হেমন্ত এখন এক লজ্জাবতী ঋতু

21

পূর্বদেশ ডেস্ক

বাংলার ছয় ঋতুর তালিকায় নামটি বেশ জ্বলজ্বল করে-শরতের পরে আর শীতের আগে। সে এক ঋতু ছিল আমাদের, হেমন্ত নাম তার। আর সে ছিল বড় কোমল, স্বপ্নীল, ফলবতী। কিন্তু ‘ছিল’ বলছি কেন? কারণ সে কেবল প্রত্নস্মৃতি, বাস্তবে এখন দূর অতীত, ব্যবহারিকতায় মূল্যহীন। তাই সে যেন আজ সেই কাজির গরু, গোয়ালে যার অস্তিত্ব নেই, আছে কেবল কাগজেই।
শরৎ তবু পূজা পায় বটে, দুর্গাদেবীর কল্যাণে; দ্রুতগামী পেজা মেঘ ও জলে তার চলৎছায়া আর কাশের শুভ্রতায়, কিন্তু হেমন্ত আজ পায় না কিছুই। অথচ কী ছিল তার দান, অঘ্রানের ঘ্রাণ কী বিপুল ছিল আমাদের জীবনে!
হেমন্ত এক আশ্চর্য ঋতু-মৃত্যু ও জীবনের, দুর্ভাগ্য ও সৌভাগ্যের, হতাশা ও আশার দুই বিপরীতের এক সুতী যুগলবন্দি। একদিকে এ ঋতুর শুরুতে মরা কার্তিক, আবার শেষে অগ্রহায়নে ধানের প্রাচুর্য, নতুন ধান, তাই নবান্ন। এভাবে নানা বৈপরীত্যের মিশেল এই ঋতু হেমন্ত।
একদা কত কিছুই না সে দিয়ে গেছে আমাদের-যে ভাত খেয়ে আমরা বাঁচি, যে ধানের দানে বাঙালির প্রাণরস প্রবহমান, তার প্রধান অংশটিই একসময় আসতো এই হেমন্তে। তার জীবনদায়ী ঘ্রাণে বাংলার গ্রামজীবনের ঘরে ঘরে জীবনের উৎসব লেগে যেত অগ্রহায়ণ মাসে। এসব কথা ভেবেই সম্রাট আকবর বৈশাখের বদলে প্রথমে অগ্রহায়ণ মাসকেই ঋতুর প্রথম মাস করতে চেয়েছিলেন। এর অর্থটাও তাই তাৎপর্যপূর্ণ: অগ্রে বা আগে যে আসে, তা-ই অগ্রহায়ণ। তবে অর্থ যা-ই হোক, এখন এটি বছরের অষ্টম মাস। আর আসেও অনাড়ম্বরভাবে, চলেও যায় বেশ গোপনে। কারণ যে আমন ধান ছিল বাঙালির প্রধান খাদ্য, সময়ের প্রয়োজনে তার জায়গা দখল করেছে উচ্চফলনশীল ইরি ধান। আজকের শহুরে মানুষ নয় কেবল, গ্রামের মানুষও ঋতুর আসা-যাওয়ার হিসাব ভুলে গেছে প্রায়।
বাংলা সাহিত্যে হেমন্তের চেহারা নিবিড়ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন কবি জীবনানন্দ দাশ। এর বাইরে বড় আকারে নাম আসে কেবল রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের। কবি জীবনানন্দের কবিতার দার্শনিকতা-নৈসর্গিকতা-মনোময়তা সবকিছুর ভেতরেই যেন হেমন্ত ও শীতের রাজত্ব। সেজন্য অনেকেই তাঁকে ‘হেমন্তের কবি’ বলেন। হেমন্তকে তিনি তুলে আনেন এর আত্মা ও ঘ্রাণসমেত।
‘শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে
অলস ধোঁয়ার মতো এইখানে কার্তিকের দেশে।
হেমন্তে ধান ওঠে ফলে
দুই পা ছড়ায়ে বস এইখানে পৃথিবীর কোলে।’
হেমন্ত এখন এক লজ্জাবতী ঋতু, আছে আবার নাই। গোধূলি-বিকেলে উষ্ণতা-শীতলতার মাঝখানে, রাতে ঘরে ফেরার সময় একটু শীতল ঝাপটা কিংবা ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে ঈষৎ শীতভাব-এই তো এখনকার হেমন্ত।