স্মৃতিতে বীর মুক্তিযোদ্ধা ব্যারিস্টার আমিনুল হক

14

জিয়া হাবীব আহ্সান, অ্যাডভোকেট

 

ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম জেলা বার এসোসিয়েশন এর প্রবীণতম সদস্য, চট্টগ্রাম আইন কলেজের প্রাক্তন শিক্ষক, (নিউ চাক্তাই তদানিন্তন ন্যাশনাল স্টোর ও মেসার্স বাগদাদ রাইস, ফ্লাওয়ার এন্ড অয়েল মিলস এর স্বত্বাধিকারী মরহুম আলহাজ্ব হাফেজুর রহমানের ২য় সন্তান), পটিয়া বিনিনিহারা গ্রামের ও কুসুমপুরা ইউনিয়নের কৃতি সন্তান, লালখান বাজার, হাই লেভেল রোডস্থ ‘‘হেলেন ভিউ’’ নিবাসী আলহাজ্ব ব্যারিষ্টার আমিনুল হক (৮৬) প্রথম মৃত্যুর্বাষকিী গত বছর ২০ই জুলাই ২০২২ইং এমন দনিে বুধবার সকাল ১১.১৫ টায় নগরীর একটি হাসপাতালে আই.সি.ইউ-তে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। (ইন্না-লিল্লাহ ওয়া ইন্না লিল্লাইলাহে রাজেউন)। ঐদিন বুধবার বাদ জোহর লালখানবাজার হেলেন ভিউ হাই লেভেল রোডস্থ নিজ বাসভবন চত্বরে মরহুমের প্রথম নামাজে জানাজা ও বাদ আসর চট্টগ্রামের হযরত গরীবুল্লাহ্ শাহ্ মাজার মসজিদ প্রাঙ্গণে ২য় নামাজে জানাজা শেষে তৎ সংলগ্ন কবরস্থানে তাঁর বড় ভাই মরহুম আব্দুর রশিদ সওদাগর ও ছোট বোন আলহাজ্ব নূর বেগমের কবরের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। তিনি লাং ইনফেকশন, শ্বাসকষ্ট, ডায়বেটিস, কিডনীসহ নানা বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। বিশিষ্ট আইনবিদ মরহুম ব্যারিস্টার আমিনুল হক চট্টগ্রাম আইন কলেজের শিক্ষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের পরীক্ষক ছিলেন। তিনি সবসময় একজন বিনয়ী ভদ্র ও অমায়িক স্বভাবের ব্যক্তি ছিলেন। মরহুম ব্যারিস্টার আমিনুল হক একজন প্রচার বিমুখ সজ্জন মানুষ ছিলেন। শিক্ষানুরাগী মানুষটি ছাত্রজীবন থেকেই আর্থিক অসচ্ছলতার কারনে পরিচিত অপরিচিত বন্ধু বান্ধবসহ বহু শিক্ষার্থীকে আর্থিক অনুদান ও কর্জে হাসানা দিয়ে তাদের ম‚ল্যবান শিক্ষা জীবন রক্ষা করেন। যা আমরা লোকমুখে শুনেছি। ভাড়াটিয়াদের প্রতি তিনি খুবই সদয় ছিলেন। বছরের পর বছর তিনি ভাড়া বাড়াতেন না এবং গ্যাস পানির বিলও নিতেন না। আমার শ্বশুর আব্বা চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স, চিটাগাং কো অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটির সদস্য ও ১৯৭৮ সালের দিকে উক্ত সোসাইটির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। তাছাড়া তিনি মুসলিম এডুকেশন সোসাইটির আজীবন সদস্য ও চট্টগ্রাম কলেজ প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী সমিতির আজীবন সদস্য ছিলেন। মানুষ হিসেবে খুবই সৎ এবং এক কথার লোক। আমার বাবা নাকি সৎ মানুষের মেয়ে খুঁজতে গিয়ে তাঁকে আবিষ্কার করেন। আমার বিয়ের উকিল ছিলেন চট্টগ্রামের ইতিহাস লেখক মরহুম আব্দুল হক চৌধুরীর পুত্র মরহুম এডভোকেট মোহাম্মদ আমিন চৌধুরী। আমার স্ত্রী মিসেস আশফা খানম মরহুম আমিনুল হক সাহেবের বড় মেয়ে। তিনিও একজন আদর্শ শিক্ষিকা। তিনি বর্তমানে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল সিভিএনএস এর প্রিন্সিপ্যাল এর দায়িত্বে আছেন। আমার শ্বশুর আব্বা পটিয়া উপজেলার বিনিনিহারা গ্রামে ১৯৪২ সালের ১৩ই জুলাই এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন।
তিনি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ১৯৫৭ সালে আইএ, ১৯৫৯ সালে গ্রাজুয়েশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইকবাল হলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে ১৯৬২ সালে এম এ, ১৯৬৩ সালে এলএল.বি ডিগ্রী অর্জন ও ০৮/১১/১৯৬৪ ইং সনে বার কাউন্সিল সনদ লাভে আইন পেশায় যোগ দেন। এর পর তিনি উচ্চ শিক্ষার্থে লন্ডন গমন করেন এবং ১৯৬৯ সনে বিলাতের লিংকন্স ইন থেকে বার-এট-ল ডিগ্রী অর্জন করে ১৯৭১সালের শুরুতে দেশে ফিরে এসে মুক্তি সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১সালে পাক সেনাদের বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নকশা বাস্তবায়নে অজ্ঞাত স্থানে অনেকের সাথে তাঁকেও ধরে নিয়ে গেলে হানাদার বাহিনীর কবল থেকে আল্লাহর রহমতে কৌশলে পরিচয় গোপন করে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে তিনি সেদিন একমাত্র বেঁচে যাওয়া মানুষটি। গণ বছর ২১শে ডিসেম্বর ২০২১ইং ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম জেলা বার সমিতির উদ্যোগে জেলা বার এসোসিয়েশন অডিটরিয়ামে ২১/১২/২১ইং তারিখে স্বাধীনুা ও বিজয়ের সুবর্নজয়ন্তী অনুষ্ঠানে এক অনাড়ম্বর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ রেজাউল করিম চৌধুরী, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম জেলা বার এসোসিয়েশন এর পক্ষ থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বিশেষ অবদানের জন্যে মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা প্রদান করা হয়। এছাড়াও আইন পেশায় ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে তাঁকে চট্টগ্রাম বার এসোসিয়েশন থেকে সন্মাননা প্রদান পূর্বক সংবর্ধিত করা হয়। তিনি আন্দরকিল্লায় অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম আইন কলেজে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেন। ব্যারিস্টার হক লায়ন্স ক্লাব এর প্রাক্তন ডিস্ট্রিক্ট প্রেসিডেন্ট (১৯৮১-১৯৮২ইং) ছিলেন। তিনি অত্যন্ত সৌখিন মনের মানুষ ছিলেন। কবিতা লিখা, ফটোগ্রাফী, গ্রামাফোনে গান শোনা, দুর্বল ম‚ল্যবান জিনিসপত্র, বই, দামী কলম, মুদ্রা, বড়শী সংগ্রহ করা তাঁর সখ ছিল। মৃত্যুর পর তাঁর সংগ্রহ থেকে যে সকল সৌখিন জিনিসপত্র পাওয়া যায় তারমধ্যে ১৮৯৮ সালের পূর্বের ও বিলাতি কয়েন, শিলিং, পেনি ইত্যাদি পাওয়া যায়। রাণী এলিজাবেথ এর ছবি সম্বলিত রুপোর, ব্রোঞ্জ, কপার নির্মিত কয়েনগুলোর বিশ্বে নিলাম বাজারে তা কতো হতে পারে তা অনুমানের বাইরে। বৃটিশ শাসনের সময় পাক ভারত উপমহাদেশের ব্যবহৃত ম‚ল্যবান কয়েনও তাঁর সংগ্রহে পাওয়া গেছে। ১৯৬০ সনের দিকে তাঁর সংগৃহীত পার্কার কলম সেটটি বিশ্বে এখন ম‚ল্যবান হ্যারিটেজ হিসেব দুর্লব দ্রব্য সামগ্রীর তালিকায় রয়েছে। তাঁর ব্যবহৃত গ্রামোফোন টিও এ-যুগে ম‚ল্যবান হ্যারিটেজ। তাঁর মাছ ধরার প্রতি শখ থাকার কারণে তিনি বি. রেলওয়ে ফিসিং এ্যাংলিং এন্ড সুটিং ক্লাবেরও সদস্য ছিলেন। উনাদের মাছ ধরার একটা গ্রæপ ছিল, ব্যারিস্টার সলিমুল হক খান মিল্কী, এডভোকেট সুনিতী হাজারী, এডভোকেট মুজিবুর রহমান, ব্যারিস্টার সাইফুদ্দীন মাহমুদ, এডভোকেট শামসুদ্দীন মির্জা সবাই মিলে একযোগে দল বেধেঁ মাছ শিকারে যেতেন। শুধুমাত্র মাছ শিকারের খাদ্য সামগ্রী তৈরীর জন্য বাসার ছাদে বড় একটা রুম তৈরী করেন। এখনও মাছ শিকারের সরঞ্জামাদি সব আগের মত যতœ সহকারে রয়ে গিয়েছে। বরশীর দেশি-বিদেশি ছীপ সংগ্রহ ও মাছ ধরা তাঁর আরেকটি সখ ছিল। তিনি ইউরোপ সফর শেষে দেশে ফিরবার সময় জার্মান থেকে কেনা সখের ফিয়েট প্রাইভেট কারটি জাহাজে করে দেশে পাঠিয়ে দেন। ১৯৯৫ সালে আমার বিয়ের সময়ও তাঁকে এ গাড়ীটি ব্যবহার করতে দেখেছি।
১৯৯৮ সালে তিনি পবিত্র হজ্বব্রত পালন করেন। সফর পিপাসু মানুষটি ইংল্যান্ড, বেলজিয়াম, হল্যান্ড, ইটালী, লুক্সেমবার্গ, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, সৌদি আরব, বার্মা(মায়ানমার) সহ পৃথিবীর বহু দেশ সফর করেন। ব্যারিস্টার সাইফুদ্দিন মাহমুদ স্যার বলেন, তিনি আমাদের সিনিয়র ছিলেন। লন্ডনে তিনি আমাদের প্রায়শই দাওয়াত খাওয়াতেন। দেশ থেকে শিক্ষার জন্য কেউ লন্ডন গেলে তাদের নানাভাবে সাহায্য সহযোগীতা করতেন। তিনি অত্যন্ত সময়ানুবর্তীতা রক্ষা করতেন। ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত, ব্যারিস্টার মওদুদ, ব্যারিস্টার জমিরুদ্দীন সরকার প্রমুখ এর সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল। কিন্তু তিনি সে সম্পর্ক কনটিনিও করেন নি। স্বাধীন চেতা মানুষটি কখনো তোষামোদীর রাজনীতি পছন্দ করতেন না। তাই মন্ত্রী, এম পি কিংবা এম্বাসেডর এর অফার তিনি বিনয়ের সাথে প্রত্যাখান করেন। নিরহংকারী মানুষটি নামের আগে কখনো ব্যারিস্টার, আলহাজ¦ কিংবা লায়ন ইত্যাদী লিখেন নি। অথচ তিনি লায়ন্স এর দীর্ঘদিন সিটি প্রেসিডেন্ট এর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি যখন ব্যারিস্টারী পাশ করেন তখন হাতে গোনা কয়েকজন ব্যারিস্টার ছিলেন। এলাকাবাসী তাঁকে তখন বিপুল ভাবে সংবর্ধিত করেন। মুরুব্বীদের থেকে শুনেছি ছোট বেলা থেকেই তিনি নানা জাতের ফলগাছ লাগাতেন।তার হাতে লাগানো গাছে বেশ ধরতো। আম, লিচু, কাঠাল, কলা, শরীফা, বড়ই, সফেদা, নারিকেল, বেলুম্বো, পেয়ারা প্রভৃতি গাছ লাগাতেন এর ফল প্রতিবেশিদের বিলাতেন। তিনি নিজ এলাকায় প্রতিবাদী কন্ঠ পরিচালিত ব্যারিস্টার আমিনুল হক গণ পাঠাগারের জন্য জমি ও অর্থ দান করেছিলেন। ভাড়াটিয়াদের বাচ্চাদের জন্য খেলার উঠোন ও নিরাপদ বেস্টনির কারনে দীর্ঘদিন তারা সেখানে বসবাস করতেন। অনেক নামী দামী ব্যাক্তি তাঁর ভাড়াটিয়া ছিলেন। অনেকে নিজের বাসা বাড়ী হওয়ার পর ভাড়া বাসা ছাড়তেন। তৎকালীন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মরহুম আলহাজ্ব হাফিজুর রহমান তাঁর পিতা এবং মরহুমা আলমাছ খাতুন তাঁর মাতা। তাঁর পিতা মরহুম হাফিজুর রহমান বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, জমিদার, দানবীর ও ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি তদানিন্তন সময়ে চাক্তাই এর ন্যাশনাল ষ্টোর ও সুপরিচিত বাগদাদ রাইস, ফ্লাওয়ার এন্ড অয়েল মিলস্ এর স্বত্বাধিকারী ছিলেন। এছাড়া তিনি তদানিন্তন বার্মার (মায়ানমার) রেংগুনে ব্যবসা করতেন। ব্যারিস্টার হক লালখান বাজারের স্থায়ী বাসিন্দা। পটিয়া বিনিনিহারা আমার দাদা শ্বশুর প্রখ্যাত জমিদার ও ব্যবসায়ী মরহুম হাজী হাফিজুর রহমানের গ্রামের দ্বীতল সুন্দর বাড়ীটি ১৯৬৪ সানে নির্মিত হয়। পাড়াটি দেখে মনে হলো এক সময় তারা ব্যাবস্যা বানিজ্য ও শিক্ষাদীক্ষায় চট্টগ্রামের নেতৃত্ব দিত।
চাক্তাই খাতুনগঞ্জের ব্যাবসা ছিল আমার দাদা শ্বশুর মরহুম হাজী হাফেজুর রহমান এর ৪ ভাইয়ের নিয়ন্ত্রণে। চট্টগ্রাম কলেজের সাবেক প্রিন্সিপ্যাল মরহুম আব্দুস সবুর তাঁর কাজিন হয়। আমার দাদা শ্বশুরের ৩ পুত্র ও ২ কন্যা সন্তানের মধ্যে আমার শ্বশুর আব্বা ব্যারিষ্টার আমিনুল হক ২য় সন্তান। ব্যবসা বাণিজ্যে তাদের বহু পুরোনো ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে। এক সময় কলকাতায় এবং বার্মার (বর্তমানে মায়ানমারে) আকিয়াবে তাদের পারিবারিক ব্যবসা ছিল। আমার শ্বাশুড়ী আম্মা থেকে শুনেছি তাদের দোকানে স্বর্ণ থেকে শুরু করে ফুলের ঝাড়– পর্যন্ত সব পাওয়া যেত। যা আধুনিক ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোতেও পাওয়া যায় না। আমার দাদা শ্বশুর হাজী হাফেজুর রহমান হিজবুল বাহার নামক জাহাজে পবিত্র হজ্বব্রত পালন করেন। তাঁর অপর ৩ ভাই যথাক্রমে হাজী আলী আব্বাস, হাজী ওছিয়র রহমান, হাজী আনিসুর রহমান প্রমুখের যৌথ পরিবার এর ব্যবসায়িক সাফল্য এখনও মানুষের মুখে মুখে। চাক্তাই খাতুন গঞ্জের বেশিরভাগ দোকান তাদের ছিল। তদানিন্তন সময়ে তাদের ৪ ভাইয়ের ৪টি প্রাইভেট কার ছিল। ১৬টি পাল তোলা মালবাহী জাহাজ ছিল (জালী বোট নামে পরিচিত)। ব্যারিস্টার সাহেবদের উত্তরাধিকারী সূত্রে প্রাপ্ত চাক্তাই এর পুরানো ঐতিহ্যবাহী বিল্ডিং ‘না-খোন্দা’ বিল্ডিংটি তাঁর বাবারা ৪ ভাই মারোয়ারীদের থেকে কিনে নিয়েছিলেন। তাঁর বড় ভাই মরহুম আব্দুর রশিদ (প্রকাশ কালু সওদাগর) মেহেদীবাগ সিডিএ মসজিদের পাশে পাখিওয়ালা বিল্ডিং এর মালিক ছিলেন। তিনি নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান। কিছুদিন আগে তাঁর ছোট ভাই হাজী নুরুল আমিন মারা যান এখন সবার ছোট ১ বোন শাহজাহান বেগম বেঁচে আছেন। বর্তমানে তাদের জমিদারী ও ব্যবসা পৃথক হয়ে গেছে। তিনি আইন পেশার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম আইন কলেজেও শিক্ষকতা করেন। তিনি এক পুত্র ও চার কন্যা সন্তানের জনক। স্ত্রী মিসেস আলহাজ্ব মালেকা পারভীন গণ ২০১৭ সালের ১৪ই ফেব্রæয়ারি আকষ্মিকভাবে মৃত্যু বরণ করেন। তিনি কোতোয়ালী থানাধীন পাথরঘাটা এলাকার প্রখ্যাত জমিদার তদানিন্তন ২২ মহল্লা সরদার ও বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা সূফী আলহাজ্ব আব্দুস সোবাহান সওদাগরের কনিষ্টা কন্যা আলহাজ্ব গুলশান আরা বেগম এর কন্যা। ব্যারিষ্টার আমিনুল হক এর শ্বশুর আনোয়ারা উপজেলার সরেঙ্গা গ্রামের আলহাজ্ব সৈয়দ আহমদ চৌধুরী বি.এল (ব্যাচলর অব ল) একজন নামজাদা ব্যবসায়ী, দানশীল ও ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি পাথরগাটা মহিমদাশ লেনের স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন। ব্যারিষ্টার আমিনুল হক ও মিসেস আমিনুল হক দম্পতির চার কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে আশফা খানম হেলেন এম.এস.সি (রসায়ন), বর্তমানে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল (ন্যাশনাল ক্যারিকুলাম) চিটাগাং ভিক্টোরী ন্যাশনাল স্কুল-সিভিএনএস এর প্রতিষ্ঠাতা ও অধ্যক্ষ। ২য় কন্যা ফাহমিদা খানম মুনমুন অর্থনীতিতে মাষ্টার্স ডিগ্রিধারী ও নগরের একটি ইংরেজী মিডিয়াম স্কুলের টিচার। তার স্বামী ওয়াসিফ শান্তনু রশিদ মুক্তি মরহুম এম এ আজীজ এর ছোট ভাই মরহুম এম এ মজিদের ছোট ছেলে। ৩য় কন্যা তাহমীনা খানম মুনা বি.এস.এস অনার্স (সমাজতন্ত্র)। তাঁর স্বামী হামদান কাশেম চৌধুরী একজন হিউম্যান ট্রেইনার ও লীড ইনস্টিটিউশনের পরিচালক। ৪র্থ কন্যা ডাঃ আসমা খানম এম.বি.বি.এস বর্তমানে লায়ন্স চক্ষু হাসপাতালে কর্মরত মেডিকেল অফিসার। তাঁর স্বামী কফিল উদ্দিন আহম্মদ (জুয়েল) গ্রামীন ফোনে কর্মরত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। মরহুম আমিনুল হক সাহেবের একমাত্র পুত্র তানভীরুল হক ঢাকাস্থ নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সাইয়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এ গ্রেজুয়েশন করেন এবং বর্তমানে একজন সফল ব্যবসায়ী। মরহুম নাতি নাতনীদের অত্যন্ত স্নেহ করেন। পকেটে সব সময় ছোটদের জন্য চকলেট কিনে রাখেন। পরীক্ষায় ভালো ফল করলে তিনি আমাদের সন্তানদের পুরস্কৃত করতেন। তাঁর খুব ইচ্ছে তাঁর নাতি নাতনিরা জীবনে আদর্শ মানুষ হোক। তিনি অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন।
কবি নজরুলের হামদ নাত তাঁর খুবই প্রিয় ছিল। তিনি নিয়মিত নামাজ রোজা আদায় করতেন এবং প্রতিদিন কোরান তেলাওয়াত ও অজিফা পড়তেন। তিনি ভালো খেতেন তবে স্বল্প আহারী ছিলেন। তিনি ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম জেলা বার সমিতির প্রবীণতম জীবিত সদস্য ছিলেন। শ্বশুর আব্বাকে নিয়ে লিখতে গেলে চোখের পানি ধরে রাখা যায় না। কোর্টে মাঝে মাঝে আমাদের চেম্বারে আসতেন। কখনো আমার চেয়ারে বসাতে পারিনি। লোকজনের ভিড় দেখলে আমার অজান্তেই বাইর থেকে উঁকি মেরে দেখে চলে যেতেন। তিনি ৫০ বছরেরও বেশি সিনিয়র এডভোকেট বার এসোসিয়েশন সদস্য হিসেবে সম্মাননা পেয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে বার ভবনে শোকবার্তা সম্বলিত ব্যানার টাংগানো হয়। তাঁর স্মরণে ফুল কোর্ট রেভারেন্স হবে। কিন্তু তিনি আর কখনো বার লাইব্রেরী বা বার কেন্টিনে বন্ধুদের নিয়ে চা খেতে, গল্প করে সময় কাটাতে আসবেন না। এমন স্নেহময় বৃক্ষছায়ায় ভালোবাসার মানুষটি আমাদের মাঝ থেকে চির বিদায় নিলেন। কবির ভাষায়, এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ, মরনে তাহাই তিনি করে গেলেন দান। বয়োবৃদ্ধ বটবৃক্ষ সমতুল্য এই পরম অভিভাবক ও মুরুব্বীকে হারিয়েছি আমরা। তিনি সবসময় আমাকে চেম্বারে দেখে যেতেন এবং দোয়া দিয়ে যেতেন। তাঁর ¯েœহের কখনো ঋণ শোধ শোধ হওয়ার নয়। আল্লাহ্ পাক রহমান রহিম তাঁকে মেহেরবানি করে জান্নাতুল ফেরদৌসের চিরস্থায়ী বাসিন্দা করে দিন আমিন।

লেখক : আইনবিদ, কলামিস্ট,
সুশাসন ও মানবাধিকারকর্মী