১৪ মাসে ৪ শীর্ষ হেফাজত নেতার মৃত্যু

20

মাত্র ১৪ মাসেই সারাদেশে আলোচিত হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের ৪ আমির ও মহাসচিবের মৃত্যুতে কওমী অঙ্গণে যেনো শূণ্যতা বিরাজ করছে। ২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের ২৯ নভেম্বর- মাত্র এক বছর দুই মাসের মধ্যে অরাজনৈতিক সংগঠন দাবিদার হেফাজতে ইসলামের চার শীর্ষ আলেম মৃত্যুবরণ করায় এই শূণ্যতার সৃষ্টি বলে জানিয়েছেন কওমীসংশ্লিষ্ট নেতারা।
গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফি’র মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কওমী অঙ্গণে শোকের ছায়া নামে। প্রায় ১০৩ বছর বয়সে মারা যান বলে দাবি করেন তাঁর অনুসারিরা। মাদ্রাসা শিক্ষায় আমূল সংস্কার সাধনসহ কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতি আদায়ে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য। যদিও পরবর্তী সময়ে আল্লামা আহমদ শফি’র নেতৃত্বে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘শোকরানা মাহ্ফিল’ এ প্রধানমন্ত্রীকে ‘কওমি জননী’ উপাধি দেয়াকে কেন্দ্র করে হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে।
গত বছরের ১৫ নভেম্বর বয়োজ্যেষ্ঠ আলেম আল্লামা শফির মৃত্যুর পর হেফাজতে ইসলামের কাউন্সিলে প্রাক্তন মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীকে সংগঠনটির নতুন আমির এবং ঢাকার জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা মাদ্রাসার মহাপরিচালক আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমীকে মহাসচিব নির্বাচিত করার এক মাসের মাথায় ১৩ ডিসেম্বর তিনিও (কাসেমী) না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। এরপর ২৬ ডিসেম্বর সংগঠনটির মহাসচিব নির্বাচিত হন ঢাকার খিলগাঁও আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া মাখজানুল উলুম মাদ্রাসার মহাপরিচালক মাওলানা নুরুল ইসলাম জিহাদী।
এদিকে, হেফাজতে শুরু হওয়া শূন্যতা ও সৃষ্ট অপূরণীয় ক্ষত মুছতে যোগ্য নেতৃত্বের সংকটের এমন নাজুক মুহুর্তে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী যখন সংগঠটিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলের তখন তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে, বাবুনগরীর নেতৃত্বাধীন কমিটিতে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক আলেমরা প্রাধান্য পান। মূলত তাদের কারণে হেফাজত ধীরে ধীরে সরকারবিরোধী অবস্থানে চলে যায় এবং মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে চলতি বছরের মার্চের ২৫, ২৬ ও ২৭ তারিখ দেশজুড়ে ব্যাপক সহিংসতা ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ১৭ জন মারা যান। এসব ঘটনায় দায়ের করা মামলায় হেফাজতের অর্ধশতাধিক নেতা গ্রেপ্তার হন। তাদের অনেকেই এখনও কারাগারে রয়েছেন।
প্রচন্ড চাপের মুখে ২৫ এপ্রিল কমিটি বিলুপ্ত করে একটি আহব্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে হেফাজত। গত ৭ জুন ৩৩ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। তবে সেই কমিটিতে জায়গা পাননি রাজনৈতিক নেতা এবং বিতর্কিতরা। এরমধ্যে চলতি বছরের ১৯ আগস্ট হেফাজতের সাবেক আমির আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর হেফাজতের আমির হন তাঁরই মামা চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির বাবুনগর মাদ্রাসার পরিচালক আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী। তার বয়স নব্বইয়ের বেশি। আমির হওয়ার পর দুইবার তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। তবে বর্তমানে তিনি অনেকটা সুস্থ।
এরমধ্যে গতকাল সোমবার সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা নুরুল ইসলাম জিহাদী। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর। বিষয়টি নিশ্চিত করে হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা মীর ইদ্রিস বলেন, হুজুর ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর শূন্যতা কখনও পূরণ করার নয়। একে একে এতিম করে গত এক বছরে হেফাজতে ইসলামের দুই কেন্দ্রীয় আমির ও দুই মহাসচিব আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।
হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক ও হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির আল্লামা মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া বলেন, সংগঠনটির নেতৃবৃন্দের মাঝে অপূরণীয় ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। প্রয়াতরা কওমি অঙ্গণের হাল ধরেছিলেন যখন পারস্পরিক অনৈক্য, অনাস্থা ও বিভেদের জেরে দেশের মাদ্রাসা শিক্ষায় বিপর্যয় নেমে এসেছিল। তারা জীবদ্দশায় দেশের কওমী অঙ্গণের ধর্মপ্রাণ হতাশাগ্রস্ত মানুষকে এক কাতারে নিয়ে এসেছিলেন।
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হেফাজতে ইসলাম প্রথমবারের মতো ব্যাপক আলোচনায় আসে ২০১৩ সালে। এছাড়া ২০১১ সালে নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে ‘নারী উন্নয়ন নীতিমালা’ ঘোষিত হওয়ার পরপরই সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে সংগঠনটি। পাশাপাশি দেশে ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবিতে তারা ১৩ দফা উত্থাপন করে। দাবিগুলোর বেশ কয়েকটি ধারা বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ১৩ দফা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে প্রথমে সংগঠনটি ২০১৩ সালের ৫ এপ্রিল ঢাকা অবরোধ ও ৫ মে শাপলা চত্বরে সমাবেশ ডাকে।