চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর নিয়ন্ত্রণ সংস্থা আল হাইআতুল উলয়া লিল জামি’আতিল কওমিয়া বাংলাদেশের অধীনে দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল) পরীক্ষা শুরু হয়েছে। অন্যদিকে মাদ্রাসায় অভ্যন্তরীণ দ্ব›দ্ব আর শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করা মাদ্রাসাটির প্রাক্তন মহাপরিচালক, দেশের প্রবীণ কওমী আলেম সদ্যপ্রয়াত আল্লামা শাহ আহমদ শফীর শূন্যতা মাদ্রাসার ছাত্র, শিক্ষক, ভক্ত-অনুরাগীদের এখনও কাঁদাচ্ছে। তারা এখনও ভিড় করছেন আল্লামা শফীর কবরে। তাদের অশ্রæজলে সিক্ত হচ্ছে প্রয়াত আল্লামা শফীর কবর মোবারক।
এদিকে, গত শনিবার সন্ধ্যায় হাটহাজারী মাদ্রাসায় অনুষ্ঠিত মজলিসে শুরার বৈঠকে শুরার নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্তিসহ নানা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। একই বৈঠকে গতকাল রবিবার থেকে মাদ্রাসার ক্লাস যথারীতি চালুর সিদ্ধান্ত হলেও মাদ্রাসার শিক্ষকরা শ্রেণি কক্ষের ক্লাস পুনর্বন্টনের সুপারিশ করে। ফলে ক্লাস শুরু করা যায়নি।
জানা গেছে, সংস্থাটির চেয়ারম্যান ও হেফাজতের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুতে গতকাল রবিবার পরীক্ষা শুরু হবে কিনা তা নিয়ে পরীক্ষার্থীদের সংশয় ছিল। তবে গত শনিবার হাইআতুল উলয়ার পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাওলানা মুহাম্মাদ ইসমাইল স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, পূর্ব উল্লেখিত সময়ে পরীক্ষার অনুষ্ঠিত হবে।
এরই ধারাবাহিকতায় সারাদেশের ন্যায় হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রায় ১৪’শ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়। এসব পরীক্ষার্থীরা মাদ্রাসার শিক্ষা ভবনের হল রুমে বসে পরীক্ষায় অংশ নেয়। পরীক্ষা শুরুর আগে শিক্ষক ও পরীক্ষার্থীরা সদ্য প্রয়াত মাদ্রাসাটির প্রাক্তন মহাপরিচালক আল্লামা আহমদ শফীর রুহের মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ মুনাজাত করে। এর আগে নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত মাদ্রাসার শিক্ষা পরিচালক ও প্রধান শায়খুল হাদিস এবং হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী উপস্থিত থেকে পরীক্ষার্থীদের প্রবেশপত্র সুষ্ঠুভাবে বিতরণ করেন।
পরীক্ষায় অংশ নেয়া মঞ্জুরুল হাসান নামে এক পরীক্ষার্থী পূর্বদেশকে জানান, পরীক্ষা শুরুর আগে আমরা সকলে বড় হুজুরের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছি। যদিও তাঁর (হুজুর) চলে যাওয়া আমরা মেনে নিতে পারছি না। যেহেতু এটি একটি কেন্দ্রীয় পরীক্ষা, তাই আমাদেরকে বাধ্য হয়ে অংশ নিতে হয়েছে।
এ ব্যাপারে মাদ্রাসার শিক্ষা পরিচালক ও হেফাজতের মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল) পরীক্ষা ১০ বিষয়ের হবে। আজকের পরীক্ষা ৩ ঘণ্টাব্যাপি সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমানে ৬টি বোর্ডের অন্তর্ভুক্ত বাংলাদেশের সবক’টি দাওরায়ে হাদিস কওমী মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা হাইআতুল উলয়ার অধীনে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। অনুষ্ঠিত এ পরীক্ষা শেষ হবে ২৯ সেপ্টেম্বর।
এদিকে, শনিবার সন্ধ্যায় ফটিকছড়ির নানুপুর মাদ্রাসার মুহতামিম ও হাটহাজারী মাদ্রাসার শুরা কমিটির সদস্য মাওলানা সালাউদ্দিন নানুপুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মজলিসে শুরার বৈঠকে শুরার নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তারা হলেন মারকাজুল ইসলাম মাদ্রাসার মুহতামিম মুফতি আবদুল মালেক (ঢাকা), মাদানীনগর মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা ফয়জুল্লাহ (ঢাকা), বাথুয়া মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা মুহাম্মদ শফি (হাটহাজারী), চারিয়া মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা আবদুল্লাহ (হাটহাজারী) ও মাওলানা শাহাদাত হোসেন (রাঙ্গুনিয়া)।
অন্যদিকে মাদ্রাসার অভ্যন্তরীণ দ্ব›দ্ব তথা ৬ দফা দাবিতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করা আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যু মাদ্রাসার ছাত্র, শিক্ষক, ভক্ত ও অনুরাগীরা এখনও মেনে নিতে পারছে না। দাফনের পর থেকেই তাঁর কবর জিয়ারত করা অব্যাহত রেখেছে ছাত্র, আলেম-ওলামা, জনসাধারণ ও ভক্তবৃন্দ। এ সময় মুনাজাতে অনেককে চোখের জল ফেলতে দেখা যায়।
টাঙ্গাইল থেকে আগত মুফতী সাইফুল ইসলাম জানান, আমি হাটহাজারী মাদ্রাসার সাবেক ছাত্র। বড় হুজুরের কাছে বুখারী পড়ার স্বপ্ন ছিল। আমার স্বপ্ন আল্লাহ কবুল করেছেন। হুজুরের মৃত্যুর খবর শুনার পর ৭০ জনের একটি কাফেলা নিয়ে জানাজায় এসেছি। অধিকাংশ সঙ্গীরা চলে গেলেও আমি রয়ে গেছি। এ হাটহাজারী আমার জীবন পরিবর্তনে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। এ মায়া ছেড়ে চলে যেতে মন চাইছে না। বড় হুজুরের জন্য মনে কাঁদছে। শতবর্ষী এ মহান নেতা ও সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার বিয়োগ দেশের ধর্মীয় অঙ্গনে কতটা শূন্যতা তৈরি করেছে তা আদৌ পূরণ হবে কি না তা বুঝতে অপেক্ষা করতে হবে আমাদের।
প্রসঙ্গত, আল্লামা আহমদ শফী ছিলেন একাধারে দেশের সর্ববৃহৎ কওমী মাদ্রাসার প্রাক্তন মহাপরিচালক, সম্মিলিত কওমী মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড হাইয়াতুল উলয়ার, বেফাকের চেয়ারম্যান এবং হেফাজতে ইসলামের আমির। দেশের ইতিহাসে একই সঙ্গে এতগুলো শীর্ষ পদে থেকে সুচারুরূপে দায়িত্ব পালন করা আল্লামা আহমদ শফী গত শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানী ঢাকার গেÐারিয়ার আসগর আলী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন।
