মঙ্গলবার দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত সংবাদ সূত্রে জানা যায়, হালদা নদীতে ডলফিন হত্যা বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে ভার্চুয়াল মাধ্যমে শুনানির জন্য একটি রিট আবেদন ইমেইলের মাধ্যমে জমা দেওয়া হয়েছে। গত সোমবার বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের হাইকোর্ট বেঞ্চে একমাত্র এ রিট আবেদন জমা দেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী আব্দুল কাইয়ুম লিটন। তিনি বলেন, এ বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে আবেদনটি জমা দিয়েছি। বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসের কারণে দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি ও লকডাউনের ফলে দীর্ঘদিন থেকে বন্ধ দেশের উচ্চ আদালতের বিচার কার্যক্রম সীমীত আকারে পরিচালনায় সম্প্রতি যে ভার্চুয়াল কোর্ট স্থাপন করা হয়েছে, এ মামলাটি সেই কোর্টের প্রথম রিট। রিটের আবেদনে হালদা নদীতে ডলফিন হত্যা বন্ধে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ হবে না এবং ডলফিন হত্যা বন্ধে কেন প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হবে না এ মর্মে রুল জারির আর্জি জানানো হয়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়। সম্প্রতি করোনা পরিস্থিতিতে দেশব্যাপী প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য তাদের দীর্ঘদিনের হারানো পরিবেশ ফিরে পেয়ে স্বস্থানে অবাধ বিচরণের সুযোগ পেলেও এশিয়ার একমাত্র মৎস্যপ্রজনন নদী হালদা কিছু সংখ্যক চোরা শিকারী, ইঞ্জিন চালিত বোট এবং হালদাপাড়ে গড়ে উঠা শিল্প কারখানার দূষিত বর্জ্যের কারণে নদীটি তার প্রাণ হারাতে বসেছে। এ নদীর মাছের সুরক্ষা এখন চরম ঝুকির মধ্যে পড়েছে। গণমাধ্যমে এ নিয়ে ব্যাপক লেখালেখি হলেও কোন প্রতিকার না হওয়ায় সর্বশেষ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আব্দুল কাইয়ুম লিটন ভার্চুয়াল আদালতে যে রিট করেছেন-তাকে আমরা স্বাগত জানায়। এবার এ হালদা রক্ষায় দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ কিছুটা হলেও মনোযোগি হবেন-এমনটি প্রত্যাশা আমরা করতে পারি।
উল্লেখ্য যে, সম্প্রতি হালদার গুরুত্বপূর্ণ জলজ প্রাণী ডলফিন হত্যার উৎসবে মেতেছে চোরা শিকারীরা। অন্যদিকে ইঞ্জিনচালিত বোটের আঘাতে মারা যাচ্ছে মা মাছ রুই-কাতলা। এ অবস্থায় এ নদীর অস্তিত্ব নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা যে, কোনো নদীতে ডলফিন থাকার অর্থ হচ্ছে, সেখানে অন্যান্য জলজ প্রাণীও স্বাচ্ছন্দ্যে রয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, চট্টগ্রামের হালদা নদীদূষণ, মাত্রাতিরিক্ত শিকার, আবাসস্থল বিনষ্ট, মাত্রাতিরিক্ত যান চলাচল ও বিষ প্রয়োগ করে মাছ ধরার কারণে ডলফিন হুমকির মুখে পড়েছে। গত শুক্রবারও হাটহাজারী মদুনাঘাট সংলগ্ন অংশ থেকে একটি ডলফিন উদ্ধার করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে, রাতে হালদায় মা মাছ ধরতে পাতা ভাসা জালে ডলফিনটি আটকা পড়েছিল। পরে এটিকে ধারালো কিছু দিয়ে কেটে হত্যা করা হয়। এটা অত্যন্ত নিষ্ঠুর ঘটনা। তবে এই প্রথম কোনো ডলফিনের মৃতদেহে এভাবে ধারালো কিছুর গভীর আঘাত দেখা গেল। নিহত ডলফিনটি ৫ ফুট ২ ইঞ্চি দীর্ঘ এবং এর ওজন প্রায় ৫২ কেজি। ডলফিন নিধন এভাবে অব্যাহত থাকলে জীববৈচিত্র্যে বিরূপ প্রভাব পড়বে। ডলফিন খুবই নিরীহ প্রাণী। নদীর যে অংশে পানির মান ভালো থাকে সেখানেই ডলফিন আসে। চোরা শিকারিরা হয়তো কোনো ধরনের কুসংস্কার থেকে ডলফিনটিকে কেটে হত্যা করেছে। ২০১৮ সালে করা জরিপে হালদায় ডলফিনের সংখ্যা ছিল ২০০টির মতো। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত হালদায় ২৪টি ডলফিনের মৃত্যু রেকর্ড করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি। মারা যাওয়া ডলফিনের ময়নাতদন্ত করে নৌকার ইঞ্জিনের আঘাতজনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে বলে জানা যায়। হালদাকে ডলফিনের অভয়ারণ্য ঘোষণার মাধ্যমে ডলফিন রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের একটি সুপারিশ করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। পরে এটির বিচরণ এলাকায় ট্রলার চলাচল নিষিদ্ধের পর ডলফিনের মৃত্যু কমে এসেছে। আর কর্ণফুলী নদীর অন্যতম আকর্ষণ ‘গেঞ্জেস ডলফিন’ বা গাঙ্গেয় ডলফিন। কর্ণফুলীতে মাত্রাতিরিক্ত দূষণের পরও এ প্রজাতির ডলফিনগুলো এখনো টিকে আছে। কর্ণফুলীতে প্রজনন শেষে এ ডলফিন বিচরণ করে শাখা নদী হালদা ও সাঙ্গুতে। হালদায় এখন মা মাছের ডিম ছাড়ার মৌসুম। নদীতে মা মাছের আনাগোনা বাড়ার সঙ্গে বেড়েছে চোরা শিকারিদের উৎপাত। জালে ডলফিন আটকালে আর মাছ ধরা পড়ে না বলে হালদা পাড়ে কুসংস্কার আছে। এভাবে ডলফিন হত্যার ধারণা যদি চোরা শিকারিদের মধ্যে ছড়ায় তাহলে হালদার ডলফিন রক্ষা কঠিন হবে। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) গাঙ্গেয় ডলফিনকে বিপন্ন হিসেবে লাল তালিকায় রেখেছে। ২০১২ সালের বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তফসিল-১ অনুসারে এই প্রজাতিটি সংরক্ষিত। আমরা চাই, কেবল ডলফিন নয়, সার্বিক অর্থে জলজ জীববৈত্র্যি সুরক্ষায় কর্তৃপক্ষকে সক্রিয় হতে হবে। অন্যথায় জলজ প্রতিবেশের বিলোপ পরিস্থিতি স্থলেও স¤প্রসারিত হবে। তবে এ ক্ষেত্রে আইনি পদক্ষেপের সাথে হালদার সুবিধাভোগীদেরও সচেতন হতে হবে।