হিমেল হাওয়ায় শীতের দাপট

92

ঊর্ধ্বাকাশে থাকা ঘন কুয়াশাস্তর ভেদ করে দিনের বেলা সূর্যকিরণ ভূ-পৃষ্ঠে প্রত্যাশিত মাত্রায় পৌঁছাতে পারছে না। অন্যদিকে, দেশে ঢুকছে ‘সাইবেরিয়ান উইন্ড’ বা হিমেল বাতাস। তাপমাত্রার পারদ ততটা নিচে না নামলেও কুয়াশা আর হিমেল হাওয়ার দাপটের কারণেই এখন শীতের তীব্রতা অনুভূত হচ্ছে। বিশেষ করে, রাতে ও সকালে শীত অনুভূত হচ্ছে বেশি। ঘন কুয়াশার স্তর রয়েছে রংপুর, ময়মনসিংহ, ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও সিলেট বিভাগের উপর।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস বলছে, পৌষের শেষদিকে এসে আবহাওয়ায় বিরাজমান কুয়াশাস্তর আর হিমেল হাওয়ার দাপট আরও দু-তিনদিন থাকতে পারে। আজ সোমবার মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত সারাদেশে মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে। একইসময়ে দেশের কোথাও কোথাও বিকেল পর্যন্ত মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা অব্যাহত থাকতে পারে। দেশের বেশিরভাগ স্থানে দেরিতে বা দুপুরের পর সূর্যালোক পাওয়া যাবে। আর দেশের মধ্যভাগের পূর্ব অংশে এবং দক্ষিণ-পূর্ব অংশের মধ্যে বিকালের দিকে অনুজ্জ্বল রোদ পাওয়া যেতে পারে। তবে কিছু কিছু স্থানে আজও সূর্যকিরণের দেখা মিলবে না। বিদ্যমান আবহাওয়া পরিস্থিতিতে বিশেষ কিছু পরিবর্তন ঘটায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পারদ খুব একটা নিম্নমুখী হবে না।
আবহাওয়াবিদ মো. রুহুল কুদ্দুস পূর্বদেশকে বলেন, ‘এই অবস্থার জন্য দায়ী হিমেল হাওয়া। উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ঘন্টায় আট থেকে দশ কিলোমিটার বেগে বয়ে যাওয়া এই বাতাসকে বলে ‘সাইবেরিয়ান উইন্ড’। হিমালয়ের কারণে সরাসরি বাতাসটা আসতে পারে না। শীতের সময় এই বাতাসটা একেবারে ইউরোপ থেকে প্রতিবেশি দেশ ভারতের কাশ্মীর, দিল্লি ও উত্তর প্রদেশ হয়ে বাংলাদেশে ঢোকে। সেই হিমেল হাওয়াটাই এখন দেশের ওপর দিয়ে বইছে।’
অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে গতকাল রবিবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার জন্য প্রচারিত আবহাওয়ার দৃশ্যপটে বলা হয়েছে, উপমহাদেশীয় উচ্চচাপ বলয়ের বর্ধিতাংশ বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মৌসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে, যার বর্ধিতাংশ উত্তর-পূর্ব বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। আর পূর্বাভাসে বলা হয়, ঈশ্বরদী, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড় এবং কুষ্টিয়া অঞ্চলের ওপর দিয়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। সারাদেশে রাতের তাপমাত্রা সামান্য হ্রাস পেতে পারে এবং দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। তার পরবর্তী আটচল্লিশ ঘন্টা বা দু’দিনের আবহাওয়ার অবস্থায় সামান্য পরিবর্তন হতে পারে। তার পরবর্তী পাঁচ দিনে রাতের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে। গতকাল রবিবার রংপুরের রাজারহটে দেশের সর্বনিম্ন নয় দশমিক পাঁচ ডিগ্রি এবং টেকনাফে সর্বোচ্চ ২৫ দশমিক আট ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগের সর্বত্র সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১২ দশমিক ছয় থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠানামা করেছে।
এর আগে চলতি জানুয়ারি মাসের পূর্বাভাসে আবহাওয়া আধিদপ্তর জানিয়েছিল, সারা দেশে মোট তিনটি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। এর মধ্যে অন্তত দুটির ধরন হতে পারে তীব্র। এরমধ্যে জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষদিকে একটি এবং মাসের শেষ সপ্তাহে আরেকটি তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাবে। আর মাসের মাঝামাঝি সময়ে একটি মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। শৈত্যপ্রবাহ চলাকালে বিভিন্ন বিভাগের জেলাগুলোতে কনকনে শীত অনুভূত হবে। বিশেষ করে, গ্রামীণ জনপদে শীতের তীব্রতা বেশি অনুভূত হবে। সারাদেশের মধ্যে রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ ও ঢাকা বিভাগের কিছু অংশ এবং সিলেট ও সুনামগঞ্জ অঞ্চলে এবার শীতের তীব্রতা বেশি থাকবে। পাশাপাশি রাঙামাটি পার্বত্য জেলার বাঘাইছড়ি ও এর আশেপাশে তীব্র শীত অনুভূত হবে। আর ঢাকা থেকে দক্ষিণাঞ্চলের দিকে মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ থাকতে পারে।
অধিদপ্তরের রেকর্ডকৃত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, উত্তুরে হাওয়ায় ডিসেম্বরের শুরু থেকেই তাপমাত্রার পারদের পতন শুরু হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৭ ডিসেম্বর চলতি মৌসুমে প্রথমবারের মত সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পারদ এক অঙ্কের ঘরে নেমে আসে। ওইদিন দেশের সর্বউত্তরের জনপদ তেঁতুলিয়ায় সর্বনিম্ন ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করে আবহাওয়া অধিদপ্তর। পরদিন আরও এক ডিগ্রি কমে তা আটের ঘরে নামে। কিন্তু এরপর থেকেই পারদের উর্ধ্বমুখী পথচলা শুরু হয়। টানা চারদিনে তিন ডিগ্রিরও বেশি চড়ার পর ফের পতন ঘটে পারদের। পারদের এই পতনমুখী প্রবণতার মধ্যেই আবহাওয়াবিদরা সারাদেশে শীত জেঁকে বসার আলামত দেখতে পান। এর জেরে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় বইতে শুরু করে মৌসুমের প্রথম মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। সর্বনিম্ম তাপমাত্রা নেমে আসে চুয়াডাঙ্গায় সাত দশমিক নয় ডিগ্রিতে। সর্বশেষ গত ২৯ ডিসেম্বর তেঁতুলিয়ায় চলতি মৌসুমের সর্বনিম্ন চার দশমিক পাচ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এরপর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি নেমে চড়তে থাকে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা।
প্রসঙ্গত, বিগত ২০১৮ সালের ৮ জানুয়ারি পূর্ববর্তী ৫০ বছরের ইতিহাসের পাতা পাল্টে দিয়ে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় দেশের সর্বনিম্ন দুই দশমিক ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এর আগে সিলেট বিভাগের শ্রীমঙ্গলে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কম দুই দশমিক আট ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ১৯৬৮ সালের ৪ ফেব্রূয়ারি। চলতি বছরের জানুয়ারিতেও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা চার ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমেছিল। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছয় থেকে আট ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে হলে মাঝারি এবং আট ডিগ্রির চেয়ে বেশি থেকে ১০ ডিগ্রির মধ্যে হলে তাকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলে থাকে আবহাওয়া অধিদপ্তর। আর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে আসলে তাকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়।