হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতায় ভাষাবিপ্লব

141

 

‘কবিতায় ভাষাবিপ্লব’ এমন শিরোনাম সাধারণ পাঠক বা সাহিত্যিকের কাছে বোধগম্য না-ও ঠেকতে পারে। কেননা, কবিতা বোধগম্য হবার আগেই সঞ্চারিত হয় পাঠকের মনে ও মননে। কবিতায় কবির স্বতঃস্ফ‚র্ত অনুভূতি-চিন্তা প্রকাশ পায় ভাষার মাধ্যমে। আবার ভাষা আর চিন্তা অনেকটা সমার্থক। মানুষ চিন্তা করে বলেই ভাষা ব্যবহার করে, ভাষা দিয়ে ভাবে আর চিস্তÍাকেই ভাষায় প্রকাশ করে। উনিশ শতকের ষাটের দশকে আবির্ভূত কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী (১৯৪৮- ) তাঁর কবিতার সৌধ সৃজন করেছেন এমন কাব্যভাষায়Ñযাকে ভাষাবিপ্লব অভিধায় অভিহিত করা অমূলক মনে হয় না মোটেই। কবি নিজেও বলেন, ‘কবিতা দর্শন নয় কিন্তু দর্শনের সমার্থক।’ আর কবির দর্শন বা দার্শনিক চিন্তা তাঁর কাব্যভাষাতেই আভাসিত হয় অনেকাংশে। কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর প্রায় ডজন তিনেক কাব্যগ্রন্থে আলোকপাত না করে আপাতত তাঁর জো (২০১৭) কাব্যগ্রন্থের পাঠ-আলোচনাতেই কবির কাব্যভাষায় প্র¯্রবনের মতো প্রবাহিত ভাষাবিপ্লব পাঠককে প্রত্যক্ষ করানোর জো পেয়ে যাব আশা করছি।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী (জন্ম: ৩১ ডিসেম্বর ১৯৪৮) পেশাগতভাবে একজন প্রকৌশলী ছিলেন বটে, বর্তমানে তাঁর খ্যাতি একজন কবি ও লেখক রূপে। তিনি বিশ শতকের আশির দশকে জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯১) এবং বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক একুশে পদক (২০১৬)-এ ভূষিত হন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের জন্মশতবর্ষেই তিনি লিখলেন বিপ্লব বসত করে ঘরে (১৯৯৯); বিশ শতকের শেষ-সালে আহব্বান জানালেন: জয় বাংলা বলোরে ভাই (২০০০)। একুশ শতকে ক্রমাগত লিখে চললেন: মুখোমুখি (২০০১), তুচ্ছ (২০০৩), হ্রী (২০০৫), কতো কাছে জলছত্র, কতোদূর চেরাপুঞ্জি (২০০৬), কাদামাখা পা (২০০৬), ভুলের কোনো শুদ্ধ বানান নেই (২০০৮), ইতিহাস বদমাশ হ’লে মানুষ বড়ো কষ্ট পায় (২০০৯), একা ও করুণা (২০১০), যমজ প্রণালী (২০১১), আমার জ্যামিতি (২০১২) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থগুলোর নাম দেখেই বলা যায় জয় বাংলা স্লোগান তোলার আহব্বান জানিয়ে শতাব্দী শেষ করে তিনি নতুন শতাব্দীর মুখোমুখি হলেন। নিজের জ্যামিতি জেনে-বুঝে-নিজেকে চিনে, তারপর তিনি লিখলেন জো; তাঁর ভাষায় ‘লেখকের সেরা বই’। শুধু তাই নয়, সে-বছর অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত সেরা কবিতা বই জো-এর জন্যে তিনি পান সিটি-আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার (২০১৭)। এক অর্থে এই কাব্যে কবি যেনো নিজেকেও অতিক্রম করে গেছেন-যেমন এর দর্শন-চিন্তা, তেমনি কাব্যভাষার বৈপ্লবিক পরিবর্তনে আর নতুনত্বে।
জো কবিতার বইকে তিনি ‘কাব্যগ্রন্থ’ না লিখে ‘কিতাব’ (আরবি-আগত বাংলা) লিখেছেন। বইয়ের ‘ভূমিকা’ বা ‘নিবেদন’ অংশকে লিখেছেন ‘কৈফৎ’। লক্ষণীয়, লেখ্য বাংলায় প্রচলিত এবং আরবি-আগত ‘কৈফিয়ত’ নয়, একেবারে লোকভাষা বা কথ্য ভাষার বুলিকে তিনি উঠিয়ে এনেছেন। তবে তাঁর ভাষা যে অবিমিশ্র নয় তাও কবি স্মরণ করিয়ে দ্যান: ‘অ-রে ঝাঁকাইয়া চন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত পৌঁছাইতে মুরগি-পাঁঠা এক খোঁয়াড়ে জিম্মায় ছিল, আবার মহিষ-শুয়ারের চামড়ায় পাটাতন ঢাকনের একটা ব্যাপার হুমকি দিয়া গ্যাছে।’ বাংলাদেশের গোঁড়া হিন্দুরা এখনও মুরগির মাংস খান না অথচ পাঁঠার মাংস খান। সিলেটের কিছু মন্দিরে এখনও বিয়ের অনুষ্ঠানে মুরোগের মাংস বারণ অথচ পাঁঠা-খাসিতে আপত্তি নেই। বলা বাহুল্য ‘মুর্গ’ তুর্কি শব্দের বাংলা অর্থ পাখি; এর সাথে বাংলা -ঈ প্রত্যয় যোগে মুরগী শব্দ গঠিত আর প্রমিত বানানে মুরগি। আবার, ধর্মীয় বারণ না থাকলেও অনেক মুসলিম পাঁঠার মাংস পছন্দ করেন না, হিন্দুরা খান বলে। সিরাজী সেই বিপরীত বৈশিষ্ট্যের বিশেষ্য দুটিকে হাইফেন দিয়ে এক সাথে ব্যবহার করে হিন্দু মুসলিমে সমন্বিত বাঙালি ও বাংলা ভাষাকেই প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর। একইভাবে মহিষ-শুয়ারের চামড়া প্রসঙ্গে কবির কথাতেই বলা যেতে পারে তিনি ‘বুলিতে গুলি সান্দাইয়া এক কিছিমের এলাকাবাজী, পদশোভায় মস্তানী’ করতে প্রয়াস চালিয়েছেন মনে হয়। তাঁর মস্তানেিত সহৃদয় পাঠক যাতে বিমুখ না হন সে-লক্ষ্যে এমন বৈপ্লবিক কাব্যভাষায় বিরাজ করেও কাব্যরসের নিশ্চয়তা দিয়ে আশার বাণী শোনাতেও ভুলেননি কবি: ‘মনে ও কানে কোন ভেদ না পৌঁছাইলে জিবলা বাড়াইতে পারেন। তিতা ঠেকিতে পারে, তবে বিষ হইবে না। শতভাগ নিশ্চিত।’ তেতো ফলও উপাদেয় বিশেষত হরিতকির স্বাদের মতো কিছু রস গ্রহণের পর মধুময় মনে হয়; জো কাব্যও তার ব্যতিক্রম নয়।
প্রথমেই কাব্যের নাম দেখে পাঠকের কাছে মনে হয় নতুন শব্দ। একটি বর্ণ একটি কার মিলে এক অক্ষরের নাম। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদে শব্দটির প্রয়োগ পাওয়ার পর আর নতুন শব্দ বলবার জো থাকে না। চর্যাপদে জো শব্দের প্রয়োগ: ‘জো রথে চড়িলা বাহবা ণ জাই কুলেঁ কুল বুড়ই।’ পালি ভাষা যো থেকে শব্দটির উৎপত্তি, এর মানে যে (সর্বনাম)। তবে আলোচ্য কাব্যগ্রন্থে শব্দটি বিশেষ্য রূপে ব্যবহৃত। লালন ফকির শব্দটি অনুক‚ল অবস্থা অর্থে ব্যবহার করে লিখেন, ‘যে জন রসিক চাষা হয় জমির জো বুঝে হাল বয়।’ অভিধানে [ সং. যোগ > ] সংস্কৃত-জাত শব্দটির একাধিক অর্থ রয়েছে: ‘জো বি ১ উপায়; পথ; ফাঁক; অস্বীকার করার জো নেই। ২ চাষের বা শস্য বপনের উপযুক্ত অবস্থা বা সময়। ৩ সুযোগ; অনুক‚ল অবস্থা; সুবিধা; জুত; জো পেয়ে গেছে। ৪ উপক্রম; গতিক; জোগাড়; দশা; উৎসব মাটি হবার জো।’ রবীন্দ্রনাথও উনিশ শতকেই একাধিক অর্থে ‘জো’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন: বি. উপায়। ‘নাকে তেল দিয়ে তাকিয়া ঠেসান দিয়ে বসে থাকবার জো নেই।’ রবীন্দ্র, ১৮৮১। বি. উপক্রম। ‘ধীবরের ঘর-দুয়ার ভাঙিয়া পড়িবার জো হইল।’ রবীন্দ্র, ১৮৯১। কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কাব্যেও জো একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অনেক সময় কাব্যিক ব্যঞ্জনা নিয়ে সে আভিধানিক মানে ডিঙিয়ে বাচ্যার্থের বাধ ভেঙে লক্ষ্যার্থের অভিমুখে ধাবিত হয়। কারণ সকলেই জানি, ‘কবি বা সৃজনশীল মানুষ শব্দকে ভাঙেন আর নতুন অর্থ দান করেন। শিল্পে নতুন ব্যঞ্জনায় উপস্ঞাপন করেন। শিল্পী শব্দ নিয়ে যা ভাবেন তা একেবারেই আলাদা- যেক্ষেত্রে ভেঙে যায় ব্যাকরণের নিয়ম-বিধি।’ সে শুধু কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী নয় যেকোনো সফল শিল্পীর ক্ষেত্রেই সত্য। সে-কারণে রবীন্দ্রনাথ লিখেন,
‘কবি আপনার গানে যত কথা কহে
নানা জনে লহে তার নানা অর্থ টানি
তোমা-পানে ধায় তার শেষ অর্থ খানি।’
এই নানান অর্থের মধ্য দিয়ে কবি একদিকে শব্দকে অভিধান থেকে মুক্ত করেন আরেক দিকে পাঠকের কল্পনার মুক্তি ঘটান। আর এভাবেই তৈরি হয় কবির স্বতন্ত্র কাব্যভাষা-যাকে ভাষাবিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা যায় নিভাষা বা ব্যক্তি-ভাষা। ব্যক্তি-ভাষার বৈশিষ্ট্যের কারণে একই সময়ে একই অঞ্চলে আভিভর্‚ত একই ভাষার দুজন কবির ভাষায় পাঠক অনায়াসে পার্থক্য খুঁজে পান। ভাষাবৈশিষ্ট্যের কারণেই লোকভাষা থেকে ব্যক্তিভাষা ভিন্ন হয়; লোক তাঁর আপন ব্যক্তিত্বে ব্যক্তিতে উন্নীত হয়, আর তাঁর রচিত সাহিত্য লোকসাহিত্য না হয়ে হয় আধুনিক সাহিত্য। কবি তাই লিখেন, ‘জো এই নামে পদ্যের একখানা কিতাব বাজারে ছাড়িয়াছি। ইচ্ছা ত’ অনেকই লয়, কিন্তু সাধ্যে কি সকল কুলায়? খামতি মানিয়া লইয়াই বাংলা ভাষার বর্ণমালাগুলি নাড়াচাড়া করিতে চাহিয়াছি। স্বর ও ব্যঞ্জনের অর্ধশত উপকূলে বীজ ফেলিয়া যাহা মিলিয়াছে তাহার সহিত মহাজনদের একটি সম্পর্ক তৈয়ারির প্রচেষ্টা জারি রখিয়াছি। মাইকেল কপোতাক্ষে ভর করিলে লালনেরে বলিয়াছি -দেখান ত’ গড়াইয়ের তেলেসমাতি! বিদ্যাসাগর মহাশয় চটি ফেলিয়া দামোদরে ঝাঁপ দিলে রবিবাবুরে নায়ের গলুইয়ে খাড়াইয়া ধান পাহারা দিতে বলিয়াছি। আবার সুলতানে যদি কুস্তি খাড়ে, খনারে লইয়া ব্যস্ত হইয়াছি লাঙলের ফলায়। জলায় যে উড়াল দেয় কৈতর! রে, রে, গালিব সাবের ফর্দের মইধ্যে বাহাদুর শাহ জাফর ফুচকি দিলে খানখান ভাইঙ্গ্যা পড়ে কিল্লার ইট। মাবুদ, তুমি জসীমউদ্দীনরে থুইয়া সিরাজীর তন স-রে লইয়া সইন্ধ্যাতারা ফোটাও।’ কবি সিরাজীর সে-সন্ধ্যাতারগুলোর দিকেই এবার চোখ ফেরানো যাক।
বইয়ের সূচিতে বর্ণগুলো দেখলে মনে হয় গানের বইয়ের মতো বর্ণ দিয়ে ক্রম সাজিয়েছেন কবি। কিন্তÍু পাঠে প্রবেশ করলে নজরে আসে প্রতিটি বাংলা বর্ণ ব্যবহার করে কবি একেকটি কবিতা লিখেছেন এবং বর্ণক্রম অনুসারে সাজিয়ে তাঁর বক্তব্য-চিন্তা-ভাবনা প্রকাশ করেছেন স্বকীয় কাব্যভাষায়। বাংলা ভাষার পঞ্চাশ বর্ণ উঠে আসে কবির পঞ্চাশটি কবিতার শিরোনাম হয়ে। প্রথম কবিতার প্রথম পঙক্তিদুটিতে পাই: ‘দোয়াত উল্টাইয়া গ্যালে স্বরেÑঅ তাকায়/ মধুসূদন আইস্যা যদি দুয়ারে খাড়ায়;’(‘অ’)। এভাবে প্রথম কবিতাতেই এসে হাজির হন আধুনিক বাংলা কবিতার জনক মাইকেল মধুসূদন দত্ত, যিনি বাংলা কাব্যভাষায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন। ভাষাবিপ্লবী কবির সে-স্মরণ যথার্থ। তবে প্রথম ও দ্বিতীয় কবিতায় ‘স্বরে-অ’, এবং ‘স্বরে-আ’ লিখা নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করতে হচ্ছে। আধুনিক বাংলা গদ্যের জনক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত বর্ণ পরিচয় প্রথম ভাগ (প্র.প্র.১৮৫৫)-এর ষষ্টিতম সংস্করণের (প্র.১৮৭৫) বিজ্ঞাপনে লিখেছেন, ‘প্রায়ই সর্ব্বত্র দৃষ্ট হইয়া থাকে বালকেরা অ, আ এই দুই বর্ণস্থলে স্বরের অ, স্বরের আ বলিয়া থাকে। যাহাতে তাহারা, সেরূপ না বলিয়া, কেবল অ, আ, এইরূপ বলে, তদ্রƒপ উপদেশ দেওয়া আবশ্যক।’ আসলে অর্ধসংবৃত ‘ও’ আর অর্ধবিবৃত ‘অ’ এর মধ্যে পার্থক্য করতে না পেরে অনেকেই এমন পাঠ করতেন, আর তার অনুকরণে ‘আ’-কেও ‘স্বরে’ বিশেষণ যুক্ত করে পঠিত হতো। যে পাঠ বর্তমানে বর্জিত। অবশ্য কাব্যে ছন্দের প্রয়োজনে অশ্রুকে অশ্রুজল বলাও দোষের নয়। এমন দু’একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে কাব্যখানার ভাষা ও শিল্পনৈপুণ্যের প্রশংসাই বেশি পাওয়া যাবে।
চিত্রকল্প আর শব্দাতীত ব্যঞ্জনা একাকার হয়ে ধরা দেয় কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতায়। কবি যখন বলেন: ‘একখান সোনার নাও ভইর‌্যা উঠলে ধানে/ গলুই কাঁপাইয়্যা রবি করে তার মানে!’ (্আ)। তখন একদিকে ধানের দেশ নদীর দেশ বাংলাদেশের চিত্রকল্প ভেসে আসে; আরেক দিকে রবীন্দ্রনাথের সোনারতরী কাব্যের ভাবজগতে নাইয়ে ঐতিহ্যসচেতন পাঠককে কল্পলোকে নিয়ে যান কবি সিরাজী। তার কিছু পরেই কবি নজরুলের প্রসঙ্গ তুলে পাঠকের সামনে তুলে আনেন সাম্যবাদের স্বপ্ন: ‘জন্মের লগেই উঁচা লাল ইশতাহার।’ (উ)। কারণ কবি বিশ্বাস করেন মানুষ যতই বিভেদ গড়–ক কিংবা ভেদ মেনে চলুক প্রকৃতি সুযোগ পেলেই সকল বিভেদ ধুয়ে একাকার করে দেয়: ‘আষাঢ়ের ঢলে সত্য জল-পানি সমন।’ (ঢ়)। তাইতো বঙ্গবন্ধুর সমাজতস্ত্রের মতো সিরাজীর সে-সাম্যবাদ যে চীন-রাশিয়ার নয় তা একান্তই স্বদেশের তার প্রমাণ তাঁর কাব্যভাষায় স্বদেশী আঞ্চলিক ভাষার অবাধ ব্যবহার নৈপুণ্য: ‘কি লুম্বা ফালাইব ঊ আন্ধারে বইস্যা?’ (ঊ)। আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে স্ল্যাং বা গালিও ব্যবহারে কবির বিদ্রোহী সত্তা সচেতন বলেই ওমোন প্রয়োগ সম্ভব। শুধু বাঙালির কথ্য বুলি নয় আদিবাসিদের ভাষাকেও তিনি নিপুণ হাতে কবিতার পংক্তিতে ঠাঁইদেন তাঁর কাব্যভাষার নৈপুণ্যে: ‘ঙাপ্পি/ নাপ্পির মইধ্যে সান্দায়্যা দ্যাও কোলাব্যাঙের ঠ্যাঙ’ (ঙ)। আঞ্চলিক ভাষার পাশাপাশি কবি বাংলার লোকভাষাকেও তার কাব্যভাষায় ঠাঁই দেন আপন মুন্সীয়ানায়: ‘হাসনের নায়ের লগি ঋ-তে আটকায় … কি ঘর বানাইব বংশ হাড়ের খাঁচায়?’ (ঋ)। এখানে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষা বাংলার লোকভাষায় পরিণত হয়ে উপরি পাওনা হিসেবে আমাদের উপহার দেয় আমাদের লোকসাহিত্যের গৌরবময় ঐতিহ্য-অহংকারের স্মৃতি। কবি সিরাজীর কলম থেকে যখন ঝরে: ‘ডালিম গাছের তলে বান্ধান কব্বর’ (এ)। তখন লোকজীবনের চিত্রকল্প পাঠককে মুগ্ধ করে তবে জসীমউদ্দীনের ‘কবর’ যেমন ‘কব্বর’ হয়ে নতুন কথা হয় তেমনি পাঠকও অনুভব করেন কবির এ-কাব্যভাষায় বিদ্রোহ আছে জব্বর।
মাতৃভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসা আর দখল থেকেই কবি বাংলা ভাষার বর্ণ-পরিচয়কে কাব্যিক সুষমায় সুশোভিত করে লিখেন: ‘ম্যাঘের খবর ধইর‌্যা জমিনে যে দেনা/ খ-এ খনি। খ-তেই খনন। খনা।’ (খ)। শুধু খনা আর খনার বচন নয় বাংলার লোকজীবনে প্রচলিত প্রবাদ-প্রচনও তাঁর কলম ছুঁয়ে কবিতার চরণে ঠাঁই পায় অনায়াসে। যেমন-‘মাঙে পায় না ভাত আর হ্যাতেনে চুলকায়’ (ঙ)। ‘ঘানিতে কলুর দামড়া আন্ধা ঘুইর‌্যা মরে’ (ট)। ‘হাতি ঘোড়া গেল তল পিঁপড়্যায় কয় কত জল’ (ঃ)। এসব প্রবাদ বাক্যে পল্লী বাংলার লোকভাষার সাথে সাথে লোকজীবনের একটি চিত্রও পাঠক পেয়ে যান। কিন্তু এই লোকভাষাকে কবির ব্যক্তিভাষা বা নিভাষার সাথে মিশিয়ে কাব্যভাষায় উপস্থাপন কবির স্বতন্ত্র শৈলীর পরিচয়বাহী। এই শৈলীগুণে কবি কেবল কল্পনার মুক্তি দেন না, কবিতার পাঠককেও মুক্তির এত্তেলা দিতে কবি কসুর করেন না। তাই তিনি লিখেন: ‘তারপরও সেপাইয়ের কার্তুজের ঢেলা/ বাহাদুর শাহ পার্কে দ্যায় মুক্তির এত্তেলা।’ (ঘ)। অনুপ্রাসময় কাব্যভাষায় আর চিত্রকল্পে কবি তুলে আনেন বাঙালির গর্বের একাত্তর-মুক্তিযুদ্ধ: ‘রাক্ষস খ্যাদায় পোলা সাল একাত্তর।’ (ত)। মুক্তিকে মনে লালন করেন বলেই কবি নয় মাসের মরণপণ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাওয়া স্বাধীন স্বদেশ- বাংলাদেশের প্রকৃতি, বাংলার অহংকার-ঐতিহ্য মিলে মিশে একাকার করে দেন কবিতার স্তবকে:
‘নয় মাস মাটিভাঙা শইলের ঘামে
খাঁচাখান যে সিংহের তার-ই প্রমাণ।
বাংলা বুঝনের কালে জাংলার জাড়
খুচা মাইর‌্যা কয়:
কী রে, এইবার পোষ মাসে
ঠিকঠাক ং নি অংপুর যায়?’ (ং)।
বাংলা ভাষার আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের মাধুরী কবিতার ভাষায় উপস্থাপনের ওমোন যাদুকরী প্রতিভা সিরাজীর মতো অতি অল্প কবিরই আছে। তাঁর পঙক্তি হয়ে আসে: ‘লওয়া ভাই ত’ লয়টার গাড়িতে লাজবাড়ি যাবিনে’ (ড়)। কিংবা, ‘কিতা বুঝলাইন’ (ছ), ‘উস্কায়’ (ষ) ইত্যাদি আঞ্চলিক ভাষার ক্রিয়াপদও তাদের বোধগম্যতা নিয়ে বাংলা বাক্যে প্রবেশ করে সিরাজীর হাত ধরে। কেননা তিনি নিজেই বলেন, ‘আমি সবসময় কবিতাকে সমাজ বদলের হাতিয়ার না বলে হৃদয় বদলের জিয়নকাঠি বলে মনে করি। যদি নিজের দেশ মাটি ও মানুষ সমুপস্থিত না থাকে তবে কবিতা বৈশ্বিক হবে না। কবিতা ভাষান্তরের পরও যদি তাতে দেশের মাটির গন্ধ অবশিষ্ট না থাকে তবে তাকে আমি মহৎ কবিতার তালিকাভুক্ত করতে রাজি নই। জীবনানন্দের কথাই ধরুন, তাঁর কবিতা অনুবাদের পরও বাংলাদেশ থাকে- শিশিরের শব্দ শোনা যায়।’ কথাগুলো কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর ক্ষেত্রেও সমান প্রাসঙ্গিক। তাঁর কবিতার ভাব-বক্তব্য হয়তো অনুবাদ করা যাবে, তবে ভাষা অনুবাদ করেও বাংলার সৌরভ সমূলে দূর করা অসম্ভব। বাংলাদেশের বেড়ে ওঠা আর বাঙালির বীজমন্ত্র যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা তারে কবি কবিতায় চিত্রিত করেন: ‘পশ্চিমে বন্দনা ধরে উত্তরে গম্বুজ/ মায় কয় লাল আর বাজানে সবুজ।’ (ত)। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের নিপুণ বুননে তুলে ধরেন নানান বৈচিত্র্য নিয়ে বেড়ে ওঠা বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার সাথে তাঁর প্রিয় পতাকাও।
অহংকার-ঐতিহ্যের পাশে আমাদের ব্যর্থতাও ভুললে ইতিহাসকে অস্বীকার করা হবে। তাতে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হবো। তাইতো দ্বিজাতি তত্ত্বের ধোয়া তোলে দেশভাগের যন্ত্রণা-পরিনাম কবি তোলে আনেন এভাবে: ‘একখান দ্যাশ ভাইঙ্গ্যা চুইর‌্যা মদনমোহন টানে/ জানল বালক বুঝল যুবক নুন-লবণের মানে।’(ব)। বাঙালির সপ্ন আর বাস্তবতার ব্যবধানকে কবি ফুটিয়ে তোলেন ব্যঞ্জনাময় কাব্যভাষায়: ‘পাতিল ও থলির মইধ্যে খোয়াব পাহারা।’ (ভ)। বাঙালি জমিদার শ্রেণির চাষা-নির্যতন, নানান শাস্তি দেওয়া-‘তক্তামারা’ প্রথাও তিনি চিত্রিত করেন: ‘ধইরা তক্তা মারলে প্যারাক ধ-তে পাইলা ঠ্যালা’ (ধ)। তার কারণ যে পরাধীনতা আর সে জন্যে দায়ী আমাদের মিরজাফর-বিভীষণের স্বরূপ মনে করাতেও কবি কসুর কনে না: ‘আজাইর‌্যা গলায় ঘণ্টা ক্যান যে লটকাও/ আরে, বিভীষণ গেল কই বিলাইড্যা আটকাও!’ (ষ)। পৌরাণিক ঐতিহ্যের সাথে অতীত গৌরব-ব্যর্থতা বিলকুল ওঠে আসে কবিতার শরীরে: ‘ভাগের ভাগ যুধিষ্ঠিররে য দিয়া খুচাইলে/ যদুপতি রথে বইস্যা অর্জুন দাবড়ায়/ দুর্যোধনে আগলি মারে আব্রূ দৌপদীর’ (য)। পুরাণের পাশাপাশি সমকালীন সমাজের বৈপরীত্য চমৎকার নাটকীয় কাব্যভাষায় তোলে আনেন কবি এভাবে: ‘ভাঁজ খোলা ধুতি থুইয়্যা গহবন সেলায়।’ (চ)। এত সব প্রতারণা-ব্যর্থতা দেখেও কবি হতাশ নন। তাঁর পাঠকের চিত্তেও আশাবাদ আর সম্ভাবনার সূর্য উঁকি দেয় যখন তিনি বলেন:
‘চাইয়া দেখ পুব কিনারে ফুটতে আছে ধলা
গরম কালে ধরম হইল দাদার কাছাখান
ঘামের লগে মোছন যাইব বঙ্গ-অভিধান।’ (র)
কবি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যতদিন বাংলা ভাষা বাঁচবে, ততোদিন বাঙালি বাঁচবে থাকবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব। সুতরাং, বাংলাদেশের অস্তিত্বের স্বার্থেই বাংলা ভাষাকে চর্চা-লালন আমাদের দায়িত্ব সে কথা ভুললে চলবে না। তাইতো কবি লিখেছেন, ‘জো নানা ঠিলায় ঠাঁই নাড়ায়। ভূমি পাইলে সুবিধার কথা বলে, আবার মনিষ্যি হইলে তাহারে ধরিয়া বাতলায় হুকুমের ফরমান। জানের জান, মওলা মেহেরবান; জো পাওয়া তাই ভার। তয় পাইলে কথা নাই, পয়মন্ত সকল এন্তেজার। …হিসাব-নিকাশ না করিয়াই জমিতে নামিয়াছিলাম। ভাবিয়াছিলাম জো পাইলে সবই হইবে। ব্যাছন ছিটাইয়া চারার অপেক্ষা; ফুল ফুটাইয়া, ফল ধরাইয়া তবে না গোলায় তোলার সওয়াল! জলের সহিত ভাব করিয়া, মাটির প্রেমে দিওয়ানা হইয়া, বাতাসের গায় ফররা উড়াইয়া, তাপের জিবলায় মাপ মিলাইয়া এই যে পদগুলান বিছাইলাম-তাহার এক্তিয়ারে এখন আমি আর নাই।’ কবির এমন ভাষাবিপ্লব পাঠককে ভাষা প্রেমে উদ্ধুদ্ধ করবে, ভাষার বৈচিত্র্যে মুগ্ধতা ছড়াবে সে কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
বাংলা বর্ণমালার পঞ্চাশ বর্ণের ক্যানভাসেই কবি সিরাজী বিনির্মাণ করতে প্রয়াসী হয়েছেন জো কাব্যের চিন্তা-ভাষা। বায়ান্নোর ভাষা-আন্দোলনের সময় থেকেই বাংলাদেশের কবিগণ আঞ্চলিক ভাষাকে বাংলা কবিতায় প্রয়োগে সচেতন-সক্রিয় হন। সৈয়দ শাসসুল হকের মাতৃভাষার প্রতি প্রাণের টানে লেখা পরানের গহীন ভিতর-এর কথা পাঠকের মনে পড়ে নিশ্চই। তাঁর নূরলদীনের সারাজীবন কাব্যনাটকের ‘জাগো বাহে কোনঠে সবাই’ ডাকেও তেমন সাড়া পড়ে না। কবি আল মাহমুদ সোনালি কাবিন কাব্যে লোকভাষা তোলে আনলেও এপর্যায়ে তিনি অনেকটা বাৎসায়নমুখি আর ক’দিন বাদেই সেমেটিক সভ্যতায় বিভোর। ব্যতিক্রম শুধু কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী; তিনি বাংলার আঞ্চলিক ভাষা আর লোকভাষা নিয়ে বর্ণনা করলেন বাংলার লোকজীবন-ইতিহাস-ঐতিহ্য। সাহিত্য-সমালোচকের ভাষায়: ‘ইতিহাসের বিজ্ঞান না-জানা, ইতিহাসের পাঠ স্পষ্ট না-থাকলে কবিতা উপলব্ধিতে সমস্যা হতেই পারে। এখানে বলা অসঙ্গত হবে ন যে, এ অস্পষ্টতা তৈরি হয় ধর্মীয়, সম্প্রদায় ও জাতিগত উগ্রতার প্রলেপের কারণে।’ কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কাছে সেই অস্পষ্টতা নেই বলেই তিনি তাঁর কাব্যগ্রন্থের শিরোনাম করতে পারেন: ইতিহাস বদমাশ হ’লে মানুষ বড়ো কষ্ট পায়। উগ্রতার সমূহ প্রলেপকে প্রত্যাখ্যান করে তিনি দ্রোহী হয়ে ওঠেন, অনুভব করেন বিপ্লব বসত করে ঘরে। আর ঘরের ভেতর শোনা-শেখা মায়ের-ভায়ের ভাষায় তিনি লিখেন জো কাব্যগ্রন্থ। তাই তাতে নিজের প্রতিস্বিকতা স্পষ্ট করতে তিনি স্বকীয় ভাষাশৈলী বা নিজ-ঢংয়ের ভাষা সৃষ্টিতে সচেষ্ট থেকেছেন। সঙ্গত কারণে সফলতাও পেয়েছেন। আঞ্চলিক ভাষা, লোকভাষা, ব্যক্তিগত উপভাষা আর প্রমিত বাংলা ভাষা সব মিলে মিশে গড়ে উঠেছে কবির কাব্যভাষা। তবে পাঠককে মনে রাখতে হবে এই ভাষাবিপ্লব বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে ভালোবেসে। বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করবার মানসে কবির এই কাব্যপ্রয়াসকে বা কবিতায় ভাষাবিপ্লবকে অস্বীকারের জো নেই কারোর।