স্যালুট সাফ জয়ী আমাদের মেয়েদের

37

আকতার কামাল চৌধূরী

সমাজের অচলায়তন ভেঙ্গে, স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতারকাটা আমাদের নারীরা সর্বশক্তি ব্যয় করে গন্তব্যে পৌঁছেছেন। নেপালকে ৩-০ তে হারিয়ে আজ সাফ কাপ চ্যাম্পিয়ন। অভিনন্দনের জোয়ারে ভাসছেন, ছাদ খোলা বাসে পুষ্প বৃষ্টিতে তাঁদের জন্য সব ভালোবাসা উজাড় করে দিতে কার্পণ্য নেই কারও। অর্থ, জশ, খ্যাতি সবই পাবেন, ক্ষেত্রবিশেষে বাড়িও পাবেন। পাওয়া উচিত-ও। একদিন হয়তো ডাক পড়বে সরকার প্রধানের আতিথ্য গ্রহণের।
আমার ভাবনা অন্যখানে। ১৯৯০ সালের সেই ডানা কাপ, গোথিয়াকাপের কথা আমাদের মনে আছে নিশ্চয়। বিকেএসপির অনূর্ধ্ব-১৪ ফুটবল বালকেরা ডানা কাপ আর গোথিয়া কাপ জিতেছিল। দেশে ফেরার দিনে তাদের বহনকরা প্লেন ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণ করতে হিমসিম খাচ্ছিলো। বিমান বন্দরের ভিতর-বাইরে লোকে লোকারন্য। অভিনন্দন জানাতে আসা ভক্তদের উচ্ছ¡াস আর রঙের খেলায় বিমানবন্দর রোড বন্ধ হয়ে বিদেশ যাত্রীদের প্লেনে উঠা দায় হয়ে পড়েছিল সেদিন। ক্রীড়াপাগল বাংলাদেশিদের এই উৎলা নৃত্য দেখে অবাক বিদেশি বিমান যাত্রীরা। তাঁরা অবোধের মতো হাসতেই থাকেন।
তাঁদের এই রম্য হাসির একটা অর্থ ছিল। তাঁদের ভাবখানা হয়তো এই, কী একটা কাপ জিতে আনলো এদেশের বাচ্চারা, মানুষের উল্লাস দেখে তো মনে হয় বিশ্বকাপ নিয়ে এসেছে।
এ-নিয়ে প্রত্যেক পত্রিকা লীড নিউজ করে। সম্পাদকীয়, উপ সম্পাদকীয় কলামে কলমযোদ্ধারা সব আবেগ ঢেলে দেন। বিকেএসপির প্রশংসায় পঞ্চমুখ সবাই। অনেকে এই টিমের মধ্যে বিশ্বকাপ জয়েরও স্বপ্ন দেখান। ‘স্বপ্নসত্যি হওয়ায়’ অনেক কবি ‘বিশ্বজয়ী’সোনার ছেলেদের নিয়ে কবিতাও লিখেন। বঙ্গভবনে ডাকও পায় খেলোয়াড়েরা।
তখন বিটিভি-ই একমাত্র ইলেকট্রনিক মিডিয়া। আর কোনো টিভি চ্যানেলের জন্ম হয়নি। টেবিলে কফির মগ রেখে ছাদ ফাটানো জম্পেশ টকশো থেকেও তাই আমরা বঞ্চিত হই।
ধারণকৃত খেলাটা বিটিভি একদিন দেখায়। খেলা দেখতে দেখতে চোখকচলাতে থাকেন অনেকেই। পুরো স্টেডিয়াম দর্শক শূন্য, কোথাও কোনো চেঁচামেচি নাই, হুল্লোড় নাই, তালি দেওয়ার লোক নাই। অনূর্ধ্ব-১৪ হলেও বাংলাদেশের বাচ্চারা যে ‘বাচ্চা’ নয়, তারা যে অনূর্ধ্ব-১৪ মাঠে অন্য দেশের খেলোয়াড়দের শারীরিক গঠন তুলনা করলেই বোঝা যায়। এ-নিয়ে পত্র পত্রিকায় প্রচুর লেখালেখিও হয়।
কয়েকটি দেশের অনূর্ধ্ব-১৪ খেলোয়াড়দের নিয়ে এই আয়োজন। এই খেলা নিয়ে তেমন কোনো মাতামাতিও ছিলনা কোনো দেশে। বিদেশিদের মুচকি হাসির অর্থ আরও পরিষ্কার হলো পরে।
তখন আমাদের বয়সও বাকতো! সেই বয়সেও আমার মন বলছিল, ‘এই বেলুন ক্রমান্বয়ে চুপসে যাবে। বাঙালী তেলখাওয়ার জাতি, অতি প্রশংসা এদের পচন ধরায়। একসময় পা মাটি থেকে আলগা হয়ে যাবে। একটা স্টার স্টার ভাব এই বাচ্চাদের মাথা চেপে ধরবে। এই চাপে মাথা মাটির সাথে মিশে না যাওয়া পর্যন্ত নিস্তার নাই।
আজ যদি প্রশ্ন করি, বিকেএসপির সেই ছেলেরা এখন কোথায়? তারা কি ডানা কাপ, গোথিয়া কাপ জয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পেরেছিল? ক্রীড়াঙ্গনে তাদের আর কী কী সাফল্য ছিল? দেশ কাঁপানো বরণোৎসবের প্রতিদানে তারা মানুষকে কী দিতে পেরেছে? দেশে আজ ফুটবলের এই হতশ্রী দশাওবা কেন?
আজ প্রমিলা ফুটবলে সাফ কাপ জেতা আমাদের মেয়েদের পারফরম্যান্স দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারিনা। গোল কিপিং, ডিফেন্ডিং, ফরওয়ার্ডিং, স্ট্রাইকিং-সব বিভাগেই তাঁরা একদম দাপুটে। তাই আমরা ছাদ খোলা গাড়িতে বরণডালা সাজিয়েছি। পথে পথে ফুলের পাঁপড়ি ছিটিয়ে হৃদয়ের অর্ঘ্য ঢেলে দিয়েছি। পুরো জাতি এই মেয়েদের সম্মানে আজ এক কাট্টা।
কিন্তু আবেগী জাতি হিসেবে আমার শঙ্কা জাগে, বিকেএসপির ছেলেদের মতো মানুষের ভালোবাসার জোয়ারে সবকিছু কি আবার ভাসিয়ে নিয়ে যাবে?
না, এখানে হিসেবটা ভিন্ন। সাফ জয়ীরা নারী। তাঁরা সমাজের প্রান্তিক এলাকা থেকে উঠে আসা, ঘাত-প্রতিঘাতে পোড় খাওয়া মানুষ। বিশেষ করে ফুটবলে পুরুষদের দেখতে অভ্যস্থ সমাজে নানা ভ্রুকুটি, উপহাস, তাচ্ছিল্য উপেক্ষা করে, নিজের সাথে নিত্য মনস্তাত্তি¡ক যুদ্ধ করে এ পর্যন্ত এসেছে। আর কত কাল পেছনে পড়ে থাকবে নারী সমাজ। বিজয় শুধু বিজয়-ই নয়, এই বিজয় নারীদের আরও সামনে আসার সুযোগ করে দিয়েছে। এই যুদ্ধ নারী জাগরণের যুদ্ধও। তাই এতদূর যাঁরা হেঁটেছেন তাঁরা আরও বহুদূর এগিয়ে যেতে পারবেন। আমাদের নারী সমাজ আজ সবকিছুতে এগিয়ে আসছে, এই বিজয় তার-ই প্রকৃষ্ট উদাহরণ। অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে অন্ধকারে রেখে কোনো উন্নয়নই বাস্তবে সম্ভব নয়।
আজ থোকা থোকা রঙিন বেলুনে ছেয়ে গেছে বাংলাদেশের আকাশ। এই বেলুন আমাদের আকাশছোঁয়া প্রত্যাশার বেলুন। ও-গুলো যেন চুপসে না যায়।
লেখক- প্রাবন্ধিক