হারুন ভাই একজন পরিশীলিত রাজনীতিবিদ

17

ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া

আবদুল্লাহ-আল হারুন চৌধুরী রাউজানের কৃতি সন্তান ও একজন পরিশীলিত রাজনীতিবিদ। আমি তাঁর সান্নিধ্যে আসি বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী কোন এক সময়ে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশ্ব বৌদ্ধ মনীষী, বাংলাদেশের বৌদ্ধ সমাজের অবিসংবাদিত নেতা ও সাংঘিক ব্যক্তিত্ব, বাংলাদেশ বৌদ্ধকৃষ্টি প্রচার সংঘের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, রাউজানের কৃতি সন্তান, বহু সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের জনক, মহামান্য মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরকে হারুন ভাই ‘কাকা’ বলে সম্বোধন করতেন। আর আমরা যেহেতু মহাথের আদর্শের অনুসারী সেহেতু আমরা হারুন ভাইকে বড় ভাইয়ের মতো সম্মান করতাম এবং দেখা হলেই ‘বদ্দা’ অর্থাৎ বড়দা বলে সম্বোধন করতাম। ছোট ভাই হিসেবে তিনিও আমাকে স্নেহ করতেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেই স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েছি। বাসায় গেলে ভাবীও সে রকম স্নেহ দেখাতেন এবং চা-নাস্তা না খেয়ে কোনদিনই আসতে পারিনি।
হারুন ভাইকে বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘ “বৌদ্ধ বন্ধু” উপাধিতে ভূষিত করেন। চট্টগ্রাম শহরের কাতালগঞ্জস্থ “নব পÐিত বিহার” প্রতিষ্ঠার পেছনে নেপথ্যে হারুন ভাই প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছেন। কুমিল্লা নিবাসী চট্টগ্রামে স্থায়ী বসবাসরত জনাব জাকির হোসেন ছিলেন এই জায়গার মালিক। হারুন ভাইয়ের সংগে জাকির সাহেবের সংগে ভালো সম্পর্ক ছিল বিধায় জাকির সাহেব মহাথেরকে এই জায়গা বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠার জন্য দিতে সম্মত হন। হারুন ভাইয়ের প্রভাবে এটি সম্ভব হয়েছিল। বৌদ্ধ সমাজ সব সময় হারুন ভাইয়ের নিকট কৃতজ্ঞ। নব পন্ডিত বিহারের বহু অনুষ্ঠানে হারুন ভাই উপস্থিত থেকে বৌদ্ধদেরকে সাহস যোগাতেন। যেহেতু নব পÐিত বিহারের সংগে আমি সম্পৃক্ত সেই সুবাদে আমি ব্যক্তিগতভাবে হারুন ভাইয়ের আরো কাছাকাছি আসি।
হারুন ভাই আমাদের এতই আপন ছিলেন যে যখনই মহামান্য মহাসংঘনায়ক ভান্তে ডাকতেন তখনই তাঁর কাছে চলে আসতেন। মহামান্য মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরর অন্ত্যেষ্টি অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেছিলেন হারুন ভাই। রাউজানের পূর্ব গুজরার হোয়ারাপাড়া গ্রামের সুদর্শন বিহার সংলগ্ন বিশাল প্যান্ডেলে দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠানের শুভ উদ্বোধনের সময় হারুন ভাই বলেছিলেন, আমার একজন পরম হিতাকাক্সক্ষী, উপদেশক আমার কাকা মহামান্য বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরকে হারিয়ে আমি ব্যথিত ও বেদনাহত, শোকাহত। মানবজাতির জন্য মাননীয় মহাথের যে অবদান রেখেছেন তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
অন্ত্যেষ্টি অনুষ্ঠানে উপস্থিত লাখো মানুষ তাঁর এই ভাষণে অভিভূত হয়েছিলেন। হারুন ভাই মহাথেরকে কি রকম যে শ্রদ্ধা করতেন তা ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না। এমন কি প্রয়োজন বোধে মহাথেরর ডাকে ঢাকায় চলে যেতেন। হারুন ভাইয়ের সহযোগিতা চিরকাল বৌদ্ধ সমাজ স্মরণ করবে। হারুন ভাই ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ। উদার রাজনীতিবিদ। মানবিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ পরোপকারী, মননশীল ব্যক্তিত্ব। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেনের আদর্শের ধারক। দ্বিজাতিতত্তে¡র ভিত্তিতে গঠিত পাকিস্তানে যখন বাঙালি জাতির মায়ের ভাষা বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানতে পশ্চিম পাকিস্তানি ও তার দালালেরা উদ্যত ফণা তুলেছিল সেই সময় হারুন ভাই চট্টগ্রামে বৈপ্লবিক চেতনায় ভাষা আন্দোলনে একজন সার্থক সংগঠকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। হারুন ভাই ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। পঞ্চাশের দশকে ও ষাটের দশকে ছাত্র ইউনিয়ন ছিল প্রগতিশীল ছাত্রদের একটি অন্যতম পুরোধা সংগঠন। ১৯৬০ সালে যখন আমি চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হই তখন আমিও ছাত্র ইউনিয়নের সমর্থক হয়ে পড়ি। ছাত্র ইউনিয়ন যখন মতিয়া ও মেনন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যায় তখন আমি মতিয়া গ্রুপের সমর্থক হয়ে পড়ি। এবং পরবর্তীকালে মতিয়া আপা যখন গ্রুপসহ আওয়ামী লীগে যোগদান করেন সেই থেকে আমিও আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ সমর্থক হয়ে পড়ি। হারুন ভাই এর রাজনৈতিক জীবনে দেখা যায় চট্টগ্রাম জেলা ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা হলেও ষাটের দশকে তিনি চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং পরবর্তীকালে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও সহ-সভাপতির পদ অলংকৃত করেছিলেন। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ৬ (ছয়) দফা ঘোষণা করেন। ঐ দফার পক্ষে হারুন ভাইসহ আরো পাঁচজন রাজনীতিবিদ স্থানীয় পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে ৬ (ছয়) দফাকে সমর্থন করেছিলেন তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে। ১৯৬৬ সালে আমি তখন ঢাকায়। ছয় দফার ঘোষণায় বাঙালি জাতি উদ্দীপ্ত হয়ে উঠে। গণ অভ্যুত্থানে ১৯৬৯ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে জেল থেকে বের করে আনার যে সংগ্রাম-আন্দোলন হয়েছিল তার সবগুলোতে হারুন ভাই ছিলেন সক্রিয়।
১৯৭০ সালে হারুন ভাই তখন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এমপিএ) নির্বাচিত হন। তখন আমি চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক। যেহেতু, আমিও রাউজানের সন্তান (উরকিরচর ইউনিয়নের আবুরখীল গ্রাম) সেহেতু রাউজানের খবরাখবর রাখাটাই স্বাভাবিক। জাতীয় পরিষদ সদস্য (এমএনএ) সর্বজন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ সাহেবের নির্বাচনে হারুন ভাই প্রচুর কর্মতৎপরতা এবং সহায়তা দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন, আমরা তা জানি।
নিজে প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক জীবনের সাথে সম্পৃক্ত না থাকলেও আমি হারুন ভাইকে দেখতাম কর্মনিষ্ঠ এক রাজনীতিবিদ হিসেবে। হারুন ভাইয়ের সংগে বিভিন্ন সময়ে আলাপচারিতায় বুঝতে পারতাম, রাজনীতি হচ্ছে জনগণের কল্যাণের জন্য। তাঁর মধ্যে শিক্ষার প্রতি প্রবল অনুরাগ লক্ষ্য করেছি। গহিরা হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আহমদ কবির চৌধুরী ছিলেন তার পিতা। সেই শিক্ষাব্রতীর পুত্র হারুন ভাই প্রতিষ্ঠা করেন গহিরা কলেজ।
কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড থেকে চট্টগ্রামকে আলাদা করে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠায় হারুন ভাই ছিলেন অন্যতম উদ্যোক্তা। হারুন ভাই প্রত্যেক বৈঠকে এমন কি মিছিলে আমাকে ডাকতেন। আমিও হারুন ভাইয়ের আহ্বানে সাড়া দিয়ে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলনে থাকতাম। এই আন্দোলনেরই সফলতা হচ্ছে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠা। শিক্ষার উন্নয়নে হারুন ভাই যে কত আন্তরিক চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠাই তার প্রমাণ। জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলামের পাশাপাশি থেকে ইউএসটিসিতে উপ-উপাচার্য হিসেবে তিনি যে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং ইউএসটিসি’র উন্নয়নে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছেন তা একবাক্যে সকলেই স্বীকার করবেন।
“দৈনিক স্বাধীনতা” নামক একটি পত্রিকা জামালখান থেকে হারুন ভাই প্রকাশ করতেন। আমাকে ছোট ভাই হিসেবে এতই স্নেহ করতেন যে তিনি আমাকে ঐ পত্রিকার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য করেছিলেন। আমি সত্যিই সেদিন অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম যেদিন তিনি আমাকে ফোনে বল্লেন যে, “বিকিরণ, তোমাকে আমার পত্রিকা ‘দৈনিক বাংলাদেশের স্বাধীনতা’ এর উপদেষ্টা পরিষদে রাখতে চাই, তোমার কোন আপত্তি নেই তো? আমি বল্লাম, “হারুন ভাই, এটি তো আমার জন্য পরম সৌভাগ্যের বিষয়, আমার কোন আপত্তি নেই”। একজন উদার, অসা¤প্রদায়িক, মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন রাজনীতিবিদ হারুন ভাই।
দুর্যোগে, দুঃসময়ে, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিপদগ্রস্ত মানুষের সহায়তায় হারুন ভাই সব সময় এগিয়ে এসেছেন। তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা, ত্যাগের মনোভাব, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল জাতির প্রতি ভালোবাসা সত্যিই অনুকরণীয়। যতদিন বেঁচেছিলেন মাস্টারদা সূর্যসেনের আদর্শ লালন করেছেন। মাস্টারদা সূর্যসেনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করতেন বলেই প্রতি বছরই তিনি সূর্যসেনের প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।
হারুন ভাইকে রাজনীতিতে সন্ত্রাসের প্রশ্রয় নিত দেখিনি। বর্তমান রাজনৈতিক ধারা থেকে ব্যতিক্রম ছিলেন হারুন ভাই। মানবকল্যাণের প্রতি তিনি ছিলেন সদা সচেতন। বলাবাহুল্য, চট্টগ্রামের মধ্যে রাউজান অনেক জ্ঞানী-গুণী, ধার্মিক ব্যক্তিত্ব, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদদের গর্বিত জনপদ। কিন্তু সেই রাউজানে আমরা প্রতিনিয়ত প্রাণ হারাতে দেখেছি। দেখেছি সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য। আমি আমার জীবনের একটা ছোট্ট ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই-রাউজান সম্পর্কে বাইরের লোকের ধারণা সম্পর্কে। সন্ত্রাস, খুন ইত্যাদি রাউজানকে এমন অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিল যে, নিজেকে রাউজানবাসী বলতেও মর্যাদাহানিকর মনে হতো। সে যাক্, আলবার্ট, আইনস্টাইন এবং এটম বোমা” সম্পর্কিত একটা লেখা জনকন্ঠ পত্রিকায় ছাপাবো মনস্থ করে লেখাটি টাইপ করে ঢাকা জনকন্ঠ পত্রিকা অফিসে হাজির হলাম। আমার তো ঐ পত্রিকা অফিসের কারো সংগে পরিচয় নেই। যা হোক, অনেক পরিচয় দিয়ে বলে-কয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির টেবিলে আমি উপস্থিত হলাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গিয়েছি বলাতে তিনি আমাকে সামনের চেয়ারে বসতে বল্লেন। আমি বলতে শুরু করলাম এবং লিখাটি ছাপাবার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলাম। সম্ভবত তিনি ঐ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হবেন। আমার লিখাটি হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলেন। ইতোমধ্যে এক কাপ চাও এসে গেলো। পড়া শেষ করে তিনি বল্লেন, রেখে যান, দেখবো। তারপর পরিচয় প্রসংগ ইত্যাদি কথাবার্তা বলতে বলতে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনার বাড়ি কোথায়। আমি বল্লাম, রাউজানে। যেই রাউজান বল্লাম, ওরে বাবা, সন্ত্রাসী জনপদ রাউজানে। শোনামাত্র যেন চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে ওঠার মতো। তাঁর এই মন্তব্য শুনে আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। লেখাটার ভাগ্য নিয়েও দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। যা হোক্, বেশ কিছুদিন পর আমার লেখাটা জনকন্ঠে প্রকাশিত হলো। কিছুদিন পরে জনকন্ঠ পত্রিকা থেকে পাঁচশত টাকার একটা চেকও পেলাম। ভালোই লাগলো। কিছু দিন পর আমি ঢাকা কলেজে এমএসসি পদার্থবিদ্যা প্রিলিমিনারি ব্যবহারিক পরীক্ষা নেওয়ার জন্য গেলে মৌখিক পরীক্ষায় এক ছাত্রকে জিজ্ঞেস করলে আইনস্টাইন সম্পর্কে কি জানো বলতে বল্লাম। সেই ছাত্র আমাকে বলে, আমি ক’দিন আগে জনকন্ঠে আলবার্ট আইনস্টাইন সম্পর্কে অমুকের একটা লেখা পড়েছি। আমি বল্লাম, সেটি আমার লেখা। ছেলেটি অবাক হয়ে গেলো। আমিও বেশ আনন্দিত হলাম। অন্ততপক্ষে একজন ছাত্রতো ঐ লেখা পড়েছে।
অথচ সন্ত্রাসের জনপদ রাউজান সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষ এতই জানতো যে আত্মপরিচয় গোপন করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। কিন্তু হারুন ভাইয়ের রাজনীতিতে কোনদিনই সন্ত্রাসের চিহ্নটুকুও দেখিনি। হারুন ভাই ছিলেন গণতন্ত্রের সংগঠক। সন্ত্রাস থেকে অনেক দূরে থেকে মানবসেবার ব্রতই ছিল তাঁর রাজনীতি।
রাউজানের রাজনীতিতে আমরা সন্ত্রাস যেমন চাইনা তেমনি সাম্প্রদায়িকতাও কামনা করি না। তাই প্রত্যেককে গণতান্ত্রিক সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে। কিছুদিন আগে থাইল্যান্ডে একটি আন্তঃধর্মীয় সম্মেলনে আমি যোগদান করি, সেখানে একটি ওয়ার্কশপে যুক্তিতর্কে স্বীকার করতে হয়েছে যে, আমাদের প্রথম পরিচয় হচ্ছে আমরা মানুষ। আমাদের দ্বিতীয় পরিচয়, আমরা কোন দেশের নাগরিক। আমাদের তৃতীয় পরিচয় হতে পারে আমরা কোন ধর্মের অনুসারী। যতদিন পর্যন্ত এই আত্মপরিচয়ের বিষয়টি সম্পর্কে আমরা সচেতন হতে না পারবো ততদিন আন্তঃধর্মীয় সংলাপ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে এবং এতে করে বিশ্ব শান্তি হবে সুদূরপরাহত। তাই আমাদের ভাবনার মধ্যে এই বিষয়গুলো প্রতিনিয়ত জাগ্রত থাকতে হবে, তাহলেই শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। আমি হারুন ভাইয়ের কাছাকাছি আসার মধ্য দিয়ে তাঁর মধ্যে এই মানসিকতার প্রভাব লক্ষ্য করেছি। মানুষকে মানুষ হিসেবে ভাবার যে অপার আনন্দ তা কি ভাষায় বর্ণনা করা যায়। সবচেয়ে বড় গুণ ছিলো হারুন ভাইয়ের সকলকে আপন করে নেয়ার।
রাজনীতির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা থাকতে পারে, প্রতিদ্ব›দ্বী থাকতে পারে। কিন্তু তাই বলে মনুষ্যত্ববোধ মর্মান্তিকভাবে উবে যাবে তাই কি হওয়া উচিত? হারুন ভাইয়ের জীবন ছিল বর্ণাঢ্য। তাঁর মধ্যে বিচক্ষণতা ছিল, দূরদর্শিতাও ছিল। তিনি বই পড়তে ভালোবাসতেন। জ্ঞানের ভুবনে বিচরণ করতে সচেষ্ট থাকতেন। গহিরা কলেজ প্রতিষ্ঠা করে রাউজানের ছাত্র/ছাত্রীদেরকে শিক্ষায় আলোকিত করার যে দূরদর্শিতা তা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। তাঁর মধ্যে সংস্কৃতিবোধ ছিল। সেজন্য তিনি একুশে মেলা ও স্বাধীনতা মেলার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিতে দ্বিধা করেননি। মহান একুশ ও স্বাধীনতা সমার্থক। একুশের পথ ধরেই স্বাধীনতায় উত্তীর্ণ হয়েছি আমরা।
রাজনীতির এই সুদীর্ঘ জীবনে হারুন ভাই অনেক জাতীয় রাজনীতিবিদের সংস্পর্শে এসেছেন। তাঁদের সংগে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে যদিওবা বেশি জানি না তবুও মনে হয় হারুন ভাই সকলেরই প্রিয় ছিলেন। হারুন ভাইয়ের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিনিয়ত কাজ করতো।
উপসংহারে উল্লেখ করতে চাই, বহু রজনীতিবিদদের সংগে আমার পরিচয় আছে। তবে হারুন ভাইয়ের যত কাছাকাছি এসেছি অন্য কারো সংগে অত কাছাকাছি যাবার আমার সুযোগ হয়নি। হারুন ভাই একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমি নিজেও মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে হারুন ভাইয়ের ভূমিকা ছিল গৌরবজনক। তবে হারুন ভাইয়ের সময়কার রাজনীতি এবং পরিবেশ বর্তমান সময়কার রাজনীতি ও পরিবেশে অনেক পার্থক্য। এখন রাজনীতি অসহনশীলতার রাজনীতি। তাই একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির মহান লক্ষ্যে পরমতসহিষ্ণুতার রাজনীতি, দেশপ্রেম, মানবিক মূল্যবোধের চেতনায় পরিশীলিত রাজনৈতিক চর্চা আবশ্যক স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করার সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের সোনার বাংলা গড়ে তোলার জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ভিশন ২০২১ বাস্তবায়ন করতে পারলেই একটি আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে আমরা সক্ষম হবো। এ জন্যে ঐক্যবদ্ধভাবে সকলকে এগিয়ে আসার আহŸান জানিয়ে হারুন ভাইয়ের প্রতি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে গভীরতম শ্রদ্ধা নিবেদন করে এখানেই শেষ করছি।

লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক