদ্ধি করা হয়েছে। মাতৃ ও শিশুমৃত্যুহার এবং জন্মহার হ্রাস করা সম্ভব হয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। ১৯৯০ সালে নবজাতকমৃত্যুর হার ১৪৯ থেকে নেমে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৫৩-তে। স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেবার লক্ষ্যকে সামনে রেখে নির্মাণ করা হয়েছে নতুন ১২টি মেডিকেল কলেজ, নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ৪৭-হাজারেও বেশি জনশক্তি।
শিক্ষাকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেবার জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপসম‚হের মধ্যে অন্যতম হলো- শতভাগ ছাত্রছাত্রীর মাঝে বিনাম‚ল্যে বই বিতরণ কার্যক্রম। নারীশিক্ষাকে এগিয়ে নেবার জন্য প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিকস্তর পর্যন্ত চালু করা হয়েছে উপবৃত্তির। বর্তমান ২৬-হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে নতুন করে জাতীয়করণ করেছে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষকের চাকরি সরকারীকরণ করা হয়েছে। ১৯৯০ সালে বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিশুর শতকরা হার ছিল ৬১, বর্তমানে তা উন্নীত হয়েছে শতকরা ৯৭.৭ ভাগে। হতদরিদ্রদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি বিস্তৃত করতে বয়স্ক, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্ত ও দুঃস্থ মহিলা ভাতা, অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃকালীন ভাতাসহ ভাতার হার ও আওতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা হয়েছে। ২০০৮-২০০৯ সালে এই খাতে মোট বরাদ্দ ছিল ১৩ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা, বর্তমানে এ কার্যক্রমে বরাদ্দের পরিমাণ ২৫ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। খানা আয়-ব্যয় জরিপ, ২০১০ এর সমীক্ষায় দেখা গেছে মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৪.৫ শতাংশ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির আওতাভুক্ত হয়েছে। দেশের তৃণম‚ল পর্যায়ে প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারি সেবা পৌঁছে দেবার অভিপ্রায়ে দেশের ৪৫৫০টি ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপন করা হয়েছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার। কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত এ-পোর্টালের সংখ্যা প্রায় ২৫০০০।
বর্তমানে বাংলাদেশে মোবাইল গ্রাহকের সংখ্যা ১২ কোটি ৩৭ লক্ষ এবং ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা ৪ কোটি ৪৬ লক্ষে উন্নীত হয়েছে। ডিজিটাল ও স্মার্ট দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কর্তৃক ২০১৮ সালের ১১ মে কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করা হয়। এর মধ্য দিয়ে ৫৭তম দেশ হিসেবে নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকারী দেশের তালিকায় যুক্ত হয় বাংলাদেশ।
২. বাংলাদেশ জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকাভ‚ক্ত হয় ১৯৭৫ সালে। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের অন্তর্ভ‚ক্ত হতে যে ৩টি শর্ত রয়েছে তা ২০১৮ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ পুরণ করে। পরে ২০২১ সালেও ৩টি শর্ত পুরণে প্রয়োজনীয়তা দক্ষতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটেছে। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎখাতে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অর্জনের মধ্যে রয়েছে জাতীয় গ্রিডে অতিরিক্ত ৬-হাজার ৩২৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সংযোজন, যার ফলে বিদ্যুতের সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৪৭ শতাংশ থেকে ৬২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। একইসাথে মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ২২০ কিলোওয়াট ঘণ্টা থেকে বেড়ে ৩৪৮ কিলোওয়াট ঘণ্টায় দাঁড়িয়েছে। নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান করা হয়েছে ৩৫-লক্ষ গ্রাহককে। নির্মাণ করা হয়েছে নতুন ৬৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্র।
স্বাধীনতার মাত্র পাঁচদশকে কৃষি-উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৭২ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয় মাত্র ১ দশমিক ২০ কোটি টন। ২০২০ সালে এ-উৎপাদন ৪ দশমিক ২৫ কোটি টনে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উৎপাদনে তৃতীয়। প্রায় ১৬ কোটি জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশ বর্তমানে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সারা বিশ্বে আজ পর্যন্ত মাত্র ১৭টি উদ্ভিদের জিনোম সিকুয়েন্সিং হয়েছে, তার মধ্যে ড. মাকসুদ করেছেন ৩টি। তাঁর এই অনন্য অর্জন বাংলাদেশের মানুষকে করেছে গর্বিত। বর্তমানে বিশ্বের ১৫৭টি দেশে বাংলাদেশের ৮৬ লক্ষেরও অধিক শ্রমিক কর্মরত আছে। ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিমিশনে যোগদানের পর এ-পর্যন্ত বিশ্বের ৩৯টি দেশের ৬৪ শান্তিমিশনে খ্যাতি ও সফলতার সাথে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। এযাবৎকালে জাতিসংঘ শান্তিমিশনে বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী ১১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বাগ্রে। বাংলাদেশ সার্বজনীন কর্মসংস্থান তৈরিতে দক্ষিণ এশিয়ায় অগ্রগণ্য। বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণের পরিমাণ ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ, ভারত ও পাকিস্তানে ২০ শতাংশ। বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীর কর্মক্ষেত্রে অধিক অংশগ্রহণ অন্যতম কারণ। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের পাশাপাশি প্রসার ঘটেছে আবাসন, জাহাজ, ঔষুধ, ও প্রক্রিয়াজাতকরণ খাদ্যশিল্পের। আর এ-পণ্যসমূহ বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের তালিকায় যুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশের আইটিশিল্প বহির্বিশ্বে অভ‚তপ‚র্ব সুনাম কুড়িয়েছে। ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের আইটিশিল্পে ১০ কোটি মার্কিন ডলার রপ্তানি আয় হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের ৩-হাজার ৮৭৫-কোটি ডলারের মোট রপ্তানির মধ্যে শুধু পোশাক শিল্পখাত থেকে আয় হয়েছে ৩-হাজার ১৪৬-কোটি ডলার। বর্তমানে বিশ্বে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রপ্তানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে। পৃথিবীতে এখন এমন কোনো দেশ নেই যেখানে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লেখা পোশাক পাওয়া যায় না।
বিবিএস এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ১৯৭৩-১৯৭৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের রফতানি আয় ছিলো মাত্র ২৯৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সেসময় জিডিপি’র আকার ছিলো ৭ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। মাথাপিছু আয় মাত্র ১২৯ ডলার। দারিদ্রের হার ৭০ শতাংশ। ১৯৭১ সালে আমাদের দেশের রপ্তানি পণ্য বলতে ভরসা ছিল শুধু পাট আর চামড়া। স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ছিল মাত্র ৩৪-কোটি ৮৪-লাখ ডলার। একান্ন বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে রফতানি আয় বহুগুণে বেড়ে মিলিয়ন ডলার থেকে এসেছে বিলিয়ন ডলারের ঘরে। ২০২০ সালের হিসেবে যা ৩৯.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। জিডিপি আকার ১৯৭৩-১৯৭৪ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসে বেড়েছে ৩৬৯ গুণ। পরিমাণে যা প্রায় ২৭ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা। মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৬ গুণ। দারিদ্রের হার কমে হয়েছে ২০.৫ শতাংশ। ২০৩৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হতে যাচ্ছে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। বর্তমানে জিডিপির আকার ৪৬০ বিলিয়ন ডলার, ২০২৫ সালে যার আকার হবে ৫০০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের অর্থনীতি যদি ১০ শতাংশ হারে বাড়ে তাহলে ২০৩০ সালে, ৫ শতাংশ হারে বাড়লে ২০৪০ সালে ট্রিলিয়ন ডলারের বড় অর্থনীতিতে পরিণত হবে। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৯৪ ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে এসে আমাদের মাথা পিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২৮২৪ মার্কিন ডলার। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি)-২০২২ সালের মানব-উন্নয়ন প্রতিবেদনমতে, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭৩ দশমিক ৬ বছর। অন্যদিকে ভারত ও পাকিস্তানের গড় আয়ু যথাক্রমে ৬৭ দশমিক ৭ বছর ও ৬৭ দশমিক ৩ বছর। সর্বক্ষেত্রে বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রার ধারাকে সমুন্নত রাখতে কাজ করছে বর্তমান সরকার। রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ উন্নতবিশ্বে পদার্পণ করুক এই প্রত্যাশা রইল।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক