হেমন্ত মুখোপাধ্যায় : কণ্ঠে যাঁর চিরবসন্ত

6

পূর্বদেশ ডেস্ক

এত নতুন গায়ক, এত নতুন ধাঁচের গীতরচনা ও সুর, কিন্তু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠ এখনও অদ্বিতীয়। তাঁর কণ্ঠে চিরবসন্ত। প্রয়াণ দিবসের আবহে কথাটা ভাবতে গেলে মনে হয়, ওস্তাদি কারুকাজ বা ওজোগুণ নয়, আসলে তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল কতগুলো আপাতবিরোধী উপাদানের বিরল সমাবেশ। একদিকে ঘনীভূত অন্তর্মুখী বিষাদ ও নিরাসক্তি, সূক্ষ সানুনাসিকতার আভাসে যা পেত এক চাপা অভিমানের সুর। অন্যদিকে, এই নিরাসক্তি তারুণ্যে ভরপুর, দৈনন্দিনতার ক্লান্তিতে ভারাক্রান্ত নয়। এ যেন এক চিরন্তন তরুণ বিবাগি। মুক্ত উদাত্ত প্রসারিত কণ্ঠ, আর একটা ঝোঁক তাঁকে ঠেলে দিতো বিপরীতে, অন্তর্মুখী রহস্যে।
উপমহাদেশের এই কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী, সুরস্রষ্টা ১৯৮৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। জন্মেছিলেন ভারতের বেনারসে ১৯২০ সালের ১৬ জুন মামাবাড়িতে। আদি নিবাস দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার জয়নগরে। কখনও ওস্তাদের কাছে গান শিখেননি হেমন্ত। অন্যের মুখে কিংবা রেডিওতে গান শুনে গান তুলে নিতেন গলায়। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাকে রেডিওতে নিয়ে গিয়েছিলেন। শৈলেশ দাসগুপ্ত’র সহায়তায় ১৯৩৫ সালে ১৪ বছর বয়সে রেডিওতে প্রথম গান গেয়েছিলেন তিনি।
নরেশ ভট্টাচার্যের লেখা ও শৈলেশ দাসগুপ্তর সুরে ‘জানিতে যদি গো তুমি’ ও ‘বলো গো বলো মোরে’ গান করেন। এই দুটি গান প্রথম জীবনে তাকে পরিচিতি দিয়েছিল। মাঝে কিছুদিন তার সাহিত্যিক হওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল। কিছুদিন তিনি দেশ পত্রিকায় লেখেন। ১৯৪০ সালে সংগীত পরিচালক কমল দাসগুপ্ত তাকে দিয়ে ‘কিতনা দুখ ভুলায়া তুমনে’ ও ‘ও প্রীত নিভানেভালি’ শিরোনামের হিন্দি গান করান। তিনি প্রথম সিনেমার গান গেয়েছেন ‘নিমাই সন্ন্যাস’-এ। ১৯৪৭ সালে ‘অভিযাত্রী’ চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে। এরপর ‘শাপমোচন’, ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘হারানো সুর’সহ অনেক বিখ্যাত ছবির সংগীত পরিচালনা করেন তিনি।
সুরের জাদুকর হেমন্ত মুখোপাধ্যায় অসংখ্য কালজয়ী গান শ্রোতাদের উপহার দিয়েছেন। তাঁর কণ্ঠের আধুনিক বাংলা গান আজও গেঁথে আছে বাঙালির হৃদয়ে। আধুনিক বাংলা গানের প্রবাদ পুরুষ হয়ে বেঁচে আছেন তিনি। তাঁর কণ্ঠে শ্রোতাপ্রিয় গানের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- ‘তুমি এলে অনেক দিনের পরে যেন বৃষ্টি এলো’, ‘কেন দূরে থাকো শুধু আড়াল রাখো’, ‘পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব মাগো’, ‘ও নদীরে’, ‘আয় খুকু আয়’, ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে’ এবং ‘ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলো না’।
এই তালিকায় আরও আছে- ‘আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি’, ‘এই রাত তোমার আমার’, ‘মেঘ কালো আঁধার কালো’, ‘রানার’, ‘এক গোছা রজনীগন্ধা হাতে দিয়ে বললাম’, ‘শোনো বন্ধু শোনো’, ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে’ এবং ‘আমিও পথের মতো হারিয়ে যাবো’।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে আমরা মুগ্ধ হই, বিস্মিত হই। তাঁর কণ্ঠের অসম্ভবের অনুপাতে সবসময় মিশে থাকতো সূ² ভারসাম্য ধরে রাখার আকুতি, সেটাই ছিল তাঁর সম্মোহনী আকর্ষণ।