হযরত খানজাহান আলী (রহ.)’র মাজার জিয়ারত

29

ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী

ভ্রমণ করা আমার শখ। ইসলামের স্মৃতি ও ঐতিহ্য দেখতে আমার পরম আনন্দ। তাই বছরে কয়েক বার দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াই। প্রাচীন নিদর্শন আমাকে আকর্ষণ করে। পবিত্র কোরআন প্রাচীন নিদর্শনের কথা বার বার স্মরণ করেছেন। অতীত হতে শিক্ষা গ্রহণ কোরআনেই নির্দেশ। তাই অতীত হতে শিক্ষা গ্রহন করে ভবিষ্যত নির্মাণ করতে হয়।
দুই ঈদের পর তেমন উল্লেখযোগ্য কাজ থাকে না বলে ভ্রমণ করা সহজ হয়। এবার ঈদুল আজহার পর যশোর ও খুলনা জেলা ভ্রমণের সিন্ধান্ত নিই। অনেক স্মৃতি ও ঐতিহ্যের এদুটি জেলা ভ্রমণ করা কখনো হয়নি। ২০১৪ সালের ১০ অক্টোবর সকালে সপরিবারে হাজির হলাম মাইকেল মধুসুদন দত্তের স্মৃতি বিজড়িত যশোর জেলার কেশবপুরে। উঠলাম আমার ¯েœহভাজনেষু দুর্নীতি দমন কমিশনারের সহকারী পরিচালক মাসুদুর রহমানের বাসায়। তাকে নিয়ে পুরো বিকালটা কাটলো মধুকবির স্মৃতি দেখায়। পরের দিন সকালে একটি মাইক্রোভাড়া করে খুলনা জেলার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। দুপুরে প্রথম হাজির হলাম বাগেরহাট হযরত খানজাহান আলী (রহ.)’র মাজারে। গাড়ী থেকে নামার সাথে সাথে আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন মাজার এলাকার পরিচিত মানুষ। ডা. এম এ মুক্তাদির। তিনি আমাদের নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন মাজারের মোতাওয়াল্লী বাদশাহ ফকিরের সাথে, মূল মাজারে ভিতরে বিশেষ বিশেষ মানুষ প্রবেশ করতে পারলেও সর্বসাধারণের জন্য প্রবেশাধিকার নেই। মতাওয়াল্লী সাহেব আমাদের জন্য মাজারে মূল দরজাটি খুলে দিলেন। আমি মাজারের কাছে গিয়ে জিয়ারত করলাম। মন ভরে গেল। পূরণ হলো অনেক দিনের আশা। মাজার হতে বের হয়ে দেখছিলাম এই মহান অলির শত স্মৃতি।
হযরত খানজাহান আলী (রহ.) ছিলেন মহান সাধক যাঁর যশোর, খুলনা ও বাগেরহাট রয়েছে শত শত স্মৃতি। সমগ্র বাংলার মাটিতে যে কয়েক জন বিখ্যাত অলিয়ে কামিল ঘুমিয়ে আছেন তাদের মধ্যে হযরত খানজাহান আলী (রহ) অন্যতম। তিনি বাংলার ইতিহাসের একটি প্রধান অংশ। এই মহান সাধক ছিলেন একাধারে সৈনিক, শাসক, ইসলাম প্রচারক এবং মানব সেবক। মানবতার কল্যাণকারী হিসেবে তিনি সকল ধর্মের মানুষের কাছে শ্রদ্ধেয়।
হযরত খানজাহান আলী (রা.)’র জন্মভুমি কোথায় ? কত সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া কঠিন। তাঁর মাজারের শিলালিপি পাঠ করলে আত্মস্থ হয় যে, এই মহান অলির নাম ‘খানুল আজম খান জাহান’ এবং উলুম খানজাহান’। আরবী ও ফার্সী ভাষায় তাঁর ইন্তেকালের তারিখ লেখা আছে ২৬ জিলহজ¦ ৮৬৩ হিজরী রোজ বুধবার। ‘উলুঘ’ শব্দটি তুর্কী বলে অনেকে মনে করেন পারস্যে তিনি কোন তুর্কী পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। আফগান ও তুর্কীর তখন সেনাপতির সম্মানিত উপাধি ছিল খানে আজম। খালুল আজম দ্বারা বুঝাযায় তিনি একজন সেনাপতিও ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে তিনি নিজেই কিছু লিখে যাননি।
কোন কোন লেখক উল্লেখ করেছেন, এই সাধক নিঃসন্তান ছিলেন এবং সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহেব সহযোগী ও সেনাপতি ছিলেন। সুলতানের পক্ষে তিনি বাগেরহাটের বিশাল অঞ্চল আবাদ পূর্বক শাসন করেন। তাই এই অঞ্চলের তখন নামকরণ করা হয় ‘খলিফাত-ই-আবাদ’। তাঁর অন্তর ছিল মানব প্রেমে ভরপুর। তিনি যশোরের কারো বাজার থেকে শুরু করে ভাটি অঞ্চল জুড়ে ৩৬০টি মসজিদ এবং ৩৬০টি দীঘি খনন করেছিরেন। লোনা পানির ভাটির অঞ্চলে পানিয় জলের কত বড় প্রয়োজন ছিল এ যুগে তা কল্পনা করা যাবে না। আজ অলি আল্লাহর নামে অর্থবিত্ত অর্জণ করে এবং ভোগ বিলাসে মত্ত থাকে। যারা তারা কী মানব কল্যাণ হতে দূরে থেকে আল্লাহর কল্যাণকামী অলিদের অবমাননা করে না ? আমরা স্মরণ করি আল্লাহর অলিদের কিছু অনুসরণ করি না। স্মরণের মধ্যে অনুসরণ না থাকলে সে স্মরণ ব্যর্থ হতে বাধ্য।
মহান অলি হযরত খানজাহান আলী (রহ.)’র সাথে এদেশে আগমন করেছিলেন ৩৬০ জন কামিল সাধক। কোন কোন গবেষক মনে করেন এই সংখ্যার সাথে সামঞ্জস্য রেখে তিনি ৩৬০টি মসজিদ এবং ৩৬০টি দিঘী খনন করেছিলেন। শাসক হিসেবে তিনি আগমন করলেও শেষ জীবনে আধ্যাত্মিক সাধনা এবং মানব কল্যাণই ছিল তাঁর ধ্যান জ্ঞান। তিনি ক্ষুধার্ত মানুষকে খাওয়াতেন, রাস্তা-ঘাট, সেতু-হাটবাজারসহ অসংখ্য কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন।
তিনি যখন বাগেরহাট আগমন করেন তখন এই স্থানের নাম কি ছিল জানা যায়নি। সুন্দর ঘোনা স্থানে তিনি আসন স্থাপন করেন। এই স্থান হতে থাকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রভাবশালী হিন্দুরা চেষ্টা করে এবং কয়েকটি যুদ্ধও করেন। কিন্তু সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয়। দিন দিন তাঁর ভক্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে এখানে গড়ে উঠে জনবসতিপূর্ণ একটি আবাসন্থল তখন এই এলাকার নামকরণ করা হয় খলিফাতে বাদ যা আজকের বাগেরহাট।
আলেকজাÐারের মৃত্যুর পর তাঁর দুই হাত কফিনের বাইরে রাখতে বলেছিলেন, কারণ বিশ^বাসী যেন দেখে বিশ^বিজেতা বীর আলেকজান্ডারের খালি হাতে ফেরত যাচ্ছে। বাদশাহ সেকান্দর ইন্তেকালের পর তাঁর দুই খানি হাত সবাইকে দেখিয়ে দিতে বলেছিলেন যেন সবায় দেখে দুনিয়ার শাসক আখেরাতে গরীব। দুনিয়াকে তুচ্ছ করে আখিরাতকে উচ্চ করে বিদায় নিয়েছিলেন মহান সাধক হযরত খানজাহান আলী (রহ.)।
তাঁর ওপর একস্থানে আবরীতে লেখা আছে, ‘মান মাতা গরিবান-ফাক্বাদ মাতা শাহিদান’। অর্থাৎ যে ব্যক্তি গরীব অবস্থায় ইন্তেকাল করল, শহীদ অবস্থায় তাঁর বিদায় হলো। এই বাক্য দ্বারা বুঝাযায় তিনি জীবনে ধনী থাকলেও ইন্তেকালের সময় গরীব ছিলেন। কারণ তিনি সমস্ত সম্পদ ইসলাম ও মানবতার সেবায় বিলিয়ে দিয়ে গরীব হালতে শহীদ হয়েছেন।
জগতের সকল নবী-রাসুল (দ.) ইন্তেকাল করেছেন। ইন্তেকাল করা সুন্নাত। হযরত খানজাহান আলী (রহ.) জানতেন কবরই তাঁর শেষ ঠিকানা। তাই তিনি নিজের সমাধি ভবন নিজেই নির্মাণ করে রেখেছিলেন। ইন্তেকালের একদিন আগে তিনি ষাট গম্বুজ মসজিদে ভক্তবৃন্দদের নিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করে উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করে আল্লাহ পাকের দরবারে আবেকপূর্ণ হৃদয় নাড়ানো এক মোনাজাত করলেন। এমন বক্তব্য ও মোনাজাত শ্রবণ করে উপস্থিত সকলে বলাবলি করতে লাগলেন, তিনি হয়তো আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন। ইন্তেকালের পূর্বে তাঁর কোন রোগ ব্যাধি ছিলো না। পরের দিন পুনরায় ফজরের জামায়াতে অংশ গ্রহণ করেন। প্রথম রাকাত শেষে দ্বিতীয় রাকাতের শেষ সেজদা গিয়ে তিনি আর মাথা তুলেন নাই। তিনি ছিলেন নামাজের ইমাম। মুক্তাদিগণ অনেক্ষণ অপেক্ষার পর মাথাতুলে দেখলে তিনি দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে পর জগতে চলে গেছেন। সেদিনটি ছিল ২৩ অক্টোবর ১৪৫৯ খৃস্টাব্দ, ২৬ জিলহজ¦ ৮৬৩ হিজরী।
খাঞ্জেলী দিঘীর উত্তর পাড়ে উঁচু ভূমিতে তাঁর সমাধি সৌধ নির্মিত ছিল। এটি বর্গাকৃত, আয়তন ৪২ ফুট এবং প্রাচীরের উচ্চতা ২৫ ফুট, ছাদের ওপর ১টি গম্বুজ আছে। সমাধি সৌধের ভিতর একটি প্রস্তর নির্মিত বেদীতে হযরত খানজাহান আলী (রহ.)’র মাজার শরীফ অবস্থিত। মাজারটি ষাট গম্বুজের ন্যায় মনে হয়। আজ পর্যন্ত এই দরগাহে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার ভক্ত রুহানী ফয়েজ হাসিল করতে জিয়ারত করেন।

লেখক : কলাম লেখক, রাজনীতিক