হাইক – এক ক্ষুদ্রকাব্য

63

 

আজ সকাল থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। এক কবি বন্ধু সে সুযোগে ভেবেছিল, আমাকে খানিকটা বিব্রত করা করা যায় কিনা। হাসতে হাসতে সে বলে ফেলল, হাইকু সম্পর্কে আপনার ধারনা কি।
আমি তাকে বলেছিলাম, আমি মূলত তেমন কিছুই জানি না। সব বিষয়ে যে জানবো তা কিন্তু নয় । সে আমার কথা শুনে কি ভেবে হাসতে লাগলো। সে হয়ত ভেবেছিল আমার ধারণা শূন্যের কোঠায়। যাই হোক, হাইকু নিয়ে তাকে সংক্ষেপে যা বলেছিলাম তার খানিকটা লিখার চেষ্টা মাত্র।
হাইকু হল জাপানি বড় কবিতার ক্ষুদ্রতম একটি রূপ। প্রাথমিক পর্যায়ে ৫-৭-৫ অক্ষরের সিলেবলে হয়। ‘হক্কু’ নামে লেখা হয়।
আগে ‘রেঙ্গা’ কবিতা ৫-৭-৫-৭-৭ ‘অক্ষরের সিলেবল’ মোট পাঁচটি ছোট লাইনে লেখা হতো। ‘রেঙ্গা’ কবিতাকে অনেকে তান্কা কবিতাও বলে। জাপানের ‘Heian Period’ (৭৯৪-১১৮৫) ‘রেঙ্গা’ কবিতা -বিভিন্ন কবিরা ও রাজ দরবারের অভিজাত ব্যক্তিত্ববর্গ রেঙ্গা বা ‘তানকা’ কবিতার প্রবর্তন করেন। তখন থেকেই রেঙ্গা কবিতার প্রচলন হয়। সেই কবিতা গুলি ‘হাইকাই’ (Haikai) এর মতোই কিন্তু এই ধরনের কবিতা ছিল হাস্যরসাত্বক, তাতে কিছুটা নিম্ন মানের শীল্পবোধ ছিল। তবে এই ধরনের কবিতা সতের ‘শ’ শতাব্দী পর্যন্ত অভিজাত ব্যবসায়ীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। অন্যদিকে এই কবিতাগুলি বেশ জনপ্রিয়, আনন্দ দায়ক ছিল। সে যাই হোক, ক্রমাগত কবিতার বিবর্তনে সেই রেঙ্গা বা তানকা বা ওয়াকা কবিতা থেকেই হাইকু কবিতার সৃষ্টি হয়েছে।
এখানে অন্তমিল দরকার নেই। মোট তিন লাইনের হবে। কোনো দাড়ি, কমা থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষোভাবে ঋতু বৈচিত্রের উল্লেখ থাকলে ভাল।
পৃথিবী সবচেয়ে ছোট কাব্য হাইকু। গঠন হবে ৫+৭+৫ মোট -অক্ষরের সিলেবলে। মূলত ‘হক্কু’ কবিতায় পরিবর্তন আনেন- মাৎচুঅ বাশো (১৬৪৪-১৬৯৪)। তখন অন্যান্য ‘তানকা বা ওয়াকা’ কবিতা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে ৫-৭-৫ ‘অক্ষরের সিলেবলে’ তিনি ক্ষুদ্র কবিতার প্রচলন করেন। তারপরে মাসওয়াকা সিটি (১৮৬৭ -১৯০২) বাশোর কবিতার নতুন নামকরণ করেন এবং ‘হাইকু’ নামে প্রচলন করেন।
“History of Japanese Culture, 1959” বইটিতে ইনেনাগা সাবুরো নামে একজন বিখ্যাত ঐতিহাসিক লিখেন যে, হাইকু লেখার নিয়ম বেশ সহজ। তবে আমার কাছে মনে হয় অনেক কঠিন। হাইকুতে ১৭ টি অক্ষরের সিলেবল থাকে এবং তিন ভাগে বিভক্ত থাকে। আমরা জানি যে, সিলেবল্ মানে জিহব্বার গতি না বদলিয়ে একবারে উচ্চারণে সক্ষম শব্দ বা শব্দাংশ- এক স্বরবিশিষ্ট শব্দ বা শব্দাংশ। ছন্দ কবিতায় একস্বর বিশিষ্ট সিলেবল দেখা যায়।
জাপানের বর্তমান প্রজম্ম শুধু হিরাগানা অক্ষরে ৫-৭-৫ গুনেই হাইকু লিখেন। আর এই হিরাগানা অক্ষরের শব্দকেই “অনজি” বলা হয়।তারা মনে করেন শব্দের rythom বা ছন্দ মিলিয়ে লিখলেই হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় চমৎকার সব হাইকু রচিত হলেও বাংলা ভাষায় হাইকু হয়নি খুব বেশী। বাংলায় হাইকুর প্রসার না ঘটার অন্যতম কারণ, কঠোর নিয়ম ও অতি সংক্ষিপ্ততার কারণে তিনলাইনে সেই ভাবের জানালাটি ঠিক মতো আমরা খুলতে পারি না।
গভীর ভাবনার অপর নাম হাইকু।বিশ্বের ক্ষুদ্রতম কবিতা হাইকু । বড়ো কবিতার সংক্ষিপ্ততম রূপ। হাইকুতে রয়েছে বিরাট ও বিস্তৃত ভাবনা অর্থাৎ বিন্দুতে সিন্ধুর প্রতিফলন। হাইকু জাপানি শব্দ হলে ও বর্তমানে হাইকু শব্দটি সারা পৃথিবী গ্রহণ করেছে। জাপানিরাই প্রথম হাইকুচর্চা শুরু করে। হাইকুর সাথে জাপানি জাতি ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। উনবিংশ শতাব্দীতে হাইকুর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ওঠে। বর্তমানে সারা বিশ্বে ক্ষুদ্রতম কবিতা হিসাবে ‘হাইকু’ পরিচিতি লাভ করে।
যে জিনিসই ছুঁই মমতায়/সে জিনিসই বিদ্ধ করে আমাকে/কাঁটাঝোপের কাঁটার ন্যায়-কোবাইশি ইসা। বা জোনাকি উড়ে যায়/এত দ্রæত এত নিঃশব্দে/আলোটুকু ফেলে যায়-মাৎসুও বাশোর (১৬৪৪-৯৪) হাইকু। হাইকু তে মূলত চারটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় তা হলো-দুটো ভিন্ন চিত্রকল্পের মিশ্রণ বা উপস্থাপন রীতিতে তৈরি হয়। ৫+৭+৫=১৭ মাত্রা বা ধ্বনি, উচ্চারিত বর্ণ-দ্বারা গঠিত হবে। ঋতু বা প্রকৃতি বিষয়ক শব্দের ব্যবহার থাকবে। কবিতার বিষয় বস্তুতে থাকবে গভীরতা, চিন্তাশীলতার ছাপ। স্তব্ধতা, রহস্যময়তা, রিক্ততা এবং নশ্বরতা সাধারণত হাইকুতে ফুটে ওঠে। গাছ, ফুল, ফল, পাখি ও ঋতুই হলো হাইকুর প্রধান উপাদান। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে হাইকুর প্রসার ঘটতে থাকে। হাইকু সম্পর্কে বাশো- রবীন্দ্রনাথের উক্তি স্মরণযোগ্য। বাশো বলতেন, একজীবনে যিনি তিন থেকে পাঁচটি প্রকৃত হাইকু লিখতে পারেন তিনিই হাইকু কবি,আর দশটি লিখতে পারলে হাইকুমাস্টার । আমি এই জীবনে লিখার চেষ্টা করছি, লিখতে পারবো কিনা জানি না (প্রকৃত অর্থে লিখতে পারবো কিনা) যদি পারি তাহলে আমি হয়ত হাইকু কবি না হয় মাষ্টার। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় এই বৈশ্বিক করোনায় শিরোর হাইকুর মত যদি বলি তাহলে বলতে হয়-Nothing happening and yet spring begins on this morning..
কবি নির্মলেন্দু গুণের বঙ্গানুবাদে -কিছুই ঘটছে না /তবুও বসন্ত আজ/ ভোর থেকে শুরু। আসুন, মানুষকে ভালবাসি, মানবতাবিরোধী সব কর্মের বিরুদ্ধে লড়াই করে প্রতিটি জীবনে বসন্ত এসেছে ভেবে সব কর্মযজ্ঞ জীবনের প্রতি ভোর থেকে আমরা যেন শুরু করি।