হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি যাঁর নিকট আমরা চির ঋণী

12

সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী

মহান রাব্বুল আলামীন যুগে যুগে মানবজাতির হেদায়ত, পথপ্রদর্শন ও সর্বাঙ্গীন কল্যাণের নিমিত্তে অসংখ্য নবী ও রাসুল পৃথিবীর বুকে প্রেরণ করেছেন। হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে হযরত ঈসা আলাইহিমাস্ সালাম পর্যন্ত একজনের পর একজন নবী ও রাসুলের আগমনের ধারা অব্যাহত থাকে এবং সর্বশেষ আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমনের মাধ্যমে নবী-রাসুলগণের ধারবাহিকতা সমাপ্ত হবার পর আরম্ভ হয় নবী-রাসূূলগণের ওয়ারিস ওলামা-আওলিয়া কেরামের সিলসিলা।
এরই ধারাবাহিকতায় অধঃপতনের যুগে ইসলামের আলোকবর্তিকা নিয়ে যে সকল মনীষীগণ ছুটে গেছেন পৃথিবীর পূর্বে-পশ্চিমে, যাঁদের বদৌলতে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছে ভূ-ভাগের প্রতিটি দেশে এবং প্রতিটি প্রান্তে। পার্থিব লোভ-লালসা ও ক্ষমতার মোহ যাঁদেরকে ন্যায় ও সত্যের আদর্শ থেকে বিন্দুমাত্র পদঙ্খলন ঘটাতে পারেনি। যাঁরা অন্যায় ও অসত্যের নিকট কোনো দিন মাথা নত করেননি। যাঁরা ইসলাম ও মানুষের কল্যাণে সারাটা জীবন পরিশ্রম করে গিয়েছেন। যাঁরা সত্যকে আঁকড়ে থাকার কারণে যালেম কর্তৃক অত্যাচারিত, নিপীড়িত ও নির্যাতিত হয়েছেন; হযরত খাজা গরীব নাওয়ায রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁদের অন্যতম।
উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারে যাঁর অবদান ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে তিনি হলেন; সুলতানুল হিন্দ, আতায়ে রাসুল, গরীব নাওয়ায হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রাহমাতুল্লাহ আলাইহি। আল্লাহ তাআলা তাঁর মাধ্যমে ভারত বর্ষের ইসলাম ও মুসলিমকে সম্মানিত করেছেন। যাঁর প্রচেষ্ঠায় নব্বই লক্ষাধিক অমুসলিম ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহনের নেয়ামত প্রাপ্ত হয়েছেন। ইসলামের সম্মান তো তাঁদের ছায়াতেই; আর মর্যাদা তো তাই, যা তাঁরা নির্মাণ করে সুদৃঢ় করে গেছেন।
এ কারণেই আমরা বিচারের দিন পর্যন্ত তাঁর নিকট ঋণী। কারণ জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক উভয়ক্ষেত্রেই তিনি আমাদেরকে অসংখ্য অনুগ্রহের মাধ্যমে ধন্য করছেন। এইসব নেয়ামতকে স্মরণ করে তাঁদের প্রতি আমাদেরকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার এবং সেগুলোকে অস্বীকার না করার নির্দেশ দিয়েছেন মহান আল্লাহ তাআলা। তিনি বলেন: “অতএব, তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমি তোমাদেরকে স্মরণ করব। আর আমার শোকর (কৃতজ্ঞতা) আদায় করো, আমার সাথে কুফরী (অকৃতজ্ঞতা) কোরো না।” [আল-বাকারা; ২ : ১৫২]
আল্লাহ্ তা‘আলা কুরআনে আমাদের প্রতি তাঁর কিছু নেয়ামতের কথা উল্লেখ করেছেন এবং সেসবের জন্য আমাদেরকে শুকরিয়া আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি আমাদেরকে এ কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, খুব অল্প কিছু মানুষই তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায়করে থাকে।
হযরত খাজা গরীব নাওয়ায রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ১১৩৮ ইংরেজি, ৫৩৭ হিজরীতে মধ্য এশিয়ায় খোরাসানের অন্তর্গত সিস্তান রাজ্যের সানজার নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ খাজা গিয়াস উদ্দীন ও মাতার নাম সৈয়দা উম্মুল ওয়ারা মাহে নূর। মাতৃকুল হযরত হাসান ও পিতৃকুল হযরত হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমা পর্যন্ত পৌঁছায় তিনি বংশে হাসানী-হোসাইনী আওলাদে রাসুলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অশেষ সৌভাগ্যের অধিকারী।
তিনি ১৩ বছর পর্যন্ত পিতার সার্বিক তত্ত¡াবধানে কুরআন, হাদিস, ফিকহ্, উসুল, তাফসীর, আরবী সাহিত্য-ব্যাকরণ, মানতিক, হিকমত-দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে গভীর বুৎপত্তি লাভ করার মধ্য দিয়ে প্রাথমিক দ্বীনি শিক্ষা অর্জন সমাপ্ত করেন। অতঃপর বোখারা, সমরকন্দসহ বিশ্বখ্যাত মুহাদ্দিস, ফকীহ ও দেশবরেণ্য ওলামায়ে কেরামের নিকট শিক্ষা গ্রহণ করে কৃতিত্বতার সাথে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটান।
তিনি হযরত ইব্রাহীম কান্দুজী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি নামে এক মাযযুব কলন্দর অলি আল্লাহর ছোহবত লাভের প্রভাবে তাঁর মনরাজ্য খোদায়ী নূরে আলোকিত হয় এবং আল্লাহর প্রেমের প্রবল তরঙ্গে প্লাবিত হয়ে আধ্যাত্মিকতার অদম্য আকর্ষণে সব কিছু ত্যাগ করে আল্লাহর নামে অজানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। অভাবনীয় ও অবর্ণনীয় রুহানি আকর্ষণ নিয়ে তিনি আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্বেষায় নিমগ্ন হলেন। বুখারা, ইরাক, নিশাপুর প্রভৃতি জায়গায় অনেক অলি বুযুর্গ, দরবেশের সান্নিধ্যে ইলমে মা’রেফত অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্ধানে সফর অব্যাহত রাখেন। বোখারা থেকে নিশাপুরে এসে এখানকার ‘হারূন’ নামক একটি ছোট শহরে ইলমে মা’রেফতের রহস্যজ্ঞানী, মহান আধ্যাত্মিক তাপস, যুগশ্রেষ্ঠ ওলী হযরত ওসমান হারুনী রাহমাতুল্লাহ আলাইহি’র সন্ধান পেয়ে একান্ত আগ্রহে তাঁর নিকট দীক্ষা গ্রহণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন এবং বাইয়াত গ্রহণ করেন।
ভারত বর্ষে আগমণের নির্দেশ: তিনি হজ্ব পালন শেষ করে মক্কা শরীফ থেকে মদিনা শরীফে হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রাওযা শরীফে হাযির হন। হুযুর করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশ করেন, “হে হাসান, তুমি মঈনুদ্দিন, তথা তুমি দীনের মুঈন (সাহায্যকারী)। আজ আমি তোমাকে হিন্দের বেলায়ত দান করলাম। তুমি হিন্দুস্তানে যাও এবং আজমির নামক স্থানে দীনের প্রচার কর। খোদা তোমাকে বরকত দান করবেন”। পাশাপাশি হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে প্রিয় নবীজি তাঁর হাতে একটি সুমিষ্ট আনার দিয়ে আজমিরের দৃশ্য দেখিয়ে দিয়ে প্রয়োজনীয় পথ-নির্দেশনা দিয়ে যাত্রা শুরু করবার নির্দেশ দিলেন।
আজমিরে শুভাগমন: নবীজির নির্দেশে তিনি সুদূর আরব হতে ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান হয়ে প্রথমে লাহোর পরে দিল্লী হয়ে আজমিরে শুভাগমন করেন। তিনি এমন এক যুগ সন্ধিক্ষণে আজমীরে আগমন করেন, যখন ভিন্নধর্মী শাসকদের অত্যাচার ও অবিচারে ভারতবর্ষে বিদ্যমান সংখ্যালঘু মুসলিদের শিক্ষা ও চিন্তার জগতে দারুণভাবে বিস্তার করে বিভ্রান্তির কালো থাবা। একদিকে শিরক, কুফর অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার, অন্যদিকে সংঘবদ্ধ হয়ে উঠেছিল তদানীন্তন মুসলিম বিদ্বেষীশক্তি মুসলমানদেরকে ধ্বংস করার জন্য। সেই সময় ওই সকল পথ হারা ও মযলুমদেরকে সঠিক পথের দিশা দেবার জন্য তাঁর মত একজন মুজাদ্দিদের, একজন পথ প্রদর্শকের, একজন মহান ব্যক্তিত্বের আগমন খুবই জরুরি হয়ে পড়েছিল। তাই আল্লাহ তাআলার দয়া ও করুণায় তাঁর দ্বীনকে রক্ষার জন্য মুঈনুদ্দীন হয়ে আবির্ভূত হলেন হযরত খাজা গরীব নাওয়ায রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ।
তিনি ছিলেন সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য এক অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি তাঁর ক্ষমা, মহানুভবতা, বিনয়-নম্রতা, সত্যনিষ্ঠতা প্রভৃতি চারিত্রিক মাধুর্য দিয়ে অমুসলিমদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মানুষকে তিনি অর্থ বা প্রভাব-প্রতিপত্তির দ্বারা বশীভূত করেননি। বরং স্বভাবজাত উত্তম ব্যবহার দিয়ে বশীভ‚ত করেছিলেন। যার ফলে দলে দলে মানুষ তাঁব কাছে ইসলাম গ্রহণ করে জান্নাতের সুঘ্রান লাভে ধন্য হন।
তাছাড়াও তিনি ছিলেন নির্লোভ, নিরহংকার, পরোপকারী, সহজ-সরল অনাড়ম্বর জীবনে অভ্যস্ত, মন্দের বিনিময়ে উত্তম আচরণকারী। তিনি তাঁর ভক্ত-মুরিদ ও অনুসারীদেরকে মানুষের সাথে নম্র ও সুন্দর ব্যবহারের নির্দেশ দিতেন, অযথা ক্রোধ প্রকাশ না করা, কাউকে তুচ্ছজ্ঞান ও হেয়প্রতিপন্ন না করার প্রতি তাগিদ দিতেন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দল-মত নির্বিশেষে সব মানুষের সাথে সদাচরণ করে স্বভাব-চরিত্রে অতুলনীয় আদর্শ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। অন্য ধর্মের লোকেরাও তাঁর কাছে সুন্দর ও কোমল আচরণ লাভ করত। তাঁর নমনীয়তা ও কোমলতার কারণে সবাই তাঁকে প্রাণাধিক ভালোবাসতো। সব সময় হাসিমুখে কথা বলতেন, সদালাপ করতেন, ক্ষমাকে প্রাধান্য দিতেন। তাঁর মধুর বচনে সবাই অভিভূত হত। তাঁর অভিভাষণ শুনে সাধারণ মানুষ অশ্রু সংবরণ করতে পারত না। তাই তিনি ছিলেন আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুপম আদর্শের এক বাস্তব দর্পন।
রাসূল-এ পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা এ উম্মতের জন্য প্রতি শতাব্দীর শুরুতে এমন এক বা একাধিক মহান ব্যক্তিকে প্রেরণ করেন যিনি বা যাঁরা এ দ্বীনের সংস্কার করবেন। [আবু দাউদ-৪২৯১]
হযরত খাজা গরীব নাওয়ায রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁদের অন্যতম। তিনি কেবল দ্বীনের সংস্কারক ছিলেন না; বরং ইসলামের একজন মুঈন ও মদদগার হিসেবে প্রিয় নবীর পক্ষ থেকে স্বীকৃতি লাভ করেন। তাই তিনি ‘মুঈনুদ্দিন’ বা দ্বীনের সাহায্যকারী হিসেবেও বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।
ইন্তেকাল : তিনি ৬৩৩ হিজরীর ৫ রজব দিবাগত রাত অর্থাৎ ৬ রজব সুবহে সাদেকের সময় ইন্তেকাল করেন। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর। ওফাতের সাথে সাথে তাঁর পবিত্র কপাল শরীফে স্পষ্টভাবে আরবীতে স্বর্ণোজ্জ্বল নূরানী অক্ষরে লিখা হয়ে যায় “হাযা হাবীবুল্লাহ মা-তা ফি হুব্বিল্লাহ” অর্থাৎ ইনি আল্লাহর বন্ধু, আল্লাহর মুহব্বতেই তিনি ইন্তিকাল করেছেন। গরীব নাওয়াযের বড় সাহেবজাদা হযরত খাজা ফখরুদ্দীন চিশতী রাহমাতুল্লাহ আলাইহি তাঁর নামাযে জানাযায় ইমামতি করেন।

লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, সাদার্ন
বিশ্ববিদ্যালয়, খতীব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ