হিজরি নববর্ষের তাৎপর্য

52

মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম

মানবজীবন সময়ের সমষ্টি। সময়কে মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহারোপযোগী করে আল্লাহ তাআলা প্রাকৃতিকভাবে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেছেন। যেমন দিন, রাত, মাস, বছর ইত্যাদি। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, নিশ্চয়ই আকাশমÐলী পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে মাস ১২টি, এর মধ্যে ৪টি নিষিদ্ধ মাস; এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান’।১১ – সূরা তাওবা,আয়াত:৩৬
অন্যত্র ইরশাদ করেন, তিনিই সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং এগুলোর মঞ্জিল নির্দিষ্ট করেছেন, যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পারো। আল্লাহ এগুলো নিরর্থক সৃষ্টি করেননি। জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি এসব নিদর্শন বিশদভাবে বিবৃত করেন’।২২ – সূরা ইউনুস, আয়াত: ৫
নতুন বছরের সঙ্গে আসে নতুন চাঁদ ও নতুন মাস। নতুন চাঁদে নতুন মাসে রাসুলে আরবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পড়তেন: ‘আল্লাহ মহান, হে আল্লাহ! এই মাসকে আমাদের জন্য নিরাপত্তা, ইমান, প্রশান্তি ও ইসলামসহযোগে আনয়ন করুন; আমাদের তৌফিক দিন আপনার মহব্বত ও সন্তুষ্টির; আমার ও তোমার প্রভু আল্লাহ! এই চন্দ্রমাস সুপথ ও কল্যাণের’।
বহু প্রাচীনকাল থেকে সন গণনা প্রচলিত।আরবদের মধ্যে গোত্রগত বিভাজনের কারণে অনেক ধরনের সন বা বর্ষ গণনা করা হতো। তবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো সাল বা বর্ষ ছিল না। বিভিন্ন প্রকারের এসব সনের মধ্যে হজরত নুহ আলাইহিস সালামের বন্যা সন, ইয়েমেনের খ্রিষ্টান বাদশাহ আবরাহা কর্তৃক কাবা ঘর ধ্বংসের জন্য প্রেরিত হস্তি বাহিনীর নামে আমুল ফিল, আমুল ফুজ্জার, আমুল ফতেহ, হবুতি, লুই এবং খসরু সন উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া আরবরা বণিক ছিল বিধায় আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে রোমান সনকে অনুসরণ করা হতো। ব্যাবেলি সন চালু হয় সম্রাট বুখতে নসরের জন্ম তারিখ থেকে। মিসর ত্যাগ করে বনী ইসরাঈল যেদিন মুক্ত হয়, সে দিন থেকে তাদের সন গণনা শুরু। হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মদিন থেকে খ্রিষ্টাব্দ বা ইংরেজি সনের প্রচলন। গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা এবং উজ্জয়িনীর কিংবদন্তি রাজা বিক্রমাদিত্য খ্রিষ্টপূর্ব ৫২ অব্দে ভারতবর্ষে বিক্রমাব্দ প্রচলন করেন। রোমীয়, ব্যাবেলীয়, ইংরেজি, ইরানি, হিন্দুস্তানি প্রত্যেকটি সনের সূচনাতে কোনো না কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা রয়েছে।
হিজরতের ১৭ বছর পর দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায়, তখন অনেক নতুন ভূখন্ড ইসলামি খেলাফতের অন্তর্ভুক্ত হয়। রাষ্ট্রীয় কাগজপত্র ইত্যাদিতে সাল-তারিখ উল্লেখ না থাকায় অসুবিধা হতো। আর তখন কুফার গভর্নর ছিলেন হজরত আবু মুসা আল আশয়ারি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। তাই তিনি প্রশাসনিক কাজের অসুবিধার কথা জানিয়ে সন ও তারিখ নির্ধারণের আবেদন করেন । সে আবেদনকে গুরুত্ব দিয়ে এবং প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে হজরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু একটি পরামর্শ সভার আয়োজন করেন। যেহেতু নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিজরতেই ইসলামের পূর্ণতা লাভ, কল্যাণধর্মী রাষ্ট্র গঠন এবং মানব ইতিহাসে নব দিগন্তের সূচনা করে, তাই সে সভাতেই প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার হিজরতের বছরকে সন গণনার বছর হিসেবে নির্ধারণের জন্য হজরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু পরামর্শ দেন। পবিত্র মহররম মাস থেকে ইসলামি বর্ষ হিজরি সালের শুরু করার ও জিলহজ্ব মাসকে সর্বশেষ মাস হিসেবে নেওয়ার পরামর্শ দেন হজরত উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। সর্বসম্মতিক্রমে তা গৃহীত হয়। আর তখন থেকেই ইসলামী বর্ষ বা হিজরি সন গণনার শুরু।
প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার মক্কা মুকাররমা থেকে মদিনা মুনাওয়ারায় হিজরতের ঘটনা মুসলমানদের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। হিজরত মানে ছেড়ে যাওয়া, পরিত্যাগ করা; দেশান্তর হওয়া ও দেশান্তরিত করা। পরিভাষায় হিজরত হলো ধর্মের জন্য এক স্থান ত্যাগ করে অন্য স্থানে চলে যাওয়া। নবুয়তের ত্রয়োদশ বর্ষে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় হিজরত করেন। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমার দিনে মদিনায় প্রবেশ করলেন। তিনি যখন মদিনা শরিফে প্রবেশ করলেন, তখন তাঁকে বরণ করার জন্য তাঁর উটের দড়ি নিয়ে টানাটানি শুরু হলো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘উট ছেড়ে দাও। যেখানে সে বসবে, সেটাই হবে আমার বাসস্থান। তাকে এমনই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ উট বনু নাজ্জার গোত্রের এলাকায় গিয়ে দাঁড়াল। এখানেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার নানার বাড়ি ছিল। এ গোত্রের হজরত আবু আইয়ুব আনসারি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বাড়ির সামনে গিয়ে উট বসে পড়ল। এখানেই নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাসস্থান নির্ধারণ করা হলো। এখানেই গড়ে উঠেছে মসজিদে নববি ও মদিনাতুর রাসুল বা রাসুলের শহর।
জনসংখ্যায় দ্বিতীয় বৃহৎ মুসলিম দেশের সরকারও হিজরি নববর্ষ পালনের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করে নববর্ষ ও অন্যান্য উৎসব পালনের নামে বিজাতীয় সংস্কৃতিকে প্রশয় দান করছে বলে মন্তব্য করেন স্কলারগণ। কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা জোট কেউ ইসলামী নববর্ষ হিজরি সন পালনের উদ্যোগ নেয়নি। দেখা যায়নি পরস্পর শুভেচ্ছা বিনিময় করতেও। সংবাদপত্র বের করেনি বিশেষ সংখ্যা, আয়োজন নেই কোনো মিডিয়াতে বিশেষ অনুষ্ঠানের। এ অবস্থায় চট্টগ্রামে হিজরি নববর্ষ উদযাপন পরিষদের আয়োজনে বেশ কয়েক বছর ধরে যে অনুষ্ঠান হয়ে আসছে, তা নিঃসন্দেহে আশাপ্রদ। বিশ্ব শান্তির দূত ও কল্যাণের প্রতীক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার স্মৃতিবিজড়িত সন গণনার প্রতি সম্মান জানিয়ে ১ মহররম ছুটি ঘোষণা করে সরকারিভাবে হিজরি সন উদযাপনের ব্যবস্থা করা সময়ের দাবী।

লেখক: আরবি প্রভাষক, রাণীরহাট আল-আমিন হামেদিয়া ফাযিল মাদরাসা; খতিব, রাজানগর রাণীরহাট ডিগ্রি কলেজ জামে মসজিদ, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।