হিরোশিমা ও নাগাসাকির ধ্বংসযজ্ঞ

95

এস ডি সুব্রত

আগস্ট বাঙালির যেমন নিষ্ঠুরতম মাস, আবার বিশ্ববাসীর জন্য এক ভয়ংকর মাস ।এ মাসে বাংলাদেশ হারিয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে। আমরা হারিয়েছিলাম বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। অপরদিকে বিশ্ববাসীর দিকে চোখ ফেরালে চোখের সামনে ভেসে ওঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র। জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকির নিষ্ঠুর ও জঘন্যতম হত্যাকান্ড। কোন শান্তিপ্রিয় মানুষেরই যুদ্ধ কাম্য নয়। তবু যুগে যুগে যুদ্ধ চলে আসছে। প্রাচীন কালেও যুদ্ধ ছিল। তখন অস্ত্র ছিল তীর, ধনুক,বর্শা ও তলোয়ার। সভ্যতার উৎকর্ষতার সাথে সাথে যুদ্ধের ধরন যেমন পাল্টেছে, তেমনি পাল্টে গেছে অস্ত্রের ধরন। নিজে বাঁচার জন্য, অন্যকে ঘায়েল করার জন্য কিংবা আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হচ্ছে। তেমনি একটি ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এ যাবতকালে সংঘটিত যুদ্ধের মধ্য এটা ছিল সবচেয়ে ভয়ংকর ও ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার বৃহৎ পরিসরের কারণ হিসেবে এডলফ হিটলার ও নাৎসি পার্টির জার্মানির রাজনৈতিক অধিগ্রহন এবং ক্ষুদ্র পরিসরের কারন গুলোর মধ্যে একটি ছিল জাপান সাম্রাজ্যের ১৯৩০ এর দশকে চীন প্রজাতন্ত্রে আক্রমণ। মিত্র শক্তি জার্মান ও জাপানের সাম্রাজ্য বাদী আগ্রাসনকে যুদ্ধের কারন বলে দাবি করে। হিটলার পোল্যান্ডের রাষ্ট্রীয় সীমানায় ডানজিগ অঞ্চলে যোগাযোগের জন্য পোলিশ করিডর দাবি করলে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড বিরোধীতার হুমকি দেয়। জার্মান এই হুমকি অগ্রাহ্য করে পোল্যান্ড আক্রমণ করলে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। মিত্র পক্ষের দেশ আমেরিকা প্রতিপক্ষকে আত্ম সমর্পণের মাধ্যমে যুদ্ধ জয়ের পথ খুঁজতেই জাপান আক্রমণ করে। আবার কোন কোন মতে, ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও জাপান এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকলে আমেরিকা জাপানকে যুদ্ধ বন্ধের আহবান জানায়। জাপান এ আহবান অগ্রাহ্য করলে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যানের নির্দেশে আমেরিকা জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত ৬ বছর ।এরকম ভয়াবহতা এ যুদ্ধের পর বিশ্ববাসী আর দেখেনি। এ যুদ্ধে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে বোমার যে ধ্বংসযজ্ঞ তা ভুলে যাবার নয় ।এই দুই শহরে বোমা হামলার স্মরণে বিশ্ববাসী আজও ৬ আগস্ট হিরোশিমা দিবস এবং ৯ আগস্ট নাগাসাকি দিবস পালন করে । আজ থেকে ৭৬ বছর আগে ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে ৬ আগস্ট হিরোশিমা ও ৯ আগস্টে নাগাসাকিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পারমাণবিক বোমা হামলা করেছিল। এটাই বিশ্বে কোন যুদ্ধে পারমাণবিক বোমার প্রথম ব্যবহার। এ বোমার বিস্ফোরণে আনুমানিক হিরোশিমা শহরে এক লাখ চল্লিশ হাজার এবং নাগাসাকিতে ৭৪ হাজার মানুষ মারা যায়। এ মৃত্যুর সংখ্যা বোমার বিস্ফোরনের সাথে সাথে মৃত্যুর পরিমাণ। পরবর্তীতে এ বোমার তেজস্ক্রিয়তায় আরো মানুষ মারা গিয়েছিল। আবার যারা বেঁচে ছিল তারা প্রচন্ড মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে বাকি জীবন অতিবাহিত করেছিল। এ বোমা হামলার মাত্র কয়েক দিন পর ১৪ আগস্ট জাপান মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। তবে জাপান মিত্রবাহিনীর বেঁধে দেওয়া সময়সীমার মধ্যে আত্মসমর্পণ করেনি। হিরোশিমা ও নাগাসাকির নাম শুনলেই আঁতকে উঠে মানুষ। চোখের সামনে ভেসে উঠে ভয়াবহ হত্যাকান্ডের নিষ্ঠুর চিত্র।
জাপানের হিরোশিমা শহরে ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট সকাল ৮ টা ৪৫ মিনিটে আমেরিকার এলো বি-২৯ সুপার পোর্টেস নামক বিমান থেকে ফেলা হয় লিটলবয় নামের পারমাণবিক বোমা। মূহুর্তের মধ্যে সারা শহরে আগুন ধরে যায়। বিস্ফোরণের দেড় কিলোমিটার এর মধ্যে যা ছিল পুড়ে ছাই। হাজার হাজার মানুষ পুড়ল। যারা বেঁচে ছিল তাদের কারো পা নেই,কারো হাত নেই, কারো চোখ অন্ধ। কেউ চিৎকার করছে পানির জন্য। ৪৮ হাজার বাড়িঘর পুড়ে ধ্বংস হল। হিচিয়ামা নদীর পানি হয়ে গেল উত্তপ্ত। এক লাখ চল্লিশ হাজার মানুষ মারা গেল দুই লাখ মানুষ চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেল। কোন যুদ্ধে ব্যবহৃত প্রথম পারমাণবিক বোমা লিটলবয়ের ওজন ছিল চার হাজার কেজি, ইউরেনিয়াম ২৩৫, দৈর্ঘ্য ৯.৮৪ ফুট। বিস্ফোরণের মাত্রা ছিল ১৩ কিলোটন টিএনটির সমতুল্য । এই বোমা বহনকারী বিমানের পাইলট ছিলেন কর্নেল পল টিবেটস । আঘাতের মূল লক্ষ্য ছিল শিমা সার্জিকেল ক্লিনিক । হিরোশিমায় যেখানে লিটলবয় ফেলা হয়েছিল সেখানে পরে নির্মিত হয়েছে পিস মেমোরিয়াল পার্ক ।
তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান হিরোশিমা ধ্বংস করে তৃপ্ত হননি । তার নির্দেশে হিরোশিমায় বোমা হামলার ২ দিন পর ৯ আগস্ট বেলা ১২টা ২ মিনিটে বি ২৯ বক্সার বিমানের মাধ্যমে নাগাসাকিতে ফ্যাটম্যন নামের বোমা নিক্ষেপ করে। ফ্যাটম্যনের ধ্বংস ক্ষমতা লিটলবয়ের চেয়ে কিছুটা কম ছিল। এই শহরের দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার মানুষের মধ্যে সাথে সাথে যারা গেল ৭৪ হাজার মানুষ। একইদিনে মিৎসুবিশি জাহাজ নির্মাণ কারখানা ধ্বংসের জন্য আরেকটি বোমা ফেলা হয়েছিল যে টি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিল। ফ্যাটম্যনের ওজন ছিল ৪৬৩০ কেজি , দৈর্ঘ্য ১০.৬ ফুট ,পরিধি ছিল ৩৬ ইঞ্চি। তেজস্ক্রিয় পরমাণু প্লুটোনিয়াম ২৩৯, ফ্যাটম্যান বহনকারী বিমানের পাইলট ছিলেন মেজর চার্লস ডব্লু সুইনি। বিস্ফোরণের মাত্রা ছিল ২১ কিলোটন টিএনটি । লক্ষবস্তু ছিল জাপানের নাগাসাকির মিৎসুবিশি স্টীল ও অস্ত্র কারখানা। পরবর্তীতে এখানে একটি শান্তি উদ্যান নির্মিত হয়েছিল।
হিরোশিমা ও নাগাসাকির বোমা হামলার ভয়াবহতা ও মৃতদের স্মরনে সারা বিশ্বে প্রতি বছর ৬ ও ৯ আগস্ট যথাক্রমে হিরোশিমা ও নাগাসাকি দিবস পালিত হয় ।
জাপান ১৪ আগস্ট নিঃশর্ত ভাবে আত্ম সমর্পণ করে । আত্ম সমর্পণের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান হোয়াইট হাউসের সামনে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে ভাষনে বলেন , এই দিনটি র জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। আমরা জানতাম ফ্যাসিবাদ পরাস্ত হবেই। এর পরদিন জাপান সম্রাট হিরোহিতো রেডিও ভাষণে বলেন, “আমাদের যদি লড়াই চালিয়ে যেতে হয় তা কেবল একটি জাতি হিসেবে চুড়ান্ত পতন এবং ধ্বংসই ডেকে আনবে না , পুরো মানব সভ্যতাকেও সম্পূর্ন নির্মূল করে দিতে পারে”।
সামরিক প্রভুত্বের মাধ্যমে সারা বিশ্বে আধিপত্য কায়েমের লক্ষ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পারমাণবিক বোমার অধিকারী হওয়ার ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সামরিক ক্ষেত্রে একক আধিপত্য অর্জন করে যুক্তরাষ্ট্র । এতে অন্যান্য দেশ পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রতিযোগিতায় নামে। এই প্রতিযোগিতার দৌড়ে রাশিয়া, ব্রিটৈন, ফ্রান্স, চীন ,ভারত , পাকিস্তান ও উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক বোমার অধিকারী হয়। অঘোষিত ভাবে ইসরাইলও পারমাণবিক বোমার অধিকারী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পারমাণবিক বোমা তৈরির যে প্রতিযোগিতা শুরু হয় তাতে বিশ্বের শান্তিকামী সাধারণ জনতা আতংকিত হয়। শান্তিপ্রিয় মানুষ বিশ্ব কে পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহ ধ্বংস থেকে ফিরিয়ে আনতে আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে পারমাণবিক প্রতিযোগিতা বিস্তার রোধে এনটিপি ও সিটিবিটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় কিন্তু সকল দেশের ঐক্য আর আন্তরিকতার অভাবে সে চুক্তি সফলতা লাভ করতে পারেনি। কারো জন্য নিয়মের কঠোরতা আর কারো জন্য শিথিলতার কারনে সফলতা অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না। অস্ত্র তৈরির পেছনে হাজার হাজার মিলিয়ন ডলার খরচ না করে বিশ্বব্যাপী বিরাজমান দারিদ্র্য, অশিক্ষা, মরনব্যাধি ও মহামারী নির্মূলে ব্যায় করা হলে সত্যিকারের মানবাধিকার চর্চা হতো এবং বিশ্বে শান্তি বিরাজ করতো। হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে মৃত্যুবরণকারী অধিকাংশই ছিল সাধারণ জনগণ। এমন মৃত্যুর শহর আর দেখতে চায়না বিশ্ববাসী।
আধুনিক সভ্য পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে একটা যুদ্ধ বিহীন বিশ্ব গড়ার প্রত্যাশা করি। কিন্তু ভয়াবহ আরেকটি পারাণবিক যুদ্ধের অনিবার্যতা নিয়ে আসছে অস্ত্র ব্যবসায়ী দেশ ও যুদ্ধবাজ কিছু রাষ্ট্র প্রধান। যুদ্ধ নামক ভয়াবহ মৃত্যুর খেলা থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি শান্তিপূর্ণ বাসযোগ্য সুন্দর পৃথিবী রেখে যেতে হবে এই বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা।