হানাহানির রাজনীতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে

14

 

মানুষের জীবন অনেক বিচিত্র ঘটনার মধ্য দিয়ে কাটে। কেউ বলতে পারবে না জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তার সময় কেমন করে কাটবে? কখনো কখনো জীবন সুখে আনন্দে ভরা থাকে, কখনো জীবন থাকে দুঃখ বেদনায় ভরপুর। কখনো কখনো মানুষ শক্তিধর হয়ে উঠে, কখনো কখনো সে শক্তিহীন, অপরের সাহায্যের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রজীবন থেকেই জনগণের অধিকার আদায়ের রাজনীতি করতেন। তিনি তাঁর স্বল্পজীবনের বিরাট অংশ জেলে কাটিয়েছেন। ফাঁসির দড়ির মুখোমুখি হয়েছেন কিন্তু জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হননি। তিনিই বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধু পরিবারের সকল সদস্যকে। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বিদেশে ছিলেন। ভাগ্যক্রমে তারা বেঁচে যান। এখন প্রশ্ন হলো, তখন বিদেশে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানার অবস্থা কি হয়েছিলো? বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যগণ এবং উনার ভাই শেখ আবু নাসের ছাড়াও আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের পরিবার এবং শেখ ফজলুল হক মনির পরিবারের সদস্যদেরকেও হত্যা করা হয়েছিল। ধরতে গেলে, বিদেশে অবস্থানরত শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার জন্য পিতা, মাতা, ভাই ছাড়াও অন্য কোন আপনজন বেঁচে ছিলেন না। তারা দুই বোন সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। কিভাবে তারা ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে ভারতে এসে আশ্রয় পান সে এক করুণ ইতিহাস। খুব কম বাংলাদেশি ক‚টনীতিবিদ এগিয়ে এসেছিলেন। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এবং তাঁর স্ত্রীর মতো সাহসী ও ব্যতিক্রমী কিছু মানুষ এগিয়ে এসেছিলেন। মার্শাল টিটো এবং ইন্দিরা গান্ধীও বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার খোঁজখবর রেখেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৮১ সালের মে মাস পর্যন্ত বিদেশে কিভাবে বঙ্গবন্ধু কন্যাদ্বয়ের দিন কেটেছিলো, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি, যার জনক ছিলো তাদের পিতা। তারা কি পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলো সেই ইতিহাস সকলের জানা। যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিলো তারা ইনডেমনিটি আইনের বদৌলতে বিচারের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলো, তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে অনেক আনুকূল্য পেয়েছিলো। তারা কি বঙ্গবন্ধুর জীবিত দুই কন্যাকে হত্যা করার চিন্তা তাদের মনে গেঁথে রেখেছিলো? তা যদি না হয়, তাহলে কেনো শেখ হাসিনাকে প্রায় ২০ বার বিভিন্নভাবে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিলো? এর পিছনে হত্যাকারীদের প্রতি তৎকালীন শাসকদলের কি সমর্থন ছিলো?
হত্যার রাজনীতি কোন রাজনৈতিক দলের কাম্য হতে পারে না। হত্যার রাজনীতি কোন দেশের মানুষের জন্য কল্যাণ নিয়ে আসতে পারে না। যারা জবরদস্তি করে ক্ষমতা দখল করে, সে যেই হোক, তারা রাজনীতির উপকারের পরিবর্তে রাজনীতির বারোটা বাজিয়ে দেয়। আজ বাংলাদেশের রাজনীতির অবস্থা দেখুন, কোন ভালো লোক রাজনীতির কাছে আসতে চায় না। এমনকি রাজনৈতিক দলের সমাবেশে ভাড়া করে লোক নিতে হয়। আমলা, ব্যবসায়ী, শিল্পপতিরা বড়ো বড়ো রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন চায়। রাজনীতিতে চলে টাকার খেলা। আমরা ছোট খাটো লেখক হিসেবে রাজনীতির অন্দরমহলে কি ঘটে তা দেখতে পাই না, কিন্তু গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোনা যায় প্রায় সকল রাজনৈতিক দলে মনোনয়ন বাণিজ্য হয়, পদ বাণিজ্য হয়, টেন্ডারের ভাগাভাগি হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল কখনো না কখনো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ভোগ করেছে। তারাই বলতে পারবে তারা পদ বাণিজ্য, মনোনয়ন বাণিজ্য, টেন্ডারের ভাগাভাগি করেছিলো কিনা? এক সময়, যখন বিএনপি, জাতীয় পার্টির জন্ম হয়নাই-আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলনে লিপ্ত। যখন ছাত্রলীগের কর্মীরা পাকিস্তানি পুলিশের বন্দুকের সামনে মাথা উঁচু করে জয় বাংলা স্লোগান দিতো তখনকার কথা যদি আপনি স্মরণ করেন, আপনি জানতে পারবেন আওয়ামী লীগ সমাবেশ ডাকলে লাখো লাখো মানুষ সমাবেশে হাজির হতো। আজ রাজনীতি সেই পর্যায়ে নাই। রাজনীতির ভিতর ব্যবসা ঢুকে পড়েছে। কোন রাজনৈতিক দলে ভালো মানের কর্মীরা শান্তিতে নাই। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগ সন্ত্রাস বিরোধী র‌্যালি করতে চেয়েছিলো। তখন জেএমবি, হরকাতুল জিহাদসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন দেশব্যাপী তাÐব চালাচ্ছিলো। কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার জনসভাস্থলের পাশে ৭৬ কেজি ওজনের মহাবিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম বোমা পুঁতে রাখা হয়েছিলো। যে বোমা ফাটলে শেখ হাসিনাতো মারা যেতোই অর্ধেক গ্রাম তছনছ হয়ে যেতো। মুফতি হান্নান, বাংলা ভাইদের তাÐবের দীর্ঘ ফিরিস্তি দিতে চাই না। আওয়ামী লীগ তৎকালীন সরকারের কাছ থেকে সন্ত্রাস বিরোধী র‌্যালির অনুমতি না পেয়ে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ট্রাককে মঞ্চ বানিয়ে সন্ত্রাস বিরোধী সমাবেশের আয়োজন করেছিলো। সে সভায় শক্তিশালী আর্জেস ব্র্যান্ডের গ্রেনেড ছোড়া হয়েছিলো শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে। উনার পাশেই যে গ্রেনেড পড়েছিলো ভাগ্য ভালো সে গ্রেনেড ফাটেনি। আইভী রহমানসহ ২৪ জন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী মারা গিয়েছিলো। মেয়র হানিফসহ অন্যান্য কর্মীরা মানবব্যুহ রচনা করে শেখ হাসিনাকে উনার গাড়িতে তুলে দেওয়ার সময় উনার উপর গুলিও চালানো হয়েছিলো। সেই গুলি অল্পের জন্য শেখ হাসিনার গায়ে লাগেনি। সেই গুলিতে তার দেহরক্ষী মাহবুব মারা যায়। দেশে একটি গণতান্ত্রিক সরকার থাকা অবস্থায় সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রীকে এবং দেশের স্বাধীনতা অর্জনকারী রাজনৈতিক দলের নেতাদেরকে এইভাবে হত্যা করা হলো, আহত করা হলো, তখনকি দেশটি মগের মুল্লুক ছিলো?
আমার এই লেখা আরো দুইদিন পর প্রকাশিত হবে। যখন আমি লেখাটি লিখছি তখন ২১ আগস্টের স্মৃতি বার বার আমার মনে উঁকি দিচ্ছে। ২১ আগস্টের কথা মনে হলে সবার আগে আমার মনে পড়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার একটি বক্তব্য। তিনি সংসদে বলেছিলেন ‘শেখ হাসিনা ভ্যানিটি ব্যাগে করে সমাবেশে গ্রেনেড নিয়ে এসেছে’। এখানে প্রশ্ন উঠে, শেখ হাসিনা গ্রেনেড আনবেন কিভাবে? তখন সরকারের পুলিশ এবং গোয়েন্দারা কোথায় ছিলো? অবিস্ফোরিত গ্রেনেডকে হিসাবে ধরলে সেখানে ২০টির মতো গ্রেনেড ছোড়া হয়েছিলো। এতোগুলি গ্রেনেড শেখ হাসিনা কিভাবে বহন করলো? যারা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তারা ‘পিইকে এক্সপ্লোসিভ’ ব্যবহার করেছেন। হলুদ রংয়ের এই বিস্ফোরকের সাথে তাদেরকে ডেটোনেটর, কর্টেক্স, টাইম ফিউজ, ইগনেশন যন্ত্র দেওয়া হতো। গ্রেনেডের ভেতরে একটি ডেটোনেটর থাকে। তার সাথে থাকে একটি শক্তিশালী স্প্রিং। বাহিরে একটি লিভার থাকে যা পিন দিয়ে আটকানো অবস্থায় থাকে। লিভারটাকে হাতে চেপে ধরে পিন খুলে ফেলতে হয়। পিন খোলার পর গ্রেনেডটি লক্ষবস্তুর দিকে ছোড়া হয়। গ্রেনেডে কয়েক সেকেন্ডের ফিউজ থাকে। স্প্রিংয়ের আঘাতে ডেটোনেটর সক্রিয় হয়। গ্রেনেডের খোলের ভিতরে অনেক শক্তি তৈরি হয় যার চাপে গ্রেনেড ফেটে স্প্রিন্টারে রূপান্তরিত হয়। শেখ হাসিনার সমাবেশে তাকে লক্ষ্য করে আর্জেস গ্রেনেড ছোড়ার জন্য পাকিস্তান থেকে গ্রেনেড সংগ্রহের পাশাপাশি স্থানীয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ সন্ত্রাসীদেরকেও যোগাড় করা হয়েছিলো। পাঠক, আপনারাই বলুন ২১ আগস্টে যে গ্রেনেড হামলা হয়েছিলো সেই গ্রেনেড হামলা করার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সন্ত্রাসী কারা এনেছিলো? যারা গ্রেনেড মারার জন্য এসেছিলো তাদের ব্যাপারে পুলিশ বা গোয়েন্দারা কিছুই জানতো না? গ্রেনেড মারার পরে জর্জ মিয়া নাটক কারা সাজিয়েছিলো? গ্রেনেড হামলার পর পর আহতদের হাসপাতালে না নিয়ে কেনো পুলিশ লাঠিচার্জ এবং টিয়ারশেল নিক্ষেপ করেছিলো? কেনো আলামত নষ্ট করা হয়েছিলো? কারা আহতদের হাসপাতালে নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স আসতে বাধা দিয়েছিলো?
২১ আগস্টের ঘটনায় আল্লাহ্ শেখ হাসিনাকে রক্ষা করেছেন। একটি রাজনৈতিক দলকে চিরতরে ধ্বংস করে দেওয়ার চিন্তা ভাবনা করা উচিত নয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাজনৈতিক সহনশীলতার অভাব রয়েছে। পারস্পরিক সৌহার্দ্যরে অভাব রয়েছে। এখানে যতটুকু আদর্শগত বৈপরীত্য আছে সেটা থাকবে, এর সমাধান সম্ভব নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী কোন রাজনীতি বাংলাদেশের মানুষ গ্রহণ করবে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতেই এই দেশের রাজনীতি সামনে এগুবে। যারা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী, তাদের রাজনীতি কখনো জনগণ গ্রহণ করবে না। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা রাজনীতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নস্যাৎ করার সাধ্য কারো নাই। আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার যে চেষ্টা চালানো হয়েছিলো তার মধ্যে সবচাইতে জঘন্যতম ঘটনা দুইটি। একটি ঘটেছে ১৫ আগস্ট অন্যটি ঘটেছে ২১ আগস্ট। মানুষ এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি চায়না। এই ধরনের মনোভাব নিয়ে কারো রাজনীতিতে আসা উচিত নয়। রাজনীতিতে হানাহানি যেমন কাম্য নয় তেমনি রাজনীতিতে মনোনয়ন বাণিজ্য, পদ বাণিজ্য, অবৈধ সম্পদ অর্জনের চেষ্টা, বর্ণচোরাদের উৎপাত সাধারণ মানুষের কাম্য নয়।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কলামিস্ট