সড়ক দুর্ঘটনা কী অপ্রতিরোধ্য ?

29

দেশে মহামারির ন্যায় ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে সড়ক দুর্ঘটনা। সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে আন্দোলন, নতুন নতুন আইন প্রণয়ন, সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ নির্দেশনা- কিছুই যেন থামাতে পারছেনা সড়কে মৃত্যুর মিছিল। এ যেন এক অপ্রতিরোধ্য দৈত্য! প্রতিদিন খবরের কাগজ কিংবা টেলিভিশনের স্বচিত্র প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে দেশের সড়ক-মহাসড়কে, কোন না কোন এলাকায় একাধিক সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন মানুষ। এসব দুর্ঘটনায় মৃত্যুতো হচ্ছেই সেইসাথে যারা আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করছে-তাদের জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠছে। গত রবিবার কর্মদিবসের শুরুর দিন সকালে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলায় এক ভয়াবহ বাস দুর্ঘটনায় অন্তত ১৯ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ২০ জন। মাদারীপুর থেকে ঢাকাগামী ইমাদ পরিবহণের বাসটির প্রায় সকল যাত্রী সকালে যথাসময়ে কর্মস্থলে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ফিরে আসছিলেন জীবনের তাগিদে। কিন্তু বাসের চালকের ইচ্ছেমত বেপরোয়া গতিতে চলা ইমাদ পরিবহনটি রেরিং ভেঙে এক্সপ্রেসওয়ে থেকে ছিটকে প্রায় ১০ ফিট নিচে পড়ে যায়। এতে তাৎক্ষণিক ১৯টি জীবন প্রদীপ নিভে যায়। ফায়ান সার্ভিসের তদন্তে দেখা যায়, দুর্ঘটনাকবলিত বাসটির সামনের একটি চাকা ফেটে গেলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়ের রেলিং ভেঙে খাদে ছিটকে পড়ে। জানা যায়, এ বাসটির চলাচলের অনুমতি ছিল না। গত বছর নভেম্বরে এ বাস একবার দুর্ঘটনায় পড়েছিল এবং সে ঘটনায় নিহত হয়েছিল তিনজন। এ কারণে বাসটির চলাচলের অনুমতি স্থগিত রাখা হয়েছিল। এছাড়া বাসটির ফিটনেস সার্টিফিকেটের মেয়াদও পেরিয়ে গিয়েছে অনেক আগে। প্রশ্ন হলো, এরপরও কীভাবে সেই বাস মহাসড়কে চলার সুযোগ পায়? বাসটি চলাচলের অনুপযুক্ত থাকা দুর্ঘটনার একটি কারণ সন্দেহ নেই। দ্বিতীয়ত, চালক এর আগে মাদারীপুর থেকে ঢাকায়, ঢাকা থেকে মাদারীপুর ফিরে কোনরকম বিশ্রাম ছাড়াই গাড়ি নিয়ে আবারও ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্র করেছিলেন। সঙ্গতকারণে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ৩০ ঘণ্টার বেশি বাস চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন চালক। এটি দুর্ঘটনার আরেকটি কারণ। বস্তুত সড়ক দুর্ঘটনার নানা কারণের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো-চালকের অদক্ষতা, চালকের ক্লান্তি, গাড়ির বেপরোয়া গতি এবং গাড়ির ফিটনেস না থাকা। দেখা যাচ্ছে, এসব কারণের প্রায় সবই এ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এঘটনার তিনদিন পর পার্বত্য জেলা বান্দরবানে বিপরীত দিক থেকে আসা দুইটি ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ৬জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে ৫জন নারী। আহত হয়েছে ১০জন, এরমধ্যে ৯জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এ দুর্ঘটনাটিও ঘটেছে দুই ট্রাকের চালকের অসতর্কতার জন্য।
গবেষণায় দেখা যায়, ৯০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী যানবাহনের অতিরিক্ত গতি, চালকের বেপরোয়া মনোভাব, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ফোন ব্যবহার, অতিরিক্ত মাদক সেবন এবং অসতর্কতার কারণে হচ্ছে। মহাসড়কে যান চলাচলের সর্বোচ্চ গতি বেঁধে দিয়ে এবং গতি পরিমাপক যন্ত্র ব্যবহার করে চালকদের ওই নির্দিষ্ট গতি মেনে চলতে বাধ্য করা হলে দুর্ঘটনা অনেক কমে আসবে বলে মনে করি আমরা। তাছাড়া চালকের দক্ষতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে। মহাসড়ক নির্মাণ ও সংস্কারের কাজ করতে হবে সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী। অনেক পরিবহন মালিক চালকদের পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ দেন না। ক্লান্তশ্রান্ত চালক গাড়ি চালালে স্বভাবতই তাতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যায়। বস্তুত এ ঝুঁকিগুলোর কথা গণমাধ্যম এবং বিশেষজ্ঞ পর্যায় থেকে বারবার বলা হয়। সড়ক দুর্ঘটনার কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে নানা ধরনের পরামর্শ ও সুপারিশও করা হয়। কিন্তু কেউ তাতে কর্ণপাত করেন বলে মনে হয় না। কর্তৃপক্ষও যেন নির্বিকার। ফলে একের পর এক ঘটে চলেছে দুর্ঘটনা।
দুর্ঘটনা রোধে একটি যুগোপযোগী সড়ক পরিবহন আইনের গণদাবি ছিল দীর্ঘদিনের। ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাসের চাপায় দুই কলেজ শিক্ষার্থী নিহত হয়। এ ঘটনায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে সারা দেশে রাস্তায় নেমে আসে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর তড়িঘড়ি করে পাশ করা হয় সড়ক পরিবহন আইন। এরপর আইনটির বেশ কয়েকটি ধারা সংশোধনের দাবিতে আন্দোলনে নামেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। এ কারণে এক বছরেরও বেশি সময় আটকে ছিল আইনটির বাস্তবায়ন। অবশেষে ২০১৯ সালে আইনটি কার্যকর হয়; কিন্তু এর যথাযথ বাস্তবায়ন আজও নিশ্চিত করা হয়নি। ফলে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা পার পেয়ে যাচ্ছেন সহজেই। দেশে সড়ক দুর্ঘটনা উদ্বেগজনক মাত্রায় বৃদ্ধি পাওয়ায় এ আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে করি। আমাদের সরকার স্মার্ট বাংলাদেশের ¯েøাগান নিয়ে আগামীর উন্নত বাংলাদেশের দিকে এগুচ্ছে। কিন্তু দেশের সর্বত্র ডিজিটাল পদ্ধতি চালু হলেও সড়ক-মহাসড়ক এমনকি ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটির সড়কগুলোর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা এখনও এনালগ। সড়কে গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ এবং তা প্রয়োগের কোন উদ্যোগ নেই। যে উদ্দেশ্যে সরকার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে মহ সড়ক করছে, এক্সপ্রেসওয়ে করছে তার সফলতা নির্ভর করবে সড়কগুলো নিরাপদ করার মধ্যে। এ বিষয়ে সরকার মনোযোগী হবে- এমনটি প্রত্যাশা।