হতবাক রোহিঙ্গারা খুঁজছে অনেক প্রশ্নের উত্তর

39

কক্সবাজার প্রতিনিধি

রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রহপ আল ইয়াকিনের লিডার মাস্টার আব্দুর রহিমের গুলিতে নিহত হয়েছেন বলে জানান আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (৮ এপিবিএন) এসপি শিহাব কায়সার খান।
মুহিবুল্লাহ’র ছোট ভাই হাবিবুল্লাহ দাবি করেন, ২০-২৫ জনের বন্দুকধারী দল তার ভাইয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওই অফিসে কর্মরত অন্যদেরও সন্ত্রাসীরা মারধর করে। পরে তাদের ছেড়ে দিলেও আবদুর রহিম মাস্টার তার ভাইয়ের বুকে গুলি চালায়। তিন রাউন্ড গুলি তার বুকে লাগে। বন্দুকধারীদের এ দলে মাস্টার আব্দুর রহিম, মুর্শিদ, লালুসহ ২০ থেকে ২৫ জন ছিল। তারা আল ইয়াকিনের সদস্য বলে দাবি করেন।
তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের যেকোনো সমস্যা সমাধানের জন্য আমার ভাই এগিয়ে আসতেন। তাদের অধিকার আদায়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছিলেন। শুধু এখানে নয়, আন্তর্জাতিক মহলেও আমার ভাইয়ের পরিচিতি ছিল। সেই যাত্রা বাধাগ্রস্ত করতে এ হামলা এবং তাকে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা।’
জানা গেছে, মুহিবুল্লাহ মিয়ানমারের আরকান মংডু এলাকার মৌলভী ফজল আহম্মদের ছেলে। ১৯৯২ সালে মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে আসেন তিনি। এরপর থেকেই উখিয়ার ক্যাম্প ও আশপাশের এলাকায় বসবাস করতেন। একপর্যায়ে ১৫ জন সদস্য নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’ (এআরএসপিএইচ)। জনশ্রæতি রয়েছে, এ সংগঠনের ব্যানারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতা করছিলেন তিনি।
২০১৭ সালে রোহিঙ্গার ঢল নামার পর থেকে পরিচিতি বাড়ে মুহিবুল্লাহর। এরপর তিনি আলোচনায় আসেন ২০১৯ সালে। সে বছর জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ১৭ দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ২৭ প্রতিনিধি সাক্ষাৎ করেন। সেখানে যোগ দেন মুহিবুল্লাহ। একই বছর রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসার দুই বছর পূর্তিতে তিনি আয়োজন করেন মহাসমাবেশ।
যখন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে যুক্ত হয় জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর), তখন থেকেই মুহিবুল্লাহর উত্থান শুরু। রোহিঙ্গাদের বক্তব্য জানতে মুহিবুল্লাহর সংগঠন ‘এআরএসপিএইচ’ এর সঙ্গে যোগাযোগ করে ‘ইউএনএইচসিআর’। ইংরেজি ভাষা এবং রোহিঙ্গাদের ব্যবহৃত ভাষা জানায় দুই পক্ষের যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে ওঠেন তিনি। ধীরে ধীরে প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন বিদেশিদের।
২০১৮ সালের পর জাতিসংঘ মহাসচিবসহ যত বিদেশি প্রতিনিধি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গেছেন তাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই রোহিঙ্গা প্রতিনিধি হিসেবে মুহিবুল্লাহ ও তার সঙ্গীদের সাক্ষাৎ হয়েছে। এই মুহিবুল্লাহই মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিবকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংলাপের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে মুহিবুল্লাহকে একাধিকবার আটক করে র‌্যাব। কিন্তু আবার প্রশাসনের নির্দেশে ছেড়ে দেওয়া হয় তাকে।
জানা যায়, চলতি বছরের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে খবর পাওয়া যায় যে ২২ আগস্ট প্রত্যাবাসনের দিন ঠিক করেছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। এ খবর পাওয়ার পরই মুহিবুল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে এনজিওগুলো। ধীরে ধীরে মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গাদের প্রধান পাঁচ নেতার একজন হয়ে ওঠেন।
রোহিঙ্গাদের একটি সূত্রের দাবি, ক্যাম্পগুলোতে মুহিবুল্লাহবিরোধী অন্য একটি সশস্ত্র গ্রুপও সক্রিয় রয়েছে। কিন্তু মুহিবুল্লাহর সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সুসম্পর্ক থাকায় আলোচনায় ছিল তার সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস। আর এ কারণে সাধারণ রোহিঙ্গারাও মুহিবুল্লাহর ভক্ত ছিলেন।
মুহিবুল্লাহ সবসময় বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সম্মানজনক প্রত্যাবাসন দাবি করে এসেছেন। এ কারণে মিয়ানমার সরকারেরও কালো তালিকায় ছিলেন তিনি। তার সাড়ে ৩ হাজার সক্রিয় ক্যাডার রয়েছে ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। তারা মুহিবুল্লাহর সিগন্যাল পাওয়া মাত্র যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতেন। তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সাধারণ রোহিঙ্গাদের মুহিবুল্লাহর আদেশ-নির্দেশ ও পরামর্শ ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দাবি, মুহিবুল্লাহ বিরোধী আল ইয়াকিন সংগঠনের নেতৃত্বে আছেন মাস্টার আব্দুর রহিম। মূলত নেতৃত্বের কোন্দল, আধিপত্য বিস্তার, ইয়াবা পাচার ও অস্ত্র সরবরাহকে কেন্দ্র করে এ হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে বলে আরেক রোহিঙ্গা নেতা কামাল উদ্দিন জানিয়েছেন।
এদিকে মুহিবুল্লাহ গ্রুপ সমর্থিত ক্যাডাররা প্রতিপক্ষকে কাফির বা বিশ্বাসঘাতক অবহিত করে এ পর্যন্ত ৩২ জনকে হত্যার দায় স্বীকার করেছে মুহিবুল্লাহ বাহিনী। অপরপক্ষে মোনাফেক দাবি করে মুহিবুল্লাহ গ্রুপের ১০ রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়। তাদের দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলছিল দীর্ঘ ২ বছর ধরে। এমনকি সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে শিক্ষিত ৩ জন রোহিঙ্গা নাগরিক প্রত্যাবাসনের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে খুন হয়েছে মুহিবুল্লাহ বাহিনীর হাতে। এরপর থেকে দুই গ্রুপের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে রূপ নেয়।
এ হত্যাকান্ডের পেছনে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ইন্ধন থাকারও দাবি করছেন অনেকেই।
তাদের দাবি, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর অস্ত্রের প্রধান উৎস মিয়ানমার। তাছাড়া সহায় সম্বল ফেলে চার বছর আগে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের হাতে কীভাবে এত অস্ত্র এলো, সে প্রশ্নও তাদের।
সা¤প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা এতোই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে, রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয় জনগোষ্ঠীও তাদের ভয়ে তটস্থ থাকেন। তুচ্ছ ঘটনায় ভারী অস্ত্র ব্যবহার, মুহূর্তেই রক্তপাত ও খুনোখুনির কারণে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের নিয়ে নিয়মিত আতংক ও উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন স্থানীয়রা। উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি ছোট-বড় রোহিঙ্গাক্যাম্পে দলগত সশস্ত্র তৎপরতা, মাদক-মানবপাচার, চাঁদাবাজি, অপহরণবাণিজ্য ও দোকান দখল থেকে শুরু করে তুচ্ছ ঘটনায়ও ব্যবহার করা হচ্ছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন রোহিঙ্গা জানান, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা তাদের পাহাড়ি আস্তানায় অবস্থান করে। রাতে তারা নেমে আসে ডাকাতিসহ খুন-খারাবি করতে। এমনকি পেশাদার এসব খুনিরা চুক্তিতে খুনের কাজও করে। হত্যা শেষে আবার চলে যায়। কাজ থাকলে এরা দিনে দুপুরেও খুন-খারাবি করে বীরদর্পে চলে যায়। এসব সন্ত্রাসীদের দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র মজুদ রয়েছে। অত্যাধুনিক অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র এখন সন্ত্রাসীদের হাতে হাতে বলেও জানান তারা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতে, মিয়ানমার থেকেও অস্ত্র আসে। পাশাপাশি অস্ত্র তৈরির কারিগর এনে ক্যাম্পসংলগ্ন পাহাড়ি জনপদে অস্ত্র নির্মাণ করছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। বলতে গেলে সীমান্তের সব রুট দিয়ে মাদক চালানের সঙ্গে অস্ত্র ঢুকছে। ফলে দিন দিন বিপদজনক হয়ে উঠছে সশস্ত্র রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো।