১৫ আগস্টের খলনায়ক খন্দকার মোশতাক: বাংলার দ্বিতীয় মিরজাফর

8

সুপ্রতিম বড়ুয়া

খন্দকার মোশতাক আহমেদ মানেই বাংলাদেশের মানুষের কাছে এক বিশ্বাসঘাতকের নাম। স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যার দিন যখন তার রক্তের দাগ শুকায়নি তখন মোশতাক নিজেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। মাত্র ৮৩ দিন তিনি টিকতে পেরেছিলেন। পরে খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে একটি অভ্যুত্থানে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় খন্দকার মোশতাকে মুজিবনগর সরকারে পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন। দেশ স্বাধীনের পর শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারে তিনি বিদ্যুৎ, সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। ১৯৭৫ সালে তাকে বাণিজ্য মন্ত্রীর দায়িত্ব আসীন করা হয়। মোশতাক বাকশালের কার্যকরী কমিটির সদস্যও ছিলেন। আমরা জানি, আমাদের ইতিহাসকে বিভিন্নভাবে বিকৃত করা হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসও এর ব্যতিক্রম নয়। আজ আমাদের নতুন করে প্রকৃত ইতিহাসের স্বরূপ সন্ধানের সময় এসেছে। কারণ ইতিহাস যখন বিকৃত হয়, সময়ও তখন বিভ্রান্তিকর হয়ে পড়ে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম একসময় এ বিকৃত ইতিহাসকে সত্য বলে মানতে শুরু করে। ফলে মানুষ বিভ্রান্ত হয় এবং তার প্রকৃত সত্তার মৃত্যু ঘটে। আর যদি প্রকৃত ইতিহাস মানুষ জানতে পারে, তবে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী দিনের কৌশল নির্ধারণে মানুষ সক্ষম হয়। ইতিহাসে যেমন মহানায়ক থাকে, তেমনি বিশ্বাসঘাতক খলনায়করাও ইতিহাসে জায়গা করে নেয়। অনেক ক্ষেত্রে তাদের সাজানো দাবার গুটিতে তারা সফল হয়। ইতিহাসের এই খলনায়করা গভীর কৌশলে ইতিহাসের মহানায়কের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলে তার বিশ্বাসভাজন হয়ে ওঠে। একসময় তারা মহানায়কের ছায়াসঙ্গী হয়ে যায়। খুব কাছ থেকে অনুসরণ করে মহানায়কের জীবন ও তার কর্মকৌশল। ধীরে ধীরে তারা দল ভারি করে ষড়যন্ত্রের ছক আঁকতে থাকে। এদের সঙ্গে যুক্ত হয় নেপথ্যের কুশীলবরা। অতিভক্তি ও আনুগত্যের মাধ্যমে তারা মহানায়কের আবেগ ও অনুভূতিকে প্রভাবিত করে। এটা একধরনের অপকৌশল, যা বিভিন্ন ইতিহাস ঘাঁটলে পাওয়া যাবে। এখনও এই অপশক্তি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মূল ¯্রােতের সঙ্গে মিশে গিয়ে তাদের ষড়যন্ত্রের নীলনকশা এঁকে চলেছে। তবে সময় এসেছে ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এই অপশক্তিকে চিহ্নিত করার এবং তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর। এই অপশক্তির ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করেছেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। তিনিও ছিলেন সেই শঠ আর ষড়যন্ত্রকারীদের একজন। বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমানের দেহ নামাতে যে লোকটি কবরে নেমেছিলেন, তার নাম খন্দকার মোশতাক। শেখ কামালের বিয়েতে উকিল দিয়েছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুকে সবাই সোনার নৌকা উপহার দিলেও সোনার বটগাছ উপহার দিয়েছিলেন খন্দকার মোশতাক। কারণ তিনি বলতেন, বঙ্গবন্ধু তার কাছে বটবৃক্ষের মতো। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ঠিক আগের দিন নিজের বাসা থেকে তরকারি রান্না করে বঙ্গবন্ধুকে তা পরিবেশন করেছিলেন তিনি। এই বিশ্বাসঘাতক মোশতাককে বিশ্বাস করে বঙ্গবন্ধু তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনাকে বলেছিলেন, ‘যে কোনো সমস্যায় তোমাদের মোশতাক চাচাকে বলো, তাকে ডেকো, তিনি সবসময় তোমাদের পাশে থাকবেন।’ এভাবে অতিভক্তির কৌশল অবলম্বন করে মোশতাক বঙ্গবন্ধুর খুব কাছাকাছি চলে আসেন।ইতিহাসের চাকাকে পেছনে নিয়ে গেলে এ ধরনের আরেকজন ষড়যন্ত্রকারীকে চিহ্নিত করা যাবে। তিনি হলেন মীর জাফর। তার নামের আগে যুক্ত হয়েছে একটি শব্দ- বিশ্বাসঘাতক। ভারতের মুর্শিদাবাদে মীর জাফরের প্রাসাদের মূল তোরণের নামকরণ করা হয়েছে ‘নেমক হারাম দেউল’ বা বিশ্বাসঘাতক গেট। আর এটা তার প্রাপ্য ছিল। মার্কিন লেখক ও ঔপন্যাসিক মার্ক টোয়েন যথার্থই বলেছেন, ‘যদি তুমি রাস্তা থেকে কোনো ক্ষুধার্ত কুকুরকে বাড়িতে নিয়ে যাও এবং লালন-পালন কর, তবে কুকুরটি কখনও তোমাকে কামড়াবে না। এটাই হল মানুষ ও কুকুরের মধ্যে পার্থক্য।’ নিজ সংগঠন, নিজ দল বা গোত্র সর্বোপরি দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার লজ্জাজনক কিংবা ভয়াবহ উদাহরণ মানুষই সৃষ্টি করেছে। আর ইতিহাসের পাতায় তাদের পরিচিতি ঘটেছে বিশ্বাসঘাতক বা বেঈমান রূপে। বাংলা ভাষায় মীর জাফর নাম বা শব্দটি যেমন বিশ্বাসঘাতকের প্রতিরূপ, ইংরেজি ও নরওয়ের ভাষায়ও কুইজলিং নাম বা শব্দটি সেভাবে ব্যবহৃত হয়। আর এই বিশ্বাসঘাতক হচ্ছেন নরওয়ের ভিদকুন আব্রাহাম লাউরিটজ জনসন কুইজলিং। একসময়ের নরওয়ের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও জনপ্রিয় রাজনীতিক কুইজলিং গোপনে ইতালি ও জার্মানির ফ্যাসিবাদী শক্তির সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। এর প্রধান কারণ ছিল সুবিধাবাদিতা। তার এই রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের মূল কারণ ছিল তার দলের প্রভাব ও জনপ্রিয়তা কমে যাওয়া। আরেকজন বিশ্বাসঘাতক ছিলেন রোমের মার্কাস জুলিয়াস ব্রæটাস। ব্রæটাসের দেশ ইতালিতে। কেউ কারও সঙ্গে বেঈমানি করলে ক্ষোভ প্রকাশের জন্য ল্যাটিন ভাষায় বলা হয়, ‘এট টু ব্রæটি!’ অর্থাৎ ব্রæটাস তুমিও! এই ব্রæটাস ছিলেন প্রাচীন রোমের জেনারেল এবং তৎকালীন নগররাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়ক জুলিয়াস সিজারের প্রথম জীবনের বন্ধু এবং অনুগ্রহ গ্রহণকারী। পরবর্তী সময়ে অন্যদের সঙ্গে ব্রæটাসও রাষ্ট্রপ্রধান জুলিয়াস সিজারকে হত্যায় অংশ নেয়, যা মৃত্যুর আগে সিজার কখনোই ভাবতে পারেননি। কুখ্যাত রাজাকার গোলাম আযমসহ রাষ্ট্রবিরোধী যে চক্র স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল, যে চক্র গণহত্যার মাধ্যমে নিজ দেশের নাগরিকদের নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা চালিয়েছিল, তারাও ছিল প্রকৃত অর্থে বিশ্বাসঘাতক। আর তাদের তৎপরতা পলাশীর প্রান্তর থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধ থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাÐ পর্যন্ত এবং আজও অব্যাহত রয়েছে। আর মোশতাক আহমেদ তাদেরই তৈরি। গবেষণা, বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, এই কুচক্রী মোশতাক আহমেদের সঙ্গে ইতিহাসের আরেক খলনায়ক মীর জাফরের বিস্ময়কর সাদৃশ্য রয়েছে। তাদের কৌশল, নেতিবাচক কর্মধারা যেমন একই ধরনের ছিল, তেমনি তাদের শারীরিক গঠন ও গড়নের মধ্যেও অবাক করার মতো মিল ছিল। আর রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতার প্রভাব মোশতাকের মধ্যে প্রবল ছিল বলে খুব সহজে তিনি দল, নীতি আর আদর্শ ত্যাগ করে বিপরীতমুখী অবস্থান নিতে পারতেন। প্রকৃতপক্ষে তার কোনো নীতি ছিল না, নীতিহীনতাই ছিল তার রাজনীতির মুখ্য বিষয়। আর এটাকে রাজনীতি না বলে অপরাজনীতি বলাটাই যৌক্তিক। যদি নীতি ও আদর্শের কথা বলা হয়, তবে তা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে বলা যায়, মোশতাক ছিলেন ডানপন্থী ও সা¤প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী মার্কিনঘেঁষা এক অপশক্তি। কিভাবে এই বিশ্বাসঘাতক মোশতাক সুকৌশলে বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে এসে চতুরতার মাধ্যমে তার বিশ্বাসভাজন হলেন, তা গবেষণার মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে এ ধরনের রাজনীতিকদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধুর জননী বেগম সাহেরা খাতুনের মৃত্যুতে বঙ্গবন্ধু হারান তার অমূল্য সম্পদকে, বেদনায় নিস্তব্ধ হয়ে পড়েন। মমতাময়ী মায়ের মায়াভরা মুখটি শেষবারের মতো দেখার জন্য বেদনা আর চাপা কান্না নিয়ে রওনা হলেন টুঙ্গিপাড়ায়। সঙ্গী হলেন দুই মন্ত্রী- খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও তাহের উদ্দিন ঠাকুর। মোশতাক আহমেদ এমনভাবে আবেগতাড়িত হয়ে কাঁদতে লাগলেন, মনে হল যেন তারই কেউ মারা গেছে। কিন্তু জানা গেল তিনি বঙ্গবন্ধুর মায়ের মৃত্যুতে কাঁদছেন। একেবারে মেকি কান্না আর কৌশল, যার মাধ্যমে তিনি বঙ্গবন্ধুর সহানুভূতি, বিশ্বাস আর আনুগত্য অর্জনের চেষ্টা করেছেন। শুধু কেঁদেই মোশতাক ক্ষান্ত হলেন না, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গেলেন টুঙ্গিপাড়ায়, সারা পথ কাঁদলেন। এটা ছিল মোশতাকের চাতুর্যপূর্ণ চরিত্রের একটি বৈশিষ্ট্য আর এই লোক দেখানো কান্নার মাধ্যমে তিনি নিজেকে বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও আপনজন হওয়ার ক‚টকৌশল অবলম্বন করেন। ভেতরে এক আর বাইরে আরেক।
বর্তমান রাজনৈতিক বিশ্লেষণও একই প্রকৃতির। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশপাশে যারা কাজ করছেন তাদের প্রতিটি কর্মকাÐ নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা দেশের স্বার্থেই প্রয়োজন। মনস্তাত্তি¡ক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে পরখ করা দরকার। ডালিমের শাশুড়ি, বউ আর শালী দিনরাত বঙ্গবন্ধুর বাসায় অবস্থান করত। আরেক খুনি নূর চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধকালে শেখ কামালের সঙ্গে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক এমএজি ওসমানীর এডিসি ছিল। বঙ্গবন্ধুই জিয়াউর রহমানকে পদোন্নতি দিয়ে মেজর জেনারেল করেছিলেন আর তার পারিবারিক সমস্যারও সমাধান করে দেন জাতির পিতা। জিয়া নিয়মিত বঙ্গবন্ধুর বাসায় যাতায়াত করতেন। এখানে একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, তা হল আসলে ঘরের শত্রু বিভীষণ। ঘর থেকে শত্রুতা না করলে বাইরের শত্রু সুযোগ পায় না। সে সুযোগটা ঘরের লোকেরাই করে দিয়েছিল। খুব দূরের কোনো মানুষ এরা ছিল না। এরা সম্পর্ক গড়ার মাধ্যমে সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের ছক এঁকেছিল। তাদের ৩২ নম্বরে যাওয়া-আসার মধ্যে কোনো আন্তরিকতা ছিল না, এটা ছিল ষড়যন্ত্রেরই একটি অংশ। মূলত এই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ ও বিদেশি প্রভুদের স্বার্থরক্ষা করার জন্য নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তুললেও বঙ্গবন্ধুকে ত্যাগী নেতাকর্মী ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার অপকৌশল অবলম্বন করে। বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে মোশতাক ছিলেন তার একেবারে ছায়া সহচর। মন ভেজানো কথা বলতেন। প্রখ্যাত সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর একজন প্রকৃত শুভাকাক্সক্ষী ছিলেন, যিনি সরকারের কোনো কাজ পছন্দ না হলে সরাসরি সমালোচনা করতে কিংবা তা নিয়ে পত্রিকায় লিখতে দ্বিধা করতেন না। তার বিশ্লেষণে তিনি বলেছেন, ‘একবার দৈনিক জনপদে আমার একটা লেখায় বঙ্গবন্ধু রেগে গিয়ে আমাকে গণভবনে ডেকে পাঠালেন। গিয়ে দেখি মোশতাক বসে আছে। জনপদের বিরুদ্ধে দু-একটা কথা বললেন মুজিবকে খুশি করার জন্য। আবার এই মোশতাকই বাইরে দেখা হলে আমাকে জড়িয়ে ধরেছেন। মুজিবের কোনো কোনো কাজের সমালোচনা করার জন্য আমার প্রশংসা করেছেন। বিচিত্র এই মোশতাক চরিত্র। মোশতাকের রাজনৈতিক চরিত্রেও স্থিরতা বলে কিছু নেই। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নোমিনেশন না পেয়ে প্রথম হক-ভাসানীর নেতৃত্বের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। আওয়ামী লীগকে যখন অসা¤প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান রূপে পুনর্গঠন করার জন্য মুজিব-ভাসানী একযোগে কাজ করছেন, তখন তিনি আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেন এবং আওয়ামী লীগের ডানপন্থী ও সা¤প্রদায়িক অংশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের চেষ্টা করেন। আইন পরিষদে সরকারি হুইপ হওয়ার লোভে আবার তিনি আওয়ামী পার্লামেন্টারি পার্টির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন এবং কৃষক-শ্রমিক পার্টির সরকারে গিয়ে ঢোকেন। সারা জীবন তিনি প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থী ও সা¤প্রদায়িকতাবাদকে সমর্থন জানিয়েছেন। কিন্তু ব্যক্তিগত সমর্থন লাভের জন্য আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল অংশের সঙ্গে থেকেছেন। প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী তাকে ট্রয়ের ঘোড়ার মতো প্রগতিশীল অংশে ব্যবহার করেছে।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে সুকৌশলে কাজ করেছিলেন মোশতাক। আর এজন্য মাহবুবউল আলম চাষী, তাহের উদ্দিন ঠাকুর প্রমুখকে সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়ই ষড়যন্ত্র করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের অগ্রসরমান গতিপথকে বিচ্যুত করে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গঠন করাই ছিল এই চক্রের উদ্দেশ্য। এর পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার পরম হিতৈষী শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরিয়ে বঙ্গবন্ধুকে আপনজন থেকে বিচ্ছিন্ন করার কৌশল গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ যখন পূর্ণাঙ্গ রূপ নিতে চলেছে, তখন মোশতাক গ্রæপ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একটি প্রচারপত্র বিলি করে। প্রচারপত্রটির শিরোনাম ছিল- ইনডিপেনডেন্স অর মুজিব? মুজিব না স্বাধীনতা? এটা মূলত মুক্তিযোদ্ধাদের বিভ্রান্ত করে মুক্তিযুদ্ধকে থামিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা ছিল। এর মূল বক্তব্য ছিল : আমরা যদি পাকিস্তানের সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধ করি, তাহলে পাকিস্তানিরা কারাগারে মুজিবকে হত্যা করবে। শেখ মুজিব ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যাবে। সুতরাং স্বাধীনতার আগে মুজিবের মুক্তি দরকার এবং মুক্তির পর পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা দরকার। এই প্রচারপত্রের মাধ্যমে মোশতাক দুমুখো সাপের মতো একসঙ্গে দুই শিকার করতে চেয়েছিলেন। একদিকে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা, অন্যদিকে ‘তাজউদ্দীন চাইছেন না মুজিবের মুক্তি হোক’ এ কথা অপকৌশলের অংশ হিসেবে প্রচার করা। বঙ্গবন্ধুর মায়ের মৃত্যুতে যিনি মায়াকান্না কেঁদে চাতুরীর আশ্রয় নিয়েছিলেন, তার মাত্র এক বছরের ব্যবধানে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের নৃশংস হত্যাকাÐে উল্লাস প্রকাশ করে সেই বিশ্বাসঘাতক মোশতাক ‘সূর্য সন্তান’ বলে হত্যাকারীদের আখ্যায়িত করলেন আর এই বর্বরতাকে বর্ণনা করলেন ‘ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা’ বলে। একটি প্রশ্ন তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে। তা হল, বঙ্গবন্ধু কেন বারবার মোশতাককে ক্ষমা করেছেন? কেবল মোশতাককে না, আরও অনেককেই তিনি ক্ষমা করেছেন। এটাই হল বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, অনেকেই তাকে সাবধান করেছিলেন। এ রকম একটা ঘটনা ঘটতে পারে, তিনি বিশ্বাসই করেননি। আব্বা বলতেন, ওরা তো আমার ছেলের মতো, আমাকে কে মারবে? দেশের জনগণের ওপর বিশ্বাস থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কখনও হত্যাকাÐের শিকার হওয়ার কথা ভাবতে পারেননি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসররাই জাতির জনককে হত্যা করেছিল। তবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আর দর্শনের হত্যাকাÐ ঘটানো যায়নি, কখনও যাবে না।
লেখক: শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক