হযরত আবু ছৈয়দ শাহ্ আল্ আমিরী (রহ.)

20

শেখ সৈয়দ মাহমুদ নোমান শাহ্

মহান স্রষ্টা, প্রতিপালক ও লা’শরীক আল্লাহ্ পাকের মাহাত্ম্য, মহত্ত¡, গুণ,ক্ষমতা ও কুদরতের ব্যাপ্তি বর্ণনা করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। কিভাবে বিষ্ময়কর সপ্তস্তরের আকাশ শূন্যে লটকিয়ে রেখেছেন,তা ভাবনার বহির্ভূত। তবে কিছু নিদর্শন জগতজুড়ে চোখের সম্মুখে দেদীপ্যমান ও অন্তরে অনুভব করা যায়। যারা সত্য ও শাশ্বত পথে আত্মোৎসর্গ হয়ে আল্লাহ্ পাকের নিকটজন ; তাঁরা অলি-আল্লাহ্ নামে আখ্যায়িত। আল্লাহর হাবীব ও সমগ্র সৃষ্টির করুণাধারা মহানবী (সাঃ) এর বংশানুক্রমে সারাজগতের পথহারা মানবকূলের হেদায়তের দিশারী হয়ে বেলায়তের উত্তরসূরি, নায়েবে আম্বিয়া, হযরত আমিরুল আউলিয়া (কঃ) এর প্রপৌত্র, যুগশ্রেষ্ঠ শক্তিধর ও দিগ্বিজয়ী পথপ্রদর্শক-হাদীয়ে জমান, বাবাজান কেবলা হযরত শাহ্সূফী সৈয়দ মুহাম্মদ আবু ছৈয়দ শাহ্ আল্ আমিরভাণ্ডারী(রহ্ঃ)।
আধ্যাত্মিকতার জ্বলন্ত ঐশীর বারতা বইয়ে নেবার একাত্মতায় হযরত আমিরুল আউলিয়া (ক.) বেছাল লাভের পর ১৯২৮ সালে হযরত আমিরুল (ক.) এর দ্বিতীয় পুত্র মাহবুবে ইলাহী খাজা খলিলুর রহমান শাহ্ (রহ্) এর ঘরে সৈয়্যদা মেহেরাফজান বিবির গর্ভে জন্মলাভ করেন হাদীয়ে জমান শাহ্সূফী সৈয়্যদ মুহাম্মদ আবু ছৈয়দ শাহ্ আল্-আমিরভাÐারী( রহ্ঃ)। কথিত আছে, মাতা সৈয়্যদা মেহেরাফজানের গর্ভে প্রথম পুত্রসন্তান নাবালক অবস্থায় ইন্তেকালের পর আর কোন সন্তান না হওয়ার প্রেক্ষিতে মানসিক ভারসাম্য ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় আমিরুল আউলিয়া (ক.) এর কাছে কঠোর রেয়াজতের মাধ্যমে আরজি পেশ করতে থাকেন। এমন এক রাতে সৈয়্যদা মেহেরাফজান বিবির চোখ যখন তন্দ্রাগ্রস্ত তখন দিবালোকের মতো স্বপ্নে আমিরুল আউলিয়া (ক.) তাঁকে দু’টি শশা দিয়ে বললেন,‘এই দু’টি শশা তুমি ভক্ষণ করিও’
সৈয়দা মেহেরাফজান বিবি আশ্চর্য চোখে ভালভাবে অবলোকন করতে লাগলেন। হঠাৎ স্বপ্ন ছুটে গেল। রাত গভীর হতে হতে এক সময় ফজরের আযান ধ্বনিত হল।ঘুম থেকে ওঠে নামাজ ও অজিফা পাঠের পর তাঁর সিথানে স্বপ্নদৃষ্টে আমিরুল আউলিয়া(ক.) এর হাত মোবারকের প্রদত্ত শশার অনুরূপ একই আকৃতি,একই রঙের দুটি শশা দেখে পবিত্র মুখে ‘সুবাহানাল্লাহ’ বলে উঠলেন। বিহŸল হৃদয়ে কালক্ষেপন না করে ‘বিছমিল্লাহ্’ বলে শশা দু’টি আহার করলেন। এর কিছুদিন পর মাতৃগর্ভে হযরত শাহ্সূফী সৈয়দ মুহাম্মদ আবু ছৈয়দ শাহ্ আল্-আমিরভাণ্ডারী তাশরীফ আনেন। যা সকল যুক্তি-বিশ্লেষণের ঊর্ধ্বে, তর্কের কোন অজুহাত নেই, সৈয়দ মুহাম্মদ আবু ছৈয়দ শাহ্ আল্-আমিরভাণ্ডারী হলেন হযরত আমিরুল আউলিয়া(কঃ) এর প্রদত্ত নেয়ামত,দ্যুতিময় নূরের কাঁচফলক। পাঁচ বছর বয়সে তাঁর আব্বাজান মাহবুবে ইলাহী খাজা খলিলুর রহমান শাহ্(কঃ),শাহ্চান্দ আউলিয়ার মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা নুরুল হক শাহ্(রহ্ঃ) এর নিকট অর্পণ করেন। তাঁর কাছে আরবি, ফার্সি ও উর্দু ভাষায় বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করেন।উক্ত মাদ্রাসায় কৃতিত্বের সাথে বিদ্যালাভের পর,উচ্চ শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে ভারত যাবার কথা তাঁর আব্বাজানের নিকট জানালে তিনি অনুমতি না দিয়ে ইনসানিয়াতের (মানবতার) ত্বরীকার খেদমতে নিয়োগ দেন। এতে বাবাজান কেবলা একাগ্রতায়, বিচিত্র বিশিষ্টতায় অনুদিত করেছেন সূফিবাদ অনন্যে।
উপমহাদেশের অনন্য সূফিসাধক,আধ্যাত্মিক জগতের এক কিংবদন্তী বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব হাদীয়ে জমান,হযরত সৈয়্যদ আবু ছৈয়দ শাহ্ আল্ -আমিরভাণ্ডারী। যিনি আধ্যাত্মবাদের মূলে ¯্রষ্টার প্রতি গভীর আনুগত্যে মানব হৃদয়ে উৎকর্ষতায় আত্মনিবেদিত। কণ্ঠে সর্বদা উচ্চকিত ¯্রষ্টার প্রেমে উন্মীলিত হওয়ার উদাত্ত আহŸান।কোমল কচি হৃদয়ের ভালবাসার পরশ দিয়ে অবিরত ভক্ত-মুরিদানকে শুনিয়ে গেছেন অমর বাণী “সব সময় ভাবনা কর, তোমার সঙ্গে যাবে কি?” পথের মাঝে রোদের প্রখরে মৃতপ্রায় শামুক কুড়াতে কুড়াতে পথচলা,পিঁপড়াদের খাদ্য দেওয়া,কাকদের মেহমান বলে সম্বোধন করে ভাত দেওয়া যা রহমান মন্জিলের অনুগতদের কাছে বাবাজান কেবলার নসিহত।যা এখনও রেওয়াজ হিসেবে পালিত।এসব বিরল দৃষ্টান্ত শিশু সুলভ কোমল সুন্দর হৃদয়ের। প্রথমে স্বপ্নে, তারপর জাহেরে দর্শন, সাহচর্যে এসে আমূল পরিবর্তন। জাহেরি দ্বীনি শিক্ষার পর ইলমে তাছাউফ বা আধ্যাত্মিক জ্ঞানার্জনে ব্যাকুল হৃদয়ে তর সইছে না বুঝি-
“এক জমানা ছোহবতে বা আউলিয়া
বেহতর আজ ছদ ছালে তা আত বেরিয়া।”
(মসনবি শরীফ)
এক মুহূর্ত আউলিয়ার দর্শন লাভ করা শত বছরের ত্রুটিহীন (কবুল হওয়া)ইবাদত অপেক্ষা উত্তম। হযরত শাহ্ছুফি সৈয়দ মুহাম্মদ আবু ছৈয়দ শাহ্ আল-আমিরভাণ্ডারী একদিন স্বপ্নে দেখলেন, বিশাল এক মাহফিলে সমবেত অন্যান্যদের সাথে শামিল হয়ে তাঁর আব্বাজান মাহবুবে এলাহী খাজা খলিলুর রহমান শাহ্(রহ্.)নিকট বাইয়াত গ্রহণ করছেন। কালক্ষেপন না করে জাহেরে বাইয়াত ¯্রহনের পর ঐকান্তিক ও প্রজ্ঞাপ্রসূত সাম¯্রকি কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্ট ও আস্থাশীল হয়ে মাহবুবে এলাহী খাজা খলিলুর রহমান শাহ্(রহ্.) বাবাজান কেবলাকে আধ্যাত্বিক প্রতিনিধিত্ব বা খেলাফত প্রদান করেন এবং লোকজনকে মুরীদ করানোর এজাজত লাভ করেন। আল্লামা রুমী(রহ্.)বলেন, প্রত্যেক বৃত্তে জগতের আবর্তন -বিবর্তনের যুগে একজন বিশিষ্ট অলি থাকবেন। যাঁর পরীক্ষা -নিরীক্ষা কেয়ামত পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে। হযরত শাহ্ছুফী সৈয়দ আবু ছৈয়দ শাহ্(রহ্.)আল্ আমিরভাণ্ডারী নিঃসন্দেহে সমকালীন যুগশ্রেষ্ঠ অলি।ধরাধম ত্যাগের পূর্ব পর্যন্ত জাহেরে সাহচর্যে ত্বরীকত ও বিপথগামী মানুষকে সত্যব্রতী করেছেন। অকূল সাগরের উত্তাল ঢেউয়ে দিগভ্রান্ত জাহাজের পথ বাতলে দেওয়া, অসংখ্য অলিদের মাজার শনাক্তকরণ (বিশেষ করে মিয়া হাজী দৌলত)অসংখ্য মানুষের দূরারোগ্য ব্যাধিতে মুক্তি ও হাজারো মানুষের নেক নিয়ত পূরণ করেছেন এবং বেছালের পর এখনো করে চলেছেন। পৌষের হাড় কাঁপানো শীতে বস্ত্রছাড়া (লুঙ্গী ব্যতীত) অনাহার, নির্ভোগ, নির্ঘুম, নির্লোভ অভ্যাস আয়ত্তের মাধ্যমে আধ্যাত্ম সাধনের চরম শিখরে পৌঁছেছিলেন।এই মহান অলির ভবত্যাগের একমাস পূর্বে স্বীয় প্রতিষ্ঠিত খানকা শরীফ ও বিভিন্ন মুরীদানদের এলাকায় সফরে বের হন।এক পর্যায়ে পাহাড়তলী নোয়াপাড়া খানকা শরীফে অবস্থানকালে অসুস্থবোধ করেন। পড়ন্ত বিকেলের দিকে বাবাজান কেবলা বিশ্রাম স্বরূপ চোখের পাতাগুলি বন্ধ করলেন। উপস্থিত ভক্তগণ বাবাজান কেবলার শ্রাস-প্রশ্বাসের চলাচল না দেখে তাদের মুখগুলি বিষন্ন ও হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ল। অধিকন্তু সময় যাচ্ছে বাবাজান কেবলার উঠার ফুরসত নেই। ক্রমে ক্রমে ভক্তগণের কান্নার শব্দ উচ্চস্বরিত হচ্ছিল। হঠাৎ বাবাজান কেবলা আল্লাহু আকবর বলে উঠে বসলে সবার চোখ আশ্বর্যে বড় বড় হয়ে উঠলো। এরপর সেখান থেকে কালুরঘাট পরিভ্রমণে ঠিক দুপুরবেলা আমির ভাণ্ডার দরবার শরীফে ফিরে এসে সোজা আমিরুল আউলিয়া(ক.)এর রওজায় প্রবেশ করে ঘন্টাখানেক জেয়ারতের পর তাঁর আব্বাজান মাহবুবে এলাহী খাজা খলিলুর রহমান শাহ্(রহ্.) মাজারে প্রবেশ করেন। সেখান থেকে স্বীয় হুজুরায় প্রবেশ করে ভক্ত সমবেত হাবিবে রহমান মেরে বাবাজান, সাহবে সুলতান, আমিরুজ্জমান পড়তে থাকেন। সুললিত কণ্ঠ দেয়ালে দেয়ালে অনুরণিত হচ্ছে। দুপুর পেরিয়ে সন্ধে, একসময় রাত। রাতে আরেকবার আমিরুল আউলিয়া(ক.)র ওয়াজায় নামাজ ও অজিফা পাঠশেষে দাঁড়িয়ে অঝোরে অশ্রু ছেড়ে দু’হাত তুলে মোনাজাত করে আবারও স্বীয় হুজুরা শরীফে।
রাত বাড়তে থাকল। সুনসান নীরবতায় কারো কথা কারো কাছে বিনিময় হচ্ছিল না। চুপচাপ, ভীষণ চুপচাপ। ঘরময় আলোবিহীন গাঢ় অন্ধকার। একসময় এই অন্ধকারে দরজার অনতিদূরে বাবাজান কেবলার বিবি দাঁড়ালে, একজন শিষ্যকে ডেকে বলল-ঐখানে তোমার আম্মাজান বুঝি দাঁড়িয়ে আছে। ঘুমাতে যেতে বলো,কাল সকালে সকালে অনেক কাজ, তাড়াতাড়ি উঠতে হবে…
হ্যাঁ ঠিকই। সকাল সকাল সবাই উঠল। পাখিরাও উঠল তবে কিচিরমিচির করলো না। ঠিক সুবহে সাদিকের সময় ত্বরিত গতিতে হাজত সেরে, তাড়াতাড়ি ওজু করে হুজুরায় প্রবেশ করে আমিরুল আউলিয়া(ক.) রওজা-
মুখী হয়ে জোরে জোরে কালেমায়ে তৈয়্যবা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ পড়তে পড়তে এই জগৎ ছেড়ে মহান স্রষ্টার অনন্ত মিলনে ধন্য হন। দিনটি ছিল ১৯৯৯সালের ২১ সেপ্টেম্বর সোমবার।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক