হাসপাতাল চাই তবে সিআরবিতে নয়

12

 

চট্টগ্রামের ফুসফুস খ্যাত সবুজের ছায়াঘেরা নান্দনিক সিআরবি। অনেকগুলো শতবর্ষী গাছ তাদের বিশাল দেহ নিয়ে ঠাই দাঁড়িয়ে এলাকাটিকে শোভাবর্ধন করেছে। এ এলাকায় সম্ভবত সবচেয়ে বুড়ো গাছটিই ‘সিরিষ গাছ’ নামে খ্যাতি ছড়িয়েছে। আর বুড়ো গাছটির আশির্বাদেই যেন এখানে গড়ে উঠেছে বাঙালির সংস্কৃতি চর্চার নানা আয়োজন। বৈশাখি মেলাসহ ষড়ঋতুর নানা বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক কর্মকাÐ। এখানের সবুজের ডালে ডালে পাখির গুঞ্জন, নিবিষ্ট ছায়ায় যুবক-যুবতির কলতান প্রাণের সঞ্চার ঘটে সারাক্ষণ। এটি কোন মানব সৃষ্ট পার্ক বা বিনোদন কেন্দ্র নয়; একান্ত প্রকৃতির পবিত্র হাতে গড়া একটি সবুজিয়া উদ্যান। এ উদ্যান চট্টগ্রামবাসীকে দেয় অক্সিজেন আর বিনোদন। আজ সেই সিআরবিতে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতাল ও কলেজ। অপার সৌন্দর্যের এ লীলাভুমিতে কেন হঠাৎ বাণিজ্যিক হাসপাতাল হতে যাবে, তাও আবার বেসকারি! কারাই এ সুন্দর ও নির্মল পরিবেশ ধ্বংস করে হাসপাতাল করতে চায়? এ নিয়ে পরিবেশ সচেতন চট্টগ্রামবাসী তাদের ক্ষোভ, দুঃখ প্রকাশ করে চলছে সপ্তাহজুড়ে। চট্টগ্রামবাসী মনে করেন, সমকালীন করোনা মহামারির যে তান্ডব, রোগব্যাধির যে বিস্তৃত রূপ তাতে চট্টগ্রামে একটি কেন আরো অনেক সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল প্রয়োজন। এ জন্য চট্টগ্রাম নগরে অনেক সুন্দর এবং বিস্তৃত জায়গা রয়েছে। সরকারি অনেক পরিত্যক্ত খাস জায়গাও রয়েছে, সেইসব জায়গায় তো সরকারি হোক বেসরকারি হোক হাসপাতাল করা যায়। কিন্তু সিআরবিতে কেন। আমরা চট্টগ্রামবাসী উন্নতমানের আধুনিক হাসপাতাল চাই, তবে তা যেন সিআরবিতে না হয়। অন্যত্র প্রস্তাবিত হাসপাতাল হোক-আমরা তাকে স্বাগত জানাব।
সিআরবি মানে সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং। চট্টগ্রাম নগরীর প্রাণকেন্দ্র স্টেডিয়ামসংলগ্ন বিশাল পাহাড়ের উপরেই এ বিল্ডিং স্থাপন করা হয়। রেল ভবনের অবয়ব দেখলেই বুঝা যায়, তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার পাহাড় না কেটে প্রকৃতি ধ্বংস না করে তৎকালীন ব্রিটিশ স্থাপত্য কৌশলে এ ববনটি নির্মাণ করেছিল। এটি তৎকালীন আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের হেডকোয়ার্টার। উনিশ শতকে বাংলায় রেলের সূচনা যুগের স্থাপনা হওয়ায় সিআরবি একইসঙ্গে দেশের একটি হেরিটেজও। কিন্তু সেই পাহাড়ের প্রায় ছয় একর জায়গা নিয়ে গড়ে উঠবে একটি বেসরকারি হাসপাতাল, যা চট্টগ্রামের মানুষ কোনভাবেই মানতে পারছেন না। সূত্র জানায়, রেলওয়ের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) ভিত্তিতে সেখানে একটি হাসপাতাল গড়ে তুলবে ইউনাইটেড গ্রুপ। ৫০০ শয্যার এই হাসপাতাল এবং এর সঙ্গে ১০০ আসনের একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ নির্মাণে ব্যয় হবে ৪৮৬ কোটি টাকা। এ বিষয়ে ভ‚মি সংক্রান্ত চুক্তি হয়েছে ৫০ বছরের জন্য। চট্টগ্রাম মহানগরীতে রেলওয়ের জায়গায় এ পর্যন্ত আরও হাসপাতাল এবং স্থাপনা গড়ে উঠেছে। কিন্তু চট্টগ্রামের মানুষের জোর আপত্তি সিআরবি পাহাড়ে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা নিয়ে। সেখানে স্থাপনা নির্মাণের জন্য কাটতে হবে দেড়শ’ বছর বয়সী গাছ আর পাহাড়। এছাড়া মহানগরীর ফুসফুস হিসেবে বিবেচিত এই এলাকার পরিবেশ বিনষ্ট এবং নান্দনিক সৌন্দর্য ধ্বংস হওয়ার বিষয়টি নাগরিকদের ভাবিয়ে তুলেছে। আমরা লক্ষ্য করছি, সিআরবি ইস্যুতে দলমত নির্বিশেষে সকলেই এক। তাদের বক্তব্য, স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে আমরা অবশ্যই আরও হাসপাতাল চাই। কিন্তু ঐতিহ্য ধারণ করা প্রাকৃতিক ও নান্দনিক সৌন্দর্যের এই পাহাড়ে কোন হাসপাতাল নয়। সিআরবি পাহাড়ে বেসরকারি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা চেষ্টার বিরুদ্ধে গতকাল থেকে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ শুরু হয়। বৃহস্পতিবার স্থানীয় দৈনিকসহ জাতীয় সহযোগী দৈনিক সংবাদপত্রগুলো পতিবেদন প্রকাশ করেছে। বিশিষ্টজনের বক্তব্যও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে প্রত্যেকের দাবি, হাসপাতাল চাই, তবে সিআরবিতে নয়। আমরা জেনেছি, বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় ওঠায় বিষয়টি নিয়ে ভাবছে ক্ষমতাসীন দলও। বুধবার সকালে সিআরবি পরিদর্শন করেছেন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনসহ নেতৃবৃন্দ। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এম এ সালামও বলেছেন, বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে তারা এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করবেন। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষেরও প্রায় একই মত। কারণ, সিআরবিতে এ ধরনের কোন স্থাপনা গড়ার বিষয়টি নগর পরিকল্পনার মধ্যে নেই। বলাবাহুল্য যে, চট্টগ্রামের ফুসফুস হিসেবে বিবেচিত সিআরবি পাহাড় শুধুমাত্র বেড়ানো এবং মুক্ত বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণের জন্য আদর্শ স্থানই নয় বরং এই স্থানকে ঘিরে রয়েছে চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক বলয়, যা আমরা প্রথমেই উল্লেখ করেছি। চট্টগ্রামে ঢাকার মতো রমনা পার্ক কিংবা বোটানিক্যাল গার্ডেন নেই। গাছগাছালিতে আচ্ছাদিত নয়নাভিরাম এই উন্মুক্ত পরিসরটিও যদি না থাকে, নগরীর সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়! আমরা হাসপাতাল নির্মাণের বিপক্ষে নই। চট্টগ্রামে রেলওয়ের অনেক খালি জায়গা আছে, যেখানে হাসপাতাল করা যায়। আমরা আশা করি, সিআরবির প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে সরকারের উচ্চমহল থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত আসবে।