হরিধানের উদ্ভাবক হরিপদ কাপালী

210

পূর্বদেশ ডেস্ক

ভাঙাচোরা ঘর, বর্ষায় চাল চুয়ে পড়ে পানি। খরা কিংবা বন্যায় ধানের আবাদ নষ্ট হলে সারাবছর চলতে হতো ভীষণ অভাবে। প্রত্যন্ত গ্রামের একজন অক্ষরজ্ঞানহীন দরিদ্র কৃষক কি কখনো কৃষি বিজ্ঞানী হতে পারেন? হতে পারেন উদ্ভাবক? যার কপালে নেই কোনো গবেষকের ডক্টরেট ডিগ্রি, যার আধুনিক গবেষণা সরঞ্জামাদি ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ল্যাবরেটরি নেই, যার ল্যাবরেটরি ফসলের মাঠ।
হ্যাঁ, সেই কৃষকই একটি জনপদের ধান উৎপাদনের চিত্র পাল্টে দিয়েছেন। এই বিশ্বের সবচেয়ে বড় গবেষকের নাম কৃষক হরিপদ কাপালী। জন্মেছিলেন ১৯২২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ঝিনাইদহ সদর উপজেলার আসাননগর গ্রামে। মৃত্যুবরণ করেন ২০১৭ সালের ৬ জুলাই।
তার বাবার নাম কুঞ্জু লাল কাপালী এবং মায়ের নাম সরোধনী। জন্মের পর নয় বছর বয়সেই বাবাকে মাঠে সাহায্য করতেন তিনি। ১৩ বছর বয়সে বাবা এবং পরে মা মারা যান। পরে তিনি বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন এবং আসাননগর গ্রামে সুনিতী বিশ্বাসকে বিয়ে করে শ্বশুর বাড়িতেই থেকে যান। নিঃসন্তান ছিলেন, যদিও পরবর্তিতে রূপকুমার নামের এক ছেলেকে দত্তক নিয়ে লালন-পালন করেছিলেন। তবে, তার সন্তান ছিল ফসলের মাঠ ও মাটি। হরিপদ কাপালীর জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধায় তাকে স্মরণ করি।
একদিন সকালে নিজের ইরি ধান ক্ষেতে একটি ব্যতিক্রমধর্মী ধান গাছের শীষ দেখতে পেলেন হরিপদ। সেই ধানগাছের ছড়াতে ধানের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল এবং ধান গাছটিও ধানে ভারী পুষ্ট। অথচ আর কোনো ধান নেই সেটি ছাড়া। হরিপদ কাপালী সে ধানটিকে আলাদা করে রাখলেন। এরপর বীজ সংগ্রহ করলেন যখন ধানগাছ পরিপক্ব হলো। সেই একটি ছড়ারই বীজ নিলেন তিনি। এর পরের বছর ওই গোছার বীজ নিয়ে নিজের আঙ্গিনায় মোটামুটি পরিসরে বীজের জন্য আবাদ করলেন তিনি। এবারও বেশ ধান হলো। তিন বছর ধরে অনেকটা ধান নিজে চাষ করলেন। তার পরের বছর ৯০ ভাগই উপহার দিলেন নিজের চারপাশের কৃষকদের। বললেন, এই ধানের ফলন অন্য ধানের তুলনায় বেশি। অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য লাগলো। কারণ তারা তখনকার সময়ের সবচেয়ে উচ্চ ফলনশীল বিআর-১১ ও স্বর্ণা ধান চাষ করেন।
প্রায় সবাই নিজেদের ক্ষেতে বিআর-১১ ও স্বর্ণার পাশাপাশি হরিপদ’র দেওয়া নতুন ধানও লাগালেন। মৌসুম শেষে কাটতে গিয়ে কৃষকের চোখে-মুখে আশ্চর্যের ছোঁয়া। দেখা গেল, বিআর-১১ কিংবা স্বর্ণার চেয়ে উচ্চ ফলনশীল ধান এটি। তখন বিঘাপ্রতি বিআর-১১ ধানের সর্বোচ্চ ফলন ছিল ১৮ মণ আর হরিপদ কাপালীর ধানের ফলন হলো বিঘাপ্রতি ২২ মণের মতো। বিআর-১১ জাতের ধান ২০০৪ সালে ফলন হতো ৯-১০ মণের মতো, অথচ হরিপদ’র ধান হয় ১৮-২০ মণের মতো। সে বছর থেকেই বহু জায়গায় ছড়িয়ে পড়লো তার ধানের কথা। হরিপদ কাপালীর নামেই স্থানীয়রা এই ধানের নাম দিয়েছিলেন ‘হরিধান’।
মজার বিষয় হলো, এই ধানের উৎপাদন খরচ অন্য ধানের তুলনায় অনেক কম। যেখানে অন্য যেকোনো জাতের ধান তখন চাষ করতে খরচ হতো পনেরশ টাকা, সেখানে হরিধান চাষ করতে খরচ পড়তো ৮০০ টাকারও কম। আবার ক্ষেতে ধান উৎপাদনে সার এবং ওষুধও লাগতো তিন ভাগের এক ভাগ। হরিধানের ক্ষেত্রে একবার সার দিলেই চলে। অন্যদিকে, এই ধানগাছ বেশ মোটা হয়। ধানের কান্ড শক্ত ও মোটা হওয়ায় পোকা আক্রমণ করতে পারে না সহজে। হরিধান তুলনামূলক অন্য ধানের চেয়ে লম্বা হওয়ায় এই ধানের খড়ের চাহিদাও বেশি। ১৯৯৪ সালের দিকে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে এই জাতের ধানের আবাদ ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপকভাবে। ১৯৯৫ সালে স্থানীয় পত্রিকায় এই ধান নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন স্থানীয় কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের নজরে আসে। এরপর ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের নজরে এলো হরিধানের বিষয়টি। তার অনুরোধে ১০ কেজি স্বর্ণা আর ১০ কেজি হরিধান জোগাড় করে আনা হলো। রাউজান-১ আর রাউজান-২ কোড নাম দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারে পাঠানো হলো। সেখানে গবেষকরা গবেষণা করে জানালেন, ‘হরিধান একটি নতুন জাতের ধান। মোটেই বিআর-১১ নয়।’ হইচই পড়ে গেল বহু জায়গায়। সেই গবেষণা প্রতিবেদন ছাপা হলো বিশ্বখ্যাত এক আন্তর্জাতিক জার্নালে।