সড়কের ওপর অবৈধ মাইক্রোবাস স্টেশন

25

করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারের লকডাউন চলাকালীন সময়ে গণপরিবহন চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এরপরেও পুলিশকে ম্যানেজ করে নগরীর শাহ আমানত সেতু সংযোগ সড়কের শহীদ বশরুজ্জামান চত্ত্বরে লাইনম্যান ও পুলিশের মাধ্যমে অবৈধভাবে হাইয়েচ/মাইক্রোবাসের মাধ্যমে যাত্রী পরিবহন করছে চালকরা। অথচ স্বাভাবিক সময়েও ওই এলাকায় হাইয়েচ দাঁড়ানো নিষেধ রয়েছে।
নগর পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক ও অপরাধ) বলছেন, আর্থিক লেনদেনের সত্যতা পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
চালকদের সূত্রে জানা গেছে, লকডাউনের সুযোগ নিয়ে হাইয়েচ চালকদের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ নিয়ে অনুমতি প্রদান করেছে বাকলিয়া থানা পুলিশ ও লোকাল ট্রাফিক পরিদর্শক (টিআই)।
বাকলিয়া থানা বলছে, আমাদের নামে এসব কথা কে বলেছে? ওরা ওরা চাঁদাবাজি করে শেষ পর্যন্ত পুলিশের নামে চালিয়ে দেয়।
সরেজমিনে গত বৃহস্পতিবার রাত এবং গত শুক্রবার সকালে গিয়ে দেখা যায়, সারিবদ্ধভাবে প্রায় ১৭ থেকে ২০টি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। হাইয়েচের হেলপার যাত্রী ডাকছেন। একটি ছাড়লে দিলে আরেকটি মাইক্রোতে যাত্রী তুলছেন তারা। যাত্রী তোলার আগে অর্থাৎ লাইনে ঢুকানোর আগেই লাইনম্যানের হাতে ১ হাজার টাকা দিতে হবে। তা না হলে যাত্রী তোলা যাবে না। একটির পর একটি মাইক্রো শাহ আমানত সেতুর বশরুজ্জামান চত্ত¡র থেকে ছেড়ে যেতে দেখা গেছে। আবার যেগুলো ফিরে আসছে সেগুলো পেছনের পেছনে যুক্ত হচ্ছে। এভাবেই চলমান লকডাউওেন দৈনিক ১৫০ থেকে ২০০টি গাড়ি শাহ আমানত সেতু হতে ছেড়ে যাচ্ছে।
আবার সেখানে দাঁড়ানো হাইয়েচ মাইক্রোবাসের ভাড়া নিয়মিত ভাড়ার চেয়ে চারগুণ ভাড়া নিতে দেখা গেছে। তার সত্যতাও জানিয়েছেন যাত্রীরা।
যাত্রী মো. সেলিম উদ্দিন বলেন, এখান (শাহ আমানত সেতু) থেকে লোহাগাড়ার ভাড়া সচরাচর ১০০ টাকা করে দিতাম। আমাদের কাছ থেকে এখন সাড়ে তিনশো থেকে চারশো টাকা পর্যন্ত আদায় করছে।
অতিরিক্ত টাকা নেয়ার বিষয়টি স্বীকার করে হাইয়েচ মাইক্রো চালক মো. নুরুল কবির বলেন, আমরা তিন থেকে চারগুণ অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছি সেটা সত্য। দীর্ঘদিন ধরে লাইনম্যান মো. আইয়ুবকে গাড়িপ্রতি ২৫০ টাকা করে দিয়ে আসছি। মাঝখানে হাইয়েচ মালিক সমিতির সদস্যরা চাপ প্রয়োগ করলে তা ৮০ থেকে ১০০ টাকায় নেমে আসে। কিন্তু বর্তমানে লকডাউনে তা বাড়িয়ে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করছে। এতে একবার টাকা দিতে অস্বীকার করলে আইয়ুব আমার গাড়ির গ্লাস ভেঙে দেয়। তাই বাধ্য হয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করতে হচ্ছে।
আরেক চালক মো. মামুন বলেন, ওসি স্যার এবং টিআই স্যারদের নাম দিয়ে আমাদের কাছ থেকে আইয়ুব গাড়ি প্রতি ১ হাজার টাকা দাবি করেছে। আমরা মাইক্রোবাস শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার কারণে টাকা দিতে অপারগতা দেখাই। ওসি স্যারকে বিষয়টি জানালে ওসি স্যার উল্টো আমাকে চাঁদাবাজি মামলা দিবে বলে হুমকি দেন। তাহলে আমরা এখন যাবো কোথায়?
চট্টগ্রাম হাইয়েচ মালিক সমিতির লাইন সেক্রেটারি মো. সাইফুর রহমান পূর্বদেশকে জানান, লকডাউনে গাড়ি চালানো অন্যায় সেটি আমি স্বীকার করছি। তাই বলে পুলিশ আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে আইয়ুব কেন টাকা নিবে? সে তো আমাদের মালিক সমিতির একজন সদস্য ছিল। এখানে যতগুলো গাড়ি আছে সব গাড়ির কাগজপত্র ঠিক আছে। লকডাউনে চালকরা খেতে পারছে না বলে গাড়ি বের করেছে। কিন্তু পুলিশের নাম দিয়ে গাড়ি প্রতি ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা আদায় করাটা অন্যায়।
তিনি আরও জানান, গাড়িগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ার জন্য স্বাভাবিক সময়ে মাসে বাকলিয়া থানায় ৪০ হাজার টাকা এবং ট্রাফিক পরিদর্শককে (টিআই) ২০ হাজার টাকা করে প্রদান করতো লাইনম্যান আইয়ুব আলী। কিন্তু লকডাউনে গণপরিবহন বন্ধ ঘোষণার পর থানাকে দৈনিক ৫ হাজার টাকা এবং টিআইকেও দৈনিক ৫ হাজার টাকা প্রদান করছে সে। সেজন্য তারা আইয়ুবের কথাকে গুরুত্ব দিয়ে আমাদের কথার কর্ণপাত করছেন না। অথচ আইয়ুব আলী নিয়মিত টাকা দিচ্ছে বলে তার সবকিছু বৈধ।
সাইফুর রহমান আরও বলেন, গতকাল (বৃহস্পতিবার) কয়েকজন চালক ১ হাজার টাকা দাবির বিষয়টি আমাকে জানালে আমি থানায় গিয়েছি অভিযোগ করতে। কিন্তু ডিউটি অফিসার ওসির কথামত আমার অভিযোগ না নিয়ে সরাসরি ওসির সাথে দেখা করতে বলেন। কিন্তু আজকে যখন ওসির সাথে দেখা করতে যাওয়ার জন্য কল দিলাম, তখন উনি আমাকে নানাভাবে হুমকি দিতে থাকেন। ওসি স্যার আমাকে বলেছেন, ‘তোমার গাড়ি বহদ্দারহাটের, তুমি নতুন ব্রিজে রাখবে কেন? তোমাদের বৈধতা কি আছে? ওখানে আইয়ুব দীর্ঘদিন ধরে গাড়ি রাখছে। তার সাথে ঝামেলা করিও না। আর ঝামেলায় জড়ালে তোমাদের প্রত্যেককে মোবাইল টিমের মাধ্যমে তুলে এনে চাঁদাবাজি মামলা দিবো’।
বিষয়টি জানতে হাইয়েচের লাইনম্যান মো. আইয়ুব আলীর সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি রিসিভ করে সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ায় সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এর আগে একবার তার সাথে এই প্রতিবেদকের কথা হলে তখন তিনি বলেছিলেন, আমরা পুলিশকে তেমন টাকা পয়সা দিইনা, শুধু যারা এখানে মোবাইল ডিউটিতে আসেন তাদেরকে চা পানির খরচা দিই মাত্র। অবৈধভাবে কেমনে হাইয়েচ দাঁড় করান- এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেন, অবৈধ সেটা আমরা মানছি। তবে বিভিন্ন জায়গায় ম্যানেজ না করলে তো আর দাঁড়াতে পারবো না।
বাকলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রুহুল আমিন বলেন, আমি নিয়মিত ট্রাফিক পুলিশের মাধ্যমে মামলা ও আটক করছি। প্রয়োজনে আজ থেকে এটার বিষয়ে আমি এখনই অভিযান পরিচালনা করবো। ওখানে তিন-চারজনে মিলে চাঁদা আদায় করে, তারা তারা ঠিক থাকতে পারছে না বলে এখন দোষ সব পুলিশের উপরেই আসছে।
বাকলিয়া থানার ট্রাফিক পরিদর্শক মো. শামসুদ্দিনকে দুইবার ফোন করা হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি। তবে নগর ট্রাফিক পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) এনএম নাসিরউদ্দিন বলেন, লকডাউনে কোনো রকমের গণপরিবহন চলতে পারবে না। যদি হাইয়েচ স্টেশন চালাতে আমাদের ট্রাফিক বিভাগের কারও সাথে আর্থিক সম্পৃক্ততা থাকে তবে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমি এ বিষয়ে এখনই খোঁজ নিচ্ছি।
সিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) এম এম মেহেদী হাসান পূর্বদেশকে বলেন, সরকারি নির্দেশনার বাইরে থানা পুলিশ এভাবে অনুমোদন দিতে পারে না। থানা পুলিশের যদি কেউ আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে জড়িত থাকে তবে ব্যবস্থা নিবো।