হাটহাজারীতে হেফাজত-পুলিশ সংঘর্ষে নিহত ৪, আহত ৫০

140

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনের বিরোধিতা করে মোদিবিরোধী বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে হাটহাজারী রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এতে পুলিশের গুলিতে হাটহাজারী মাদ্রাসার তিন ছাত্র ও একজন পথচারী নিহত হয়েছেন। এছাড়া পুলিশ ও মাদ্রাসা ছাত্রদের দফায় দফায় সংঘর্ষে মাদ্রাসার ছাত্র, পথচারী, সাংবাদিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ প্রায় অর্ধশতাধিক আহত হন।গত শুক্রবার জুমার নামাজের পর হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
সংঘর্ষের জেরে মাদ্রাসার ছাত্ররা হাটহাজারী থানা কার্যালয়, ভূমি অফিস ও ডাক বাংলোতে ভাঙচুর চালায়। তাছাড়া মাদ্রাসা ছাত্রদের বিরুদ্ধে অস্ত্র লুট ও ভূমি অফিসে অগ্নিসংযোগ করার অভিযোগ উঠেছে। তবে মাদ্রাসা ছাত্রদের অভিযোগ, শান্তিপূর্ণ মিছিলে বিনা উস্কানিতে পুলিশ তাদের উপর চড়াও হয় এবং এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে। এ সময় চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে।
প্রত্যক্ষদর্শী, থানা পুলিশ ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থী সূত্রে জানা যায়, মোদির বাংলাদেশ সফরের প্রতিবাদে শুক্রবার জুমার নামাজের পর দুপুর আড়াইটার দিকে হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্ররা মাদ্রাসার সামনে থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিলটি মাদ্রাসা এলাকা অতিক্রম করার সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বাধা এড়িয়ে থানার সামনে গেলে তারা ফের বাধার সম্মুখীন হন। এ সময় উত্তেজিত মাদ্রাসা ছাত্ররা থানা কার্যালয় লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। এক পর্যায়ে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে গুলি ছুঁড়লে বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হন। তাদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এদের মধ্যে তিনজন ছাত্র ও একজন পথচারীসহ চারজন নিহত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন চমেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির সহকারী উপ-পরিদর্শক আলাউদ্দীন তালুকদার। তিনি জানান, সংঘর্ষের ঘটনায় আহত অনেককে হাসপাতালে আনা হয়। এর মধ্যে বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি হওয়া চারজনকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। নিহতরা হলেন হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্র কুমিল্লা জেলার মো. রবিউল ইসলাম, মাদারীপুর জেলার মো. মেহরাজুল ইসলাম, ময়মনসিংহ জেলার মো. আব্দুল্লাহ মিজান এবং পথচারী হাটহাজারী উপজেলার মো. জসিম।
নিহতের খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষুদ্ধ মাদ্রাসা ছাত্ররা চার পুলিশ কর্মকর্তাকে অবরুদ্ধ করে মারধর করে। তাদের মধ্যে এএসপি (শিক্ষানবীশ) প্রবীর ফারাবী ও এসআই মেহেদী গুরুতর আহত হন। তাদের উন্নত চিকিৎসার জন্য সিএমএইচে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে। এ সময় তাদের কাছ থেকে একটি পিস্তল ছিনিয়ে নেয়ার অভিযোগ করেছে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হাটহাজারী সার্কেল) শাহাদাৎ হোসেন। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ থানায় হামলা করা হয়েছে। আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছি। তবে মাদ্রাসার বিক্ষুদ্ধ ছাত্ররা চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়কের সামনে অবস্থান নেওয়ায় যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বিভিন্ন স্থানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।’
তাছাড়া থানায় হামলার পর বিক্ষুদ্ধ মাদ্রাসা ছাত্ররা ভূমি অফিসে ঢুকেও ভাঙচুর করে। ভূমি অফিসের ফাইল-আসবাবপত্র সব জড়ো করে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় হাটহাজারী প্রেস ক্লাবের সদস্য সাংবাদিক খোরশেদ আলম আহত হন।
ভূমি অফিসের একটি গাড়িতেও আগুন ধরিয়ে দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন। তিনি বলেন, আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের ভূমি অফিসে প্রবেশে বাধা দেয় হামলাকারীরা। তারা শুধু ভূমি অফিস নয়, উপজেলার ডাক বাংলোতে ঢুকেও ব্যাপক ভাঙচুর করে। প্রশাসন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে।
চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উত্তর) মছিউদ্দৌল্লাহ রেজা বলেন, মাদ্রাসা থেকে বের হয়ে ছাত্ররা বিনা উস্কানিতে থানায় হামলা চালায়। তারা থানা কম্পাউন্ডে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়।
ঘটনার ব্যাপারে জানতে হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষক ও পরিচালনা কমিটির সদস্য মাওলানা ইয়াহিয়ার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি অসুস্থ আছেন জানিয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে হেফাজত ইসলামের প্রচার সম্পাদক জাকারিয়া নোমান ফয়েজী জানান, জুমার নামাজের পর মাদ্রাসার ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ কোনো কারণ ছাড়াই ছাত্রদের উপর গুলি ছুঁড়ে। এতে চারজন নিহত হয়। পরে পুলিশের সঙ্গে ছাত্ররা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
ঘটনার খরব পেয়ে হাটহাজারীর সাংসদ ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. আনোয়ার হোসেন, চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) এস এম রশিদুল হকসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন।
ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেন জানান, ‘আমরা এ রকম পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। কারণ তারা হরহামেশা মিছিল করে। কিন্তু তারা এবার হঠাৎ থানা কার্যালয় লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করায় আমরা হতভম্ব। বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে।’
ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, ‘এটি একটি অনাকাঙ্খিত ঘটনা। এ ঘটনায় যারা মৃত্যুবরণ করেছে তাদের জন্য আমি দুঃখ প্রকাশ করছি। এছাড়া বিষয়টি নিয়ে হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষা পরিচালক ও হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর সাথে কথা হয়েছে। ওনি পটিয়া থেকে হাটহাজারীতে আসলে আমরা এ ব্যাপারে আলোচনায় বসবো।’
এ ঘটনার পর বিক্ষুদ্ধ ছাত্ররা হাটহাজারী মাদ্রাসার সামনে অবস্থান নিয়ে চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়ক অবরোধ করে রেখেছে। সন্ধ্যা নাগাদ পুলিশের সাথে ফের সংঘর্ষে জড়ালে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কাদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এসময় বিক্ষুব্ধ মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা ডাক বাংলোতে ঢুকে হামলা চালায় ও বিভিন্ন আসবাবপত্র ভাঙচুর করে। বর্তমানে ঘটনাস্থলের আশপাশে প্রচুর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েনের পাশাপাশি হাটহাজারী থানার সামনে প্রশাসন ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অবস্থান নেন। হাটহাজারী বাসস্ট্যান্ডে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও অবস্থান নেয়।
অন্যদিকে, গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে সাংসদ ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের নেতৃত্বে হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষক ও হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মুফতি জসিম উদ্দিন, হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব নাসির উদ্দিন মুনির, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইদরিসসহ একটি প্রতিনিধি দলের সাথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি বৈঠক চলছে বলে জানা গেছে।
চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়ক এখনো মাদ্রাসা ছাত্রদের দখলেই রয়েছে। তবে সংঘর্ষের ঘটনায় থানায় কোনো মামলা দায়ের হয়নি। গত শুক্রবার রাত থেকেই উক্ত মহাসড়ক দিয়ে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। চট্টগ্রাম-নাজিরহাট রেল লাইনে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক থাকলেও শনিবার সকালের দিকে হাটহাজারী স্টেশনে মাদ্রাসা ছাত্ররা অবস্থান নেয়ার পর থেকে উক্ত রেল লাইনে কঠোর নিরাপত্তা জোরদার করে রেলওয়ে।
জানা যায়, শনিবার সকাল থেকে গোটা হাটহাজারী উপজেলায় বিরাজ করছে থমথমে পরিস্থিতি। ঘটনার পর থেকে হাটহাজারী বাজারের সকল প্রকার দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে এক ধরনের আতঙ্ক। এলাকায় উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে উপজেলার নানা স্থানে অতিরিক্ত র‌্যাব ও পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া বিজিবি’র ১০ প্লাটুন সদস্য মোতায়েন রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের রাস্তার বিভিন্ন স্থানে টহল দিতে দেখা যায়।
সরেজমিনে দেখা যায়, ওই ঘটনার প্রতিবাদে হাটহাজারী মাদ্রাসার বিক্ষুদ্ধ ছাত্ররা উক্ত মহাসড়ক কেটে লÐভÐ করে মাদ্রাসার সামনে ইট-সিমেন্টের দেয়াল তুলে ব্যারিকেড দিয়ে সেখানে বিক্ষোভ করছে। তাছাড়া মহাসড়কের ওপর বাঁশের ব্যারিকেড দিয়ে তারা এখনও সড়কে অবস্থান করছে। এতে চট্টগ্রামের হাটহাজারী-খাগড়াছড়ি সড়কে যান চলাচল এখনও বন্ধ রয়েছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন ওই সড়ক দিয়ে যাতায়াত করা নাজিরহাট, ফটিকছড়ি, খাগড়াছড়ি ও রামগড়সহ প্রায় ৩০ রুটের যাত্রীরা।
শুক্রবার বিকেল থেকে সড়ক অবরোধ থাকায় খাগড়াছড়ি, নাজিরহাট, ফটিকছড়ির বাসিন্দাদের শহরে আসতে ভোগান্তি হয়। গাড়ি আটকে যাওয়ায় অনেকে পায়ে হেঁটে হাটহাজারী বাসস্ট্যান্ড এসে গাড়িতে ওঠেন। আবার অনেকে ভেতরের রাস্তা দিয়ে দিয়ে বাসস্ট্যান্ড আসেন।
পুলিশের সঙ্গে মাদ্রাসা ছাত্রদের সঙ্গে সংঘর্ষে চারজন নিহতের ঘটনায় কোনো মামলা দায়ের হয়নি বলে জানান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হাটহাজারী সার্কেল) মো. শাহাদাৎ হোসেন। এ ব্যাপারে চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার এস এম রাশিদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা দফায় দফায় বৈঠকে করে যাচ্ছি। শুক্রবার দুপুর থেকে আমিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে রয়েছি। আমরা গতকালের (শুক্রবারের) সংঘর্ষের ঘটনা নিয়ে কাজ করছি।’
এদিকে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সাংসদ ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এমপি’র মধ্যস্থতায় হাটহাজারী মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ও চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে থানায় দ্বিপক্ষীয় বৈঠক ৪ বার অনুষ্ঠিত হয়।
সমঝোতার অংশ হিসেবে নিহত ছাত্রদের লাশ ময়না তদন্ত ছাড়া প্রশাসন দাফনের অনুমতি দিলেও বিক্ষুদ্ধ ছাত্রদের দাবি অনুয়ায়ী হাটহাজারী মাদ্রাসায় নিহতদের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়নি। তবে, ঘটনার দিন শুক্রবার বিকালে মাদ্রাসা ছাত্রদের হাতে অবরুদ্ধ থাকা গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য মো. সোলায়মানকে শনিবার বিকালে হেফাজত নেবৃতৃন্দ থানায় স্থানীয় সাংসদ, ডিআইজি, পুলিশ সুপারের উপস্থিতিতে হস্তান্তর করা হয়। তবে থানা পুলিশের খোয়া যাওয়া অস্ত্রের বিষয়টি ওই বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়নি।
এ সময় ডিআইজি, পুলিশ সুপারের উপস্থিতিতে স্থানীয় সাংসদ ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের সাথে কথা হয়েছে নিহত মাদ্রাসা ছাত্রদের লাশ হাটহাজারীতে না এনে ময়না তদন্ত ছাড়াই তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
মাদ্রাসা ছাত্রদের দাবির প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট হাটহাজারী মডেল থানার ওসি রফিকুল ইসলামকে প্রত্যাহারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি পুলিশের প্রশাসনিক বিষয়। ওরাই তদন্ত করে দেখবে এবং পরবর্তীতে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবে।