হালদায় বিপন্ন ডলফিন জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি

4

 

গত সোমবার হালদা নদীতে আবারও মৃত ডলফিনের সন্ধান পাওয়া গেছে। এনিয়ে দুই মাসে হালদা ও কর্ণফুলী
নদী এবং সংলগ্ন শাখা খালে পাঁচটি মৃত ডলফিনের দেখা মিলল। এর মধ্যে বেশিরভাগের শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে হালদায় ৩১টি এবং কর্ণফুলীতে ২টি মৃত ডলফিনের সন্ধান মেলে। এই হারে ডলফিনের সংখ্যা কমতে থাকলে হালদা ও কর্ণফুলী ডলফিন শূন্য হয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। সূত্র জানায়, সোমবার সকালে হালদা নদীর রামদাস মুন্সীর হাট এলাকায় বেসরকারি সংস্থা আইডিএফের স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকরা নদীতে একটি মৃত ডলফিন ভাসতে দেখে নৌ পুলিশকে খবর দেয়, নৌ পুলিশ এ ডলফিনটিকে নদী থেকে তোলে তীরেই মাটিচাপা দেয়। নৌ পুলিশের ধারণা, কয়েক দিন আগেই ডলফিনটি মারা গেছে। এর আগে গত ৩০ আগস্ট হাটহাজারী মদুনাঘাট বড়ুয়া পাড়াসংলগ্ন অংশে আরেকটি মৃত ডলফিন পেয়েছিল নৌ পুলিশের টহল দলের সদস্যরা। সেটির শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন ছিল না। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর এবং ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে হালদায় ও শাখা খালে মারা যায় মোট ১৬টি ডলফিন। এর মধ্যে বেশিরভাগের শরীরে আঘাতের চিহ্ন মিলেছিল। সে সময় নদীতে চলাচলকারী বালু উত্তোলনকারী ড্রেজারের আঘাতে ডলফিন মারা পড়ছিল বলে জানিয়েছিল সংশ্লিষ্টরা।
সম্প্রতি মৃত ডলফিনগুলোর শরীরে তেমন কোনো আঘাতের চিহ্ন দেখা যায়নি। ফলে ডলফিনগুলো কিভাবে বা কেন মারা যাচ্ছে- তা দ্রুত অনুসন্ধান করা জরুরি। তবে বিশষজ্ঞরা ধারণা করছেন, মাছই ডলফিনের প্রধান খাবার। মাছের পিছে ছুটতে গিয়ে জালে আটকা পড়লে বেশিক্ষণ শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে না পেরে ডলফিনগুলো মারা পড়ছে বলে ধারণা। হালদায় মা মাছ শিকারের জন্য জাল পাতা হয় নিয়মিত। পাশাপাশি নদীর তীর রক্ষায় বসানো ব্লকে এবং নদীতে চলাচলকারী নৌযানের সাথে ধাক্কা খেয়েও ডলফিন মরতে পারে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। হালদা নদীতে জাল পাতা ও ইঞ্জিন চালিত নৌকা বন্ধের দাবি জানিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মা মাছ ও ডলফিন রক্ষা করার আর কোন বিকল্প পথ নেই। হাটহাজারী উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে একটি অনলাইন পত্রিকার খবরে বলা হয়, বর্তমানে এ নদীতে বালুবাহী ড্রেজার চলে না। তবে জালে আটকা পড়লে ডলফিনের মুখে জালের অংশবিশেষ আটকে থাকে। আবার মাছের পিছে ছুটতে গিয়ে সিমেন্টের বøকে আঘাতের কারণেও ডলফিনের মৃত্যু হতে পারে। এছাড়া ডলফিন পরিবেশের একটা ইনডিকেটর। পরিবেশ ভালো না থাকলে ডলফিন টিকতে পারে না। তবে যে যেটাই বলুক বাস্তবতা হচ্ছে, ডলফিনের মৃত্যুর কারণ নিয়ে অনুসন্ধানের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। একই সাথে হালদার বিভিন্ন দিক যেমন- পানির মান, জীববৈচিত্র্য, আশেপাশের পরিস্থিতি সব নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন। যত বেশি গবেষণা হবে তত তথ্য জানা যাবে।
আমরা অনেকদিন থেকে হালদা নদী রক্ষায় নানা ঘোষণা শুনে আসছি, যেমন: ২০১০ সালে মৎস্য শিকার বন্ধ করার ঘোষণা, নদী থেকে বালি উত্তোলন নিষিদ্ধ করার ঘোষণা, ২০১৮ সালে যান্ত্রিক নৌযান চলাচল বন্ধের ঘোষণা আর ২০১৯ সালে হালদাকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণার প্রতিশ্রুতি। এতসব ঘোষণার কোনটিই হালদার দৃশ্যপটে পরিবর্তন আেেস নি। সম্প্রতি ডলফিনসহ হালদা নদী ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কর্তৃপক্ষের অবহেলার চিত্র দেখে মনে হচ্ছে, শুধু ঘোষণাতেই দায় সেরেছে সংশ্লিষ্টরা। তাদের উদাসীনতা ও অবহেলায় প্রতিনিয়ত ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার রুই জাতীয় মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র বলে পরিচিত নদীর ডলফিনগুলো। আমরা খবরে দেখেছি, হালদা নদীর মোহনা থেকে সাত্তার ঘাট পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার এলাকাকে ডলফিনের হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল একসময়। কিন্তু এ হটস্পটে কর্তৃপক্ষের কোন নজরদারি নেই। ফলে যে গতিতে হালদায় ডলফিন মারা যাচ্ছে, সেটা অব্যাহত থাকলে ২০২২ সালের মধ্যে হালদা ডলফিনমুক্ত হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। জরিপে ডলফিনের মৃত্যুর পেছনে তিনটি কারণ চিহ্নিত করা হয়। মাছ ধরার জাল, শিল্পকারখানার দূষণ ও যান্ত্রিক নৌযান। এসব বন্ধে বনবিভাগ ও মৎস্য অধিদপ্তরের সমন্বয়ে যৌথ টহলের ব্যবস্থার সুপারিশ করা হয়েছিল । কিন্তু সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে কোন উদ্যোগ দৃশ্যমান হয় নি। আমরা আশা করি, সময় থকতে হালদা নিয়ন্ত্রণ ও শাসনের দায়িত্বে থাকা কর্তৃপক্ষগুলো সজাগ হবেন। তারা হালদার পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায় যে কর্মসূচি ও ঘোষণাগুলো দিয়ে আসছেন, তা বাস্তবায়নে আন্তরিক হবেন। পাশাপাশি স্থানীয় জনগণকেও সচেতন হতে হবে। মনে রাখা চাই, হালদা শুধু মা মাছের প্রজনন কেন্দ্র বা দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তিই নয়, এটি দেশের ঐতিহ্যের অংশও বটে।