হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশ্তী (রহ.)

238

বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক মাওলানা জালালুদ্দিন রূমী (রহ.) বলেছেন, কেউ যদি আল্লাহর মজলিসে বসতে চায়, কেউ যদি আল্লাহর সান্নিধ্য পেতে চাই সে যেন আল্লাহর অলির দরবারে হাজির হয়ে যায়।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন “হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সাদেকীনদের (অলীগণের) সঙ্গ লাভ করো।” আল্লাহ পাক আরো ইরশাদ ফরমান “হে ঈমানদারগন তোমরা আল্লাহকে ভয় করো আর আল্লাহর পথ উসিলা তালাশ করো। এই আয়াতে কারীমের আলোকে আমরা সু-স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে পারি মহান রাব্বুল আলামীন আলামীনের আউলিয়ায়ে কেরামগণকে ভালোবাসেন এবং পথহারা মানুষকে সত্য দিশা দেখাতে আউলিয়ায়ে কেরামের সান্নিধ্যে আসার জন্য নির্দেশ প্রদান করেছেন। ইমামে আজম আবু হানিফা (রহ.) যুগশ্রেষ্ঠ ইমাম হওয়ার পরও একজন কামেল অলির কাছে গিয়ে ফয়েজ হাসিল করেছেন। তিনি বলেন আমি ইমাম জাফর সাদেক (রহ.) এর সান্নিধ্য যদি অর্জন না করতাম তাহলে আমি ধ্বংস হয়ে যেতাম।
মাটির এই দুনিয়ায় কদমের ধূলা দিয়ে মানব জাতিকে ধন্য করেছেন বহু আউলিয়ায়ে কেরাম। যার বদৌলতে পাক-বঙ্গ ভারত তথা উপমহাদেশে ইসলামের শান্তির ধারা অব্যাহত রাখতে খোরাসান প্রদেশের সন্জর নামক গ্রামে আবির্ভাব হয়েছে বাদশাহে হিন্দ আতায়ে রাসূল হযরত খাজা গরিবে নওয়াজ শায়খ সৈয়দ মঈনুদ্দিন চিশ্তী (রহ.)। ৫৩০ হিজরীর ১৪ রজব সোমবার পিতা সৈয়দ গিয়াসুদ্দিন হাসান ও মাতা সৈয়দা উম্মুল ওয়ারাহ ঔরসে এই মহান অলির জন্ম। পিতা-মাতা উভয় দিক হতেই তিনি রাসূল করীম (দ.)’র বংশধর। মাতৃগর্ভে আসার পর থেকেই ওনার পিতা-মাতা উপলব্ধি করতে পারেন যে ওনাদের ঘরে মহান আল্লাহর এক বিশেষ নেয়ামত আসতে যাচ্ছে। খাজা গরিবে নেওয়াজ (রহ.)’র শ্রদ্ধেয় মাতা সৈয়দা উম্মুল ওয়ারাহ বলেন, “হাসান গর্ভে থাকাকালীন প্রতি রাতেই আমি বিভিন্ন বুজুর্গানে দ্বীনের সাক্ষাৎ লাভ করতাম। তাঁরা প্রত্যেক দিন আমাকে সাবধান করে বলতেন, মাহে নূর তোমার গর্ভে এমন একজনের দেহ তৈরি হচ্ছে যিনি হবেন অলিদের পথ প্রদর্শক, কুতুবুল মাশায়েখ এবং আল্লাহ তায়ালার বিশেষ বন্ধুদের মধ্যকার একজন বিশেষ বন্ধু হাবীবুল্লাহ অতএব তোমাকে সবসময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
আল্লাহর প্রিয় বন্ধু আউলিয়া কেরামের কারামত সত্য এবং ভালো হালত এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কারন আউলিয়ায়ে কেরামের কারামত একটা শরীয়ত বিদিত বিষয়। বিখ্যাত আক্বায়েদ গ্রন্থ ‘শরহে আক্বায়েদে নাসাফীতে বর্ণিত আছে কারামতুল আউলিয়ায়ে হুক্কুন’ অর্থাৎ অলীগণের কারামত সত্যও প্রমাণিত। তাদের এ কারামত পৃথিবীতে বাহ্যিকভাবে অবস্থানকালে যেমন হয় তেমনভাবে তাদের ওফাতের পরেও জারি থাকে।
উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারের আধ্যাত্মিক সংস্কারক হিন্দল অলি হযরত খাজা গরিবে নেওয়াজ (রহ.) অসংখ্য কারামত ¯্রষ্টার এই ধরায় দৃশ্যমান হয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো জন্মের পূর্ব থেকে ইন্তেকালের পরেও ওনার কারামত তার লাখো ভক্ত-মুরীদের পাশাপাশি তার বিরোধিতাকারীদেরও অবাক করেছে। বিশাল এক সমুদ্রকে যেমন একটি পাত্রে ধারণ করা যায় না। ঠিক তেমনি এতবড় একজন আধ্যাত্মিক মহাপুরুষের কারামতও একটি সংক্ষিত প্রবন্ধে উপস্থাপন কখনো সম্ভব নয়। তবুও পাঠক সমাজের জ্ঞাতার্থে এই মহান অলির জীবদ্দশায় কিছু কারামত ছোট্ট পরিসরে নিম্নে তুলে ধরলাম।
হিন্দু যুবকের ইসলাম গ্রহণ:
একবার হযরত খাজা গরিবে নেওয়াজ (রহ.) ভ্রমণরত অবস্থায় এমন এক স্থানে পৌঁছলেন যেখানে তাঁর নিজস্ব লোক বলতে কেউ ছিলো না। তাঁর সাথে ছিলো শুধুমাত্র একজন খাদেম। তাঁরা সেখানে পৌঁছার পর প্রচার হয়ে গেলো যে হযরত খাজাবুযুর্গ গরিবে নেওয়াজ এখানে উপস্থিত হয়েছেন। ঐ প্রচারের উদ্দেশ্য কি ছিলো তা জানা না গেলেও প্রচারে এক হিন্দু যুবক তাঁকে হত্যা করার জন্য ছুরী হাতে ঘর হতে বেরিয়ে এসে তাঁর সম্মুখে উপস্থিত হলো, কিন্তু হযরত খাজা গরিবে নেওয়াজ (রহ.) জালালী দৃষ্টির সঙ্গে তাঁর দৃষ্টি মিলিত হওয়ার সাথে সাথে সে যুবক বেহৃশ হয়ে মাটিতে পড়ে গেলো। ঐ বেহুশির মধ্যেই সে বলতে লাগলো আমি আপনার গোলাম। আমাকে কবুল করুন। খাজা বাবার দোয়ায় কিছুক্ষণের মধ্যেই সে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলো। সে তখন মুসলমান হওয়ার জন্য তৈরি হয়ে গেছে। সে খাজাবাবার নিকট আরজ্ করলো আপনি আমায় আপনার ধর্মে গ্রহণ করে দীক্ষা দিন। হযরত খাজাবাবা তাকে কলেমা পাঠ করিয়ে মুসলমান করলো এবং ত্বরীকার ছবক দান করলেন।
একই সময়ে দু’জায়গায় অবস্থান :
কথিত আছে খাজা গরিবে নেওয়াজ (রহ.) যখন আজমীর বসবাস করতেন তখন সেখানকার ও আশেপাশের লোকদের মধ্যে যারা হজ্ব করতে যেতো তারা এসে বলতো যে “হযরত খাজা গরিবে নেওয়াজ (রহ.) কে কা’বা ঘর তাওয়াফ করতে দেখেছেন এবং আরাফাত ময়দানেও দেখেছে। কিন্তু কথা বলতে পারে নি। তাদের এই কথা শ্রবন কবে আজমীরবাসীগণ বিস্ময় প্রকাশ করে বলতো আমরা প্রতিদিনই তাঁর সাথে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়েছি। আর প্রকাশ্যভাবে আজমীরে আগমনের পর তিনি হজ্ব করার মতো সময় করে উঠতে পারেননি।
আনাসাগরের পানি শূন্য :
রাজা পৃথ্বিরাজ যখন আদেশ জারি করলেন “কোন মুসলমান আনা সাগরের পানি ব্যবহার করতে পারবে না তখন খাজাবাবা (রহ.) ওনার এক খাদেমকে ওনার কাসাচুবিটি দিয়ে পাঠালেন পানিভর্তি করে আনার জন্য। খাদেম কাসাচুবিটি হাতে নিয়ে পানির নিকট যেতেই সে সৈন্যকতৃক বাধাপ্রাপ্ত হলো। খাদেম অনুনয় বিনয় করে বলতে লাগলো আমি এখানে গোসলও করবো না, অজুও করবো না। শুধুমাত্র এ কাসচিুবিটায় করে সামান্য পানি নিব। এবং পুনরায় তোমাদেরকে পানির জন্য বিরক্ত করবোনা সৈন্যগন প্রথমে নিষেধ করলেও পরে ভাবলো শুধুমাত্র এক পেয়ালা পানি তো, তা নিবে নিকনা। তারা বললো এবারের মতো তোমাকে পানি দিচ্ছি পুনরায় আর আসবেনা। সে বললো ঠিক আছে আর আসবো না। সৈন্যগণ বললো ঠিক আছে যাও নিয়ে যাও। সে কাসাচুবাটি ভর্তি করে পিছনে ফিরে দেখলো হযরত খাজা বাবা (রহ.) টিলার উপর দাঁড়িয়ে আছেন। এদিকে খাদেম আনা সাগরের সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসতেই একটা হৈ চৈ পড়ে গেলো। আনা সাগরের পানি গায়েব, আনা সাগরের পানি শূন্য হয়ে পড়েছে। কেউই নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা যে, যেখানে একটু আগে আনা সাগর পানিতে কানায় কানায় পূর্ণ ছিলো, সেখানে এখানে মৃত্তিকা ছাড়া আর কিছু নজরে পড়ছেনা। সবাই অবাক বিস্ময়ে পানি বিহীন আনা সাগরের দিকে তাকিয়ে আছে।
এরকম আরো বহু কারামত রয়েছে এই মহান অলির। ইনি সেই খাজা গরিবে নেওয়াজ (রহ.) যিনি শক্তি প্রদর্শন ব্যতীত, তরবারী ছাড়া উপমহাদেশে ইসলামের ভিত্তি স্থাপন করেছেন শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক পরশের মাধ্যমে। বর্তমান সময়ে বিকৃত মন-মানসিকতা ও ইসলামের ভুল ব্যাখ্যায় বিভ্রান্ত হয়ে একটি গোষ্ঠী জঙ্গিপনার মাধ্যমে ইসলাম ধর্মে যে কলঙ্কলেপন করছে তাদের জন্য খাজা গরিবে নেওয়াজ (রহ.) অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। অলিকুল স¤্রাট হযরত খাজা গরিবে নেওয়াজ (রহ.) এর মাজার শরীফের জিয়ারতের সুফল প্রায় সব ঈমানদারই জ্ঞাত। মানুষের তকদীরে না থাকলেও খাজা বাবা (রহ.) মাজার শরীফে গিয়ে তাঁর উসিলায় দোয়া করলে মহান আল্লাহ তা’য়ালা প্রার্থনাকারীর মনের আশা আকাক্সক্ষা পূরণ করেন।
৬৩২ হিজরীর ৬ রজব শুক্রবার সুবেহ্ সাদেকের সময় হযরত খাজা গরিবে নেওয়াজ (রহ.) দুনিয়া থেকে পর্দা নসীব করেন। ইন্তেকালের পর তাঁর পবিত্র দেহকে সোজা করা হলো। তখন উপস্থিত সকলেই নূরের উৎস খুঁজে পেলেন। দেখতে পেলেন তাঁর পবিত্র পেশানীতে নূরের অক্ষরে লেখা রয়েছে “হাজা হাবিবুল্লাহ মাতাফি হুব্বিল্লাহ” অর্থাৎ ইনিই হচ্ছেন আল্লাহর হাবীব। আল্লাহর বন্ধুত্বে বিলীন হলেন। প্রতি বছর জমাদিউস সানি হতে আজমীরে ওরশ মোবারকের প্রস্তুতি চলতে থাকে। ওরশ শরীফে বিশ্বের সমগ্রদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ ঈমানদার মুসলিম শরীক হন। ২৯ জমাদিউস সানি ফজরের নামাজের পূর্বে জান্নাতি দরজা খুলেদেয়া হয়। রজবের চাঁদ দেখা যাওয়ার পর নয়বার তোপধ্বনি করা হয়। আজমীর শরীফ নতুন রূপে সজ্জিত হতে থাকে। বিদ্যুৎ, ঝাড়বাতি, ফানুশবাতি প্রজ্জ্বালিত হয়ে সমস্ত স্থান উজ্জ্বল ও আলোকিত হয়ে উঠে। এ যেন এক স্বর্গীয় দৃশ্যের অবতারণা। মহান রাব্বুল আলামীন হযরত খাজাগরিবে নেওয়াজ মঈনুদ্দিন চিশতী (রহ.) উসিলায় আমাদের সকলকে কবুল করুক। আমিন। ছুম্মাআমিন।

(লেখক সেলিম খান চাটগামী জটিল রোগ ক্যান্সারে আক্রান্ত। হজরতের ফয়ুজাতের উদ্দেশ্যে এ লেখাটির প্রয়াস। তিনি পাঠকের কাছে দোয়া প্রার্থী)