স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু (১৮৫৮-১৯৩৭)

193

ছোটবেলায় গাছপালা দেখলেই পাতা ছেঁড়া, ডালপালা ভাঙ্গা প্রায় আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ আর পারলাম না,কারণ স্কুলের শিক্ষিকা একদিন বললেন যে,আমাদের যেমন হাত কাটা গেলে আমরা ব্যাথা পাই তেমনি গাছেরাও একই অনুভূতিতে সাড়া দেয়। কথাগুলো শোনার পর থেকে নিজের এই বদঅভ্যাস থেকে সরে তো আসলামই,অন্যদেরও দেখলে বকা দিতাম। স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, হ্যাঁ, তিনিই বিশ্ববাসীকে প্রথমবারের মত জানিয়েছিলেন উদ্ভিদের মধ্যে আছে প্রানশক্তি। এটি প্রমাণের জন্যে তিনি ‘ক্রেস্কোগ্রাফ’ নামক একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন,যা উদ্ভিদদেহের সামান্য সাড়াকে লক্ষগুণ বৃদ্ধি করে প্রদর্শণ করে। আজ এখানে জগদীশ চন্দ্র বসুর আলাদা গুরুত্ব তুলে ধরতে চাই। তিনি যে শুধু বাঙালি তা নয়,তাঁর জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশেরই ময়মনসিংহ শহরে ১৮৫৮ সালে ৩০শে নভেম্বের। তাঁর পিতার নাম ভগবান চন্দ্র বসু (জেলার তৎকালীন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট) এবং মায়ের নাম বামা সুন্দরী দেবী। তাঁর শিক্ষাজীবনের ধাপগুলো শুরু হয় ফরিদপুরে,তারপর ১৮৬৯ সালে হেয়ার স্কুল,সেখান থেকে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল। তিনি ১৮৭৫ ষোল বছর বয়সে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উর্ত্তীণ হয়ে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হোন। সেখান থেকে ১৮৭৭সালে অনার্স এবং ১৮৭৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি .এস.সি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৮৮০ সালে ভারত ছেড়ে লন্ডনে ডাক্তারি পড়ার জন্য মেডিকেল ইনস্টিটিউটে ভর্তি হলেন। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে তা বাদ দিয়ে ১৮৮১ সালে লন্ডন ত্যাগ করে কেম্ব্রিজে যান। ১৮৮৪ সালে কেম্ব্রিজ ক্রাইস্ট কলেজ থেকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বিষয়ে ট্রাইপোস (কেম্ব্রিজের বিশেষ কোর্স) এবং একই সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এস.সি ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরলেন। ১৮৮৫ সালে জগদীশ বসু প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা জীবন শুরু করলেন। তিনি তাঁর মৌলিক গবেষণা কলেজের ল্যাবরেটরিতে শুরু করলেন। প্রথম জীবনে তিনি ইথার তরঙ্গ ও বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। তাঁর গবেষণার প্রথম সাফল্য ছিল বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের সাহায্যে সংকেত বা সংবাদ প্রেরণের সম্ভাবনা আবিষ্কার,যা এখন থেকে দেড়শত বছর আগের কথা ! আমরা যে এফএম বা রেডিওতে গানের মূর্ছনায় হারিয়ে যাই তার আবিষ্কারক হিসেবে কিছুদিন আগেও পুরো বিশ্ববাসী ইটালির বিজ্ঞানী মার্কোনিকেই জানত। কিন্তু ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত ওঊঊঊ (ওহংঃরঃঁঃব ড়ভ ঊষবপঃৎরপধষ ধহফ ঊষবপঃৎড়হরপং ঊহমরহববৎং) এর প্রসিডিঙ্গে আমাদের জগদীশ বসুকে রেডিওর প্রকৃত আবিষ্কারক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কারণ,মার্কোনি তার আবিষ্কারে অনেক সূক্ষ্র যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেছিলেন যার মধ্যে একটি হচ্ছে কোহেরার (২টি ধাতব পাতের মাঝে খানিকটা পারদ),যা ছিল রেডিও বা তারহীন সংকেত পাঠানোর প্রক্রিয়ার মূল বিষয়। মজার ব্যপার হচ্ছে এই কোহেরার এর প্রকৃত আবিষ্কারক স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, যা মার্কোনি বা তার সমসাময়িক বিজ্ঞানীরা কেউ স্বীকার করেনি।
মার্কোনি বসুর তৈরি কোহেরারটি সামান্য পরিবর্তন করেছিলেন। বসুর কোহেরারটি ছিল ট আকৃতির মত আর মার্কোনিরটি ছিল সোজা। ১৯৩৭ সালের ২৩ শে নভেম্বর জগদীশ চন্দ্র বসু তাঁর কর্মময় জীবন থেকে চিরবিদায় নিলেন। আমরা তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম উত্তরাধিকার সূত্রে পেলাম ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির।’ তিনি একজন সাহিত্যিকও ছিলেন। তাঁর লেখা ‘অব্যক্ত’ বাংলা ভাষায় একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এছাড়াও আমরা যে সায়েন্স ফিকশানগুলো পড়ে বিজ্ঞানকে নিয়ে প্রতিনিয়ত নতুনভাবে চিন্তা করি,তার জনক হলেন জগদীশ চন্দ্র বসু। ১৮৯৬ সালে তাঁর লেখা প্রথম সায়েন্স ফিকশানটির নাম ছিল ‘নিরুদ্দেশের কাহিনী’। স্যার নেভিল মট ১৯৭৭ সালে বসু সম্পর্কে উল্লেখ করে বলেন, ‘জগদীশ চন্দ্র বসু তার সময় অপেক্ষা ৬০ বছর এগিয়ে ছিলেন’। বিজ্ঞানে তাঁর অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আজ তিনিও রেডিও আবিষ্কারের অন্যতম জনক। সূত্র : ইন্টারনেট