হয় ‘মান্থলি’, না হয় হয়রানি

65

নিজস্ব প্রতিবেদক

গাড়ির সব কাগজপত্র ঠিক রয়েছে। আবার রয়েছে একজন ট্রাফিক কর্মকর্তার সাথে মাসোহারার (মান্থলি) অলিখিত চুক্তিও। এরপরও যখন তখন ট্রাফিক কনস্টেবল গাড়ি দাঁড় করিয়ে চালকের কাছ থেকে চান টাকা। অন্যথা হলে শাস্তির খড়গ (যেকোনো কারণ দেখিয়ে জরিমানা) নেমে আসে গাড়ির মালিকের উপর। এভাবে চট্টগ্রাম মহানগরী ও জেলায় ট্রাক, মিনিট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও প্রাইমমুভার চালকদের সাথে হয়রানির ঘটনা হারহামেশাই ঘটে চলেছে বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। এতে চালক-মালিকদের মাঝে ক্ষোভ বাড়ছে। তবে ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বলেন, টাকা উত্তোলন বা মান্থলির বিষয়টি প্রমাণিত হলেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
গতকাল রোববার নগরীর পাহাড়তলী, বন্দর, ইপিজেড থানার কয়েকটি এলাকায় সরেজমিনে অবস্থান করে চালক-মালিকদের সাথে কথা বললে নানা তথ্য উঠে আসে।
শুধুমাত্র নগরীর বন্দর জোনের চার কিলোমিটার এলাকার মধ্যে পাঁচটি বিশেষ স্থানে ট্রাফিক সার্জেন্টকে গাড়িপ্রতি এক হাজার টাকা করে দিতে হয়। এলাকাগুলো হল- পোর্ট কলোনির মুখে ২০০ টাকা, ইছহাক ডিপোতে (টোলের আগে) ২০০ টাকা, এনসিটি (নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল) গেটে ২০০ টাকা, সিপিএআর গেটে (কাস্টমস ওভারব্রিজের নিচে) ২০০ টাকা ও সল্টগোলা ক্রসিংয়ে ২০০ টাকা। টাকাগুলো সরাসরি কনস্টেবলই সংগ্রহ করে বলে জানা গেছে। আর টাকা না দিলে গাড়ি সাইড করিয়ে নানাভাবে হয়রানি করতে থাকেন ট্রাফিক সদস্যরা। শুধু মামলা বা টাকা নিয়েই ক্ষান্ত নয়, গাড়ি টো করে ড্যাম্পিংয়ে প্রেরণের মত ঘটনাও ঘটছে প্রতিনিয়ত। এখানে বন্দর থেকে সিট কয়েলের গাড়ি ও অন্য জেলা থেকে আসা খোলা ট্রাক হতে এ টাকা আরও বেশি আদায় হয়ে থাকে। মান্থলি ছাড়া প্রতিদিন যদি ২০০ গাড়ি পণ্য পরিবহনের কাজে প্রবেশ করে তাহলে দৈনিক তোলা হয় ২ লাখ টাকা। যা মাসে ৬০ লাখ ও বছরে ৭ কোটি ২০ লাখ টাকায় গিয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং, অবৈধভাবে উত্তোলিত এ টাকা যায় কোথায়? প্রশ্ন পরিবহন সংশ্লিষ্টদের ।
পণ্য পরিবহন নেতারা বলছেন, আমরা এ থেকে পরিত্রাণ চাই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিমতলা বিশ্বরোড এলাকার এক চালক বলেন, ‘আমার গাড়ির কাগজপত্র, নিজের লাইসেন্স এবং টিআইয়ের সাথে মান্থলি (মাসোহারা) করা আছে। আজ (রোববার) সকালে সাগরিকা মোড়ে সার্জেন্ট আমার গাড়ি সিগন্যাল দেন। গাড়ি থামালে কাগজপত্র দেখাতে বলেন তিনি। আমি সব কাগজপত্র দেখাই। সার্জেন্ট জিজ্ঞেস করেন, কার সাথে মান্থলি করা আছে? আমি নাম বললাম এবং ফোনে ধরিয়ে দিলাম। তারপর বলেন ১০০০ টাকা দেন। না হলে রং পার্কিংয়ের মামলা দিবো। আমি বাধ্য হয়ে ৫০০ টাকা দিয়ে চলে আসি। সবকিছু ঠিক থাকার পরও আমাদেরকে প্রতিনিয়ত ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা হয়রানি করেন। কাকে অভিযোগ দিবো? অভিযোগ দিলে পরদিন আবারও হয়রানির শিকার হতে হয়।’
চট্টগ্রাম জেলা ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের তথ্যমতে, নগরী ও জেলা মিলিয়ে পণ্য পরিবহনের কাজে নিয়োজিত রয়েছে প্রায় এক লাখের মত ট্রাক, মিনিট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও প্রাইমমুভার। এসবের মধ্যে ৫০ হাজারের মত পরিবহন জেলা সড়কে চলাচল করলেও বাকিগুলো মহানগরের শিল্প কারখানা ও বন্দরের পণ্য পরিবহন করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলাচলরত যেসব খোলা ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান রয়েছে সেগুলোতে পণ্য পরিবহনে এক হাজার টাকা আর প্রাইমমুভারে পরিবহন করলে দুই হাজার টাকায় টিআই’র সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে হবে। এছাড়া পণ্য নিয়ে জেলায় গেলে সংশ্লিষ্ট এলাকার টিআইয়ের সাথে ৫০০-৭০০ টাকার মধ্যে চুক্তিবদ্ধ হতে হবে। না হলে তাৎক্ষণিক ১০০ থেকে ৫০০ টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে চালিয়ে নিতে হবে। অন্যথায় নানা অজুহাতে গাড়ি নিতে দিবেন না ট্রাফিক সদস্যরা।
কাভার্ড ভ্যানের মালিক মো. শরফুদ্দিন পূর্বদেশকে বলেন, টিআইয়ের সাথে মান্থলি করাটা এখন নিত্ত-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। নতুন গাড়ি বিআরটিএ থেকে অনুমোদন নিয়ে সব আপ টু ডেট করার পরও যদি রাস্তায় নামান তবে আপনাকে কোনো না কোনো টিআই বা সার্জেন্ট দাঁড় করিয়ে মান্থলি করা আছে কি না জানতে চাইবে। যদি মান্থলি করা থাকে তবে ৫০০-১০০০ টাকা চাইবেন। আর যদি না থাকে তবে তিনি নিজেই মান্থলি করার প্রস্তাব দিবেন। টাকা নেয়া আর মান্থলি করা যেন একটা নিয়মে দাঁড়িয়েছে।
তিনি আরও বলেন, একটি ট্রাকের পেছনে প্রতিমাসে ২৫ থেকে ২৬ হাজার টাকা খরচ আছে। মিস্ত্রি ও গ্যারেজ ভাড়া দেড় হাজার টাকা, দারোয়ান তিন হাজার টাকা, টিআইকে দিতে হয় এক হাজার টাকা, গাড়ির কাগজপত্র আপডেট করাতে প্রতিবছর ৭২ হাজার টাকা খরচ হলে মাসে ৬ হাজার টাকায় দাঁড়ায়, ড্রাইভার-হেলপারকে ১২ হাজার টাকা বেতন এবং ব্যাটারি-লুব্রিকেন্টে ২ হাজার টাকা। এভাবে ২৫ হাজার ৫০০ টাকা চলে যায়। প্রতিমাসে সবগুলো মিলিয়ে আয় হয় ৩০ থেকে ৩২ হাজার টাকা। এর মধ্যে যদি আমাদের গাড়ি মাসে এক-দুইবার মামলা আর জব্দ হয়, তাহলে আমরা কীভাবে চলব?
চট্টগ্রাম বন্দর ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক ও কন্ট্রাক্টর এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হাজী জহুর আহমেদ বলেন, নগরীতে পুলিশের সাথে ম্যানেজ করে গাড়ি চালাতে হয়। তাছাড়া অন্যভাবে গাড়ি চলাচলের সুযোগ নেই।
বাংলাদেশ ট্রাক-প্রাইমমুভার কাভার্ড ভ্যান পণ্য পরিবহন সমন্বয় পরিষদের সদস্য সচিব মো. তাজুল ইসলাম বলেন, আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে দাবি জানানোর পরও চট্টগ্রামে পণ্য পরিবহনে হয়রানি কমেনি। মান্থলির নামে ট্রাফিকের যে হয়রানি চলছিল, তা এখনও আছে। আমরা এর থেকে পরিত্রাণ চাই।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) শ্যামল কুমার নাথ পূর্বদেশকে বলেন, ট্রাফিক সদস্যদের মান্থলির বিষয়টি আমি অবগত নই। যদি ট্রাফিকের কোনো সদস্য এধরনের কাজে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া চালক-মালিকদের প্রতি অনুরোধ, আপনাদের কোনো সমস্যা থাকলে সরাসরি আমাদের জানান। আমরা অভিযোগের প্রেক্ষিতে ন্যায়সঙ্গত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।