১ম মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মরণ একাত্তরের মহীয়সী জননী শহিদ জায়া মুশতারী শফি

36

রশীদ এনাম

ছোটোবেলায় বাবা আদর করে নাম রেখেছিলেন-উম্মে কুলসুম মুশতারী বেগম ওরফে ডলি। তিনি ১৯৩৮ সালে ১৫ জানুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মালদহ জেলার কালিয়াচক থানায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার আদি নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলায়। পিতা খন্দকার নজমুল হক আনসারী, মাতা আরেফা খাতুন। বাবা ছিলেন ডেপুটি পুলিশ সুপার। বাবার চাকরির সুবাদে কলকতায় বসবাস করতেন। মাত্র তিনমাস বয়সে ছোটো ডলি মাকে হারান। বাবাও ১২ বছর বয়সে না ফেরার দেশে চলে যান। শিশুকাল থেকে শুরু হয় মুশতারীর জীবনসংগ্রাম। কত চড়াই- উতরাই পারি দিতে হয়েছে তাঁকে। তাঁর জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে ছিল বিষাদ আর সংগ্রাম ।
১৯৫৫ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে দন্ত বিশেষজ্ঞ ডাক্তার শফির সাথে মুশতারী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের পর থেকে পরিচিত হন মুশতারী শফি নামে। কিশোরী বয়সে বিয়ে করলেও পড়ালেখা ইতি টানেননি। ডাক্তার শফি গৃহশিক্ষক রেখে পড়ালেখা শিখিয়েছেন জীবনসঙ্গিনীকে। ছোটোবেলা থেকে ছিলেন সংস্কৃতিমনা, উচ্চাঙ্গ সংগীত, গিটার বাজাতে পারতেন বেশ ভালো। মুশতারী শফির সর্বশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল ঢাকার কামরুন্নেসা গার্লস হাইস্কুল। বাস্তব জীবনের জাঁতাকলে পড়ে লেখাপড়া অনেকটা বন্ধ হয়ে যায়। প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষা না থাকলেও প্রকৃতিগতভাবে মুশতারী শফি ছিলেন তুখোড় মেধাবী মহীয়সী নারী। প্রচুর বই পড়তেন, মাত্র ১১ বছর বয়স থেকে লেখালেখি শুরু করেন। দৈনিক আজাদী পত্রিকায় ছোটোদের আসর ‘মুকুলের মাহফিল’ এ ছোটোগল্প লেখার মধ্য দিয়ে লেখালেখি ও সাহিত্যজগতে বিচরণ। ১৯৬৪ সালে চট্টগ্রামে নারীমুক্তি আন্দোলনের লক্ষ্যে তাঁর উদ্যোগে বান্ধবী সংঘ গঠন করা হয়। এটি ছিল চট্টগ্রামে নারীদের প্রথম সংগঠন। বলা যায় তিনি ছিলেন সে সময়ে নারীদের অগ্রপ্রতিক এক জিয়নকাঠি। চট্টগ্রাম থেকে ‘বান্ধবী’ নামে একটি পত্রিকা বের করতেন। ১৯৬৯ সালে ‘মেয়েদের প্রেস’ নামে একটি ছাপাখানাও চালু করেছিলেন।
১৯৭১ সালে যখন যুদ্ধ শুরু হয় তখন বান্ধবী পত্রিকায় প্রচ্ছদ ছাপা হয় দেশের মানচিত্র তার উপর বেয়নেটের আঘাতের ছবি। এই ছবি দিয়ে তিনি প্রতিবাদ করে বুঝিয়েছিলেন যে, এখন আর ঘরে বসে থাকার সময় নেই। দেশরক্ষায় সবাইকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে। সে সময় পাকবাহিনী ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেন ‘মেয়েদের প্রেস’।
১৯৭১ সালে চট্টগ্রামের এনায়েত বাজারে ‘মুশতারী লজ’ ছিল মুক্তিবাহিনীর নিরাপদ স্থল । মুক্তিবাহিনীর অস্ত্র গোলাবারুদ মুশতারী লজে লুকিয়ে রাখতেন। এটাই মুশতারী শফির পরিবারের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৭১ সালে ৭ এপ্রিল মুশতারী পরিবারের জন্য ছিল ভয়াবহ দিন। সেদিন রাতে পাকিস্তানিরা ডাক্তার শফি ও মুশতারীর ছোটো ভাই এহসানুল হক আনসারীকে ধরে নিয়ে যায়। সেদিন অলৌকিকভাবে বেঁচে যান মুশতারী শফি। তাঁদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। স্বামী, ভাইহারা শহিদ জায়া মুশতারী শফি তাঁর ফুলের মতো ছোটো মাসুম সাত সন্তানকে নিয়ে ত্রিপুরার আগরতলা চলে যান। সেখানে গিয়ে তিনি পিছপা হননি মা মাটি মাতৃভূমির টানে প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ নিয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা শুরু করেন। ছোটোবেলা থেকে পিতামাতা হারা এতিম এবং একাত্তরের স্বামী ও ভাইহারা জননী ধৈর্যের সাথে তিলে তিলে এক সময় মাথা উঁচু করে দাঁড়ান। চাট্টিখানি কথা নয় নিজেই তিন ছেলে ও চার মেয়েকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেন। বলা যায় তিনি শুধু একাত্তরের জননী নন একজন রতœগর্ভা মাও বটে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে শব্দসৈনিক হিসেবে নিরলসভাবে কাজ করেছেন। সন্তানদেরকে কখনো পিতার অভাব বোধ করতে দেননি। শহিদ জায়া মুশতারী শফি সন্তানদের কাছে ছিলেন কখনো বটবৃক্ষ কখনো পিতা ও মাতা উভয়।
মুশতারী শফি শহিদ রুমীর মা জাহানারা ইমামের সহযোদ্ধা ছিলেন। শহিদ জননী জাহানারা ইমাম মারা যাওয়ার পর শহিদ জায়া মুশতারী শফিকে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহŸায়ক করা হয়। তিনি উদীচীর চট্টগ্রামে সভাপতি ছিলেন। চট্টগ্রামে একজন আদর্শ নারী নেত্রীর মডেল হিসেবেও কাজ করেছেন। চট্টগ্রামের মানুষের কাছে তিনি কখনো ছিলেন শহিদ জায়া কখনো সাহিত্যিক কখনো শব্দশৈলী হিসেবে। আমার কাছে ছিলেন তিনি একজন শ্রেষ্ঠ মা, একাত্তরের এক জীবন্ত দলিল যিনি কি না মা মাটি মাতৃভূমিকে নিজ সন্তানের মতো হৃদয় উজাড় করে অনন্তকাল ভালোবেসে গেছেন। বুকে আগলে রেখেছেন একাত্তরের স্মৃতিকে। মনের মাধুরী মিশিয়ে রচনা করেছেন, ‘দুটি নারী ও একটি মুক্তিযুদ্ধ’, ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প ও একুশের গল্প’, ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামে নারী’, ‘চিঠি জাহানারা ইমামকে’, ‘স্বাধীনতা আমার রক্ত ঝরা দিন’ ইত্যাদি গ্রন্থ। তাঁর প্রত্যেকটি বই একাত্তরের এক একটা প্রামাণ্য দলিল।
২০১৬ সালে শহিদ জায়া মুশতারী শফীকে বাংলা একাডেমি কর্তৃক ফেলোশিপ দেওয়া হয় এবং ২০২০ সালে তাঁকে রোকেয়া পদক দেওয়া হয়। এছাড়াও তিনি অনন্যা সাহিত্য পুরস্কারও পেয়েছেন। আমার লেখা একাত্তরের শহিদ ছবুর গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছিলেন, বইটি প্রকাশের মাধ্যমে
দেশবাসী জানতে পারছে শহিদ ছবুরের বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়া থানার শেয়ানপাড়া গ্রামের নাম। সেই সাথে আজ জানছে শেয়ানপাড়া গাজী বাড়িসংলগ্ন শহিদ আবদুস ছবুর পাঠাগারটির কথা, যেটি পরবর্তীতে বন্ধ করে দিয়েছিল তাঁরই গ্রামেরই লোকজন। কিন্তু সত্য থাকে চিরদিন অমলিন। আজ একাত্তরের প্রজন্ম লেখক রশীদ এনাম তুলে এনেছেন শহিদ আবদুস ছবুরকে। উঠে এসেছে মুক্তিযোদ্ধা শহিদ আবদুস ছবুর স্মৃতি পাঠাগার ও শহিদ আবদুস ছবুর স্মৃতি ট্রাস্টের কথা এবং এই শেয়ানপাড়া গ্রামেই শহিদ ছবুরের নামে একটি ইশকুল বা কলেজ ও স্মৃতি স্তম্ভ প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। এভাবেই তাঁর স্মৃতি ও কর্মকাÐ প্রজন্মের পর প্রজন্মের মাঝে বেঁচে থাকবে। তবে তাঁর কবর যেখানে আছে তা আরো সুন্দর সুসংহত করে যাতায়াতের সুব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানাই”।
(বেগম মুশতারী শফি)
২৫/১২/২০১৫
‘মুশতারী লজ’
মুশতারী আন্টির ছেলে মেহরাজ ভাইয়ের সাথে একদিন ফোনে কথা হলো । তিনি বললেন মা অসুস্থ। শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। ইস খুব ইচ্ছা করছিল আন্টিকে গিয়ে একবার দেখে আসি। ব্যস্ততার কারণে যাওয়া হয়নি। গত ২০ ডিসেম্বর ২০২১ সালে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন একাত্তরের জননী শহিদ জায়া মুশতারী আন্টি। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে মসজিদে নামাজে জানাজা পড়ার জন্য ছুটে গেলাম । মেহরাজ শফি ভাই, রুমানা আপা, তারানা আপারা অঝোরে কাঁদছেন। মুশতারী আন্টি যেদিন না ফেরার দেশে চলে গেলেন, সেদিন তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে ফিরে গেলাম ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের মসজিদ প্রাঙ্গণে। আন্টির কফিন ফুলে ফুলে ঢাকা। আন্টির নামাজে জানাজা পড়লাম। মসজিদের বাহিরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন তাঁর স্বজনরা।
তারানা আপা মুঠোফোন বের করে কেঁদে কেঁদে বললেন, আমার মায়ের শেষ একটা লেখা পেয়েছি। সেটা তিনি মুশতারী আন্টির কফিনবাহী গাড়ির সামনে পড়ে শোনালেন। লেখাটা ছিল অনেকটা শপথ বাক্যের মতো “ এখন প্রতিবাদ চাই। প্রতিরোধ চাই। চাই রাজনৈতিক আদর্শিক সংগ্রাম। যারা ১৯৭১ এ নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছে এবং নৃশংসভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে সে খুনিদের সাথে কোনো আপস হতে পারে না। এবার বুদ্ধিজীবী দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক। অতীতের সব ত্রুটিবিচ্যুতি ঝেড়ে ফেলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দেশে প্রতিষ্ঠিত হোক”। শহিদ জায়া মুশতারী আন্টির জীবনের শেষ লেখাটিতে ছিল একাত্তরের চেতনা এবং প্রতিবাদ। জোহরের নামাজের পর জানাজা শেষে মুশতারী আন্টিকে যখন চির বিদায় দিলাম, তখন মনে হচ্ছিল আমার মাকে যেন আমি বিদায় দিলাম। খুব কাছের কাউকে বিদায় দিলাম। হু হু করে মন কেঁদে উঠল, খুব কষ্ট লাগছে, আহা আর কখনো মুশতারী আন্টিকে ফোন করা হবে না, আন্টির ফোনের রিং টোন বাজবে না, ওপার থেকে মায়া দিয়ে দরদ দিয়ে বুকভরা ভালোবাসামাখা আদুরে কণ্ঠে কেউ বলবে না, “রশীদ এনাম বাবা তুমি কেমন আছ, চট্টগ্রামে আসলে বাসায় এসো। লেখালেখি কেমন চলছে তোমার”? লিখাটা লিখতে বসে চোখের জল গড়িয়ে পড়ল। লিখতে পারছি না আমার অশ্রæমাখা ভালোবাসা বিন¤্র শ্রদ্ধা শুধু একাত্তরের জননী শহিদ জায়া মুশতারী আন্টির জন্য। মুশতারী আন্টি নেই, বিশ^াস হয় না। আমার কাছে মনে হয় আন্টি বেঁচে আছেন মুশতারী লজে বসে বসে লিখছেন। মুশতারী আন্টিরা কখনো মরে না। শহিদ জায়ারা যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে। মুশতারী আন্টির চলে যাওয়া গত এক বছর পূর্ণ হলো। মুশতারী আন্টি সেদিন উৎসাহ দিয়ে আমার প্রথম রচনা শহিদ ছবুর বইয়ের পাÐুলিপি দেখে না দিলে হয়তো আমি বই প্রকাশ করতাম না। আজ চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, জানি না আমার প্রিয় মুশতারী আন্টি শুনতে পাচ্ছে কি না। আন্টি আমার লেখা “একাত্তরের শহিদ ছবুর” বইটি আজ একটি জীবন্ত ইতিহাস। যে বইয়ে আপনি যতœ করে ভূমিকা লিখেছিলেন, আপনি জেনে আনন্দিত হবেন। বইটির কারণে দীর্ঘ ৫১ বছর পর এসে শহিদ ছবুরের নাম মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে গেজেটভুক্ত হয়েছে। চলতি বছর থেকে শহিদ ছবুর পরিবার শহিদ ভাতা পেতে যাচ্ছে।
মুশতারী আন্টির মৃত্যুবার্ষিকীতে মহান আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করি, হে মওলা আপনি আমাদের মুশতারী আন্টিকে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করুন, জান্নাতের বাগানের ফুল ফুটিয়ে রাখুন- আমিন।
লেখক : প্রাবন্ধিক