স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সচেতন হউন

31

মো. আবদুর রহিম

স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। অর্থ সম্পদ, বিত্ত-বৈভব সবই আছে। ঘরে-অফিসে-গাড়িতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ আছে। খাদ্যের তালিকায় সবই আছে, দেশ-বিদেশি ভ্রমণ, আনন্দ, ফুর্তি করার যোগ্যতা আছে, সক্ষমতা আছে। শুধু নেই সুস্থতা- তাহলে আপনি আমি কি সুখি। অসুস্থ মানুষের সুখ-শান্তি, আরাম আয়েশ কিছুই নেই। আছে অশান্তি, দুঃখ, যন্ত্রণা, ভোগান্তি আর দুশ্চিন্তা। ফলে অর্থ-বিত্ত-সম্পদ সবই অসাড়। জীবনটা যখন দুঃসহ যন্ত্রণার হয়, যখন মানুষ অশান্তিতে থাকে, তখন তাঁর নিকট দুনিয়াটা একটা বোঝা- বেঁচে থাকার কোন মোহ তার থাকে না। সে কারণে সুস্থতার জন্য, সুস্বাস্থ্যের জন্য, রোগ ব্যাধি থেকে মুক্ত থাকার জন্য, একটু শান্তির জন্য মানুষ দেশ-বিদেশে চিকিৎসা নেয়। গরিব-নিঃস্ব হলেও ধার কর্জ করে, পরের সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করে সুস্থ হতে চায়, জীবন বাঁচাতে চায়, রোগ থেকে মুক্তি চায়। যন্ত্রণা রোগ ব্যাধি থেকে কে না বাঁচতে চায়? মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্যতম হলো স্বাস্থ্য। প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ৭ এপ্রিল ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস’ পালন করা হয়। ১৯৪৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রথম এই দিবসটি পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৯৫০ সাল থেকে এটি কার্যকর হয়। বাংলাদেশ সহ বিশ্ববাসী সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে দিবসটি এবার পালিত হয়েছে। ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক ১১টি অফিসিয়াল বৈশ্বিক স্বাস্থ্য বিষয়ক ক্যাম্পেইনের অন্যতম। অন্যান্য ক্যাম্পেইন সমূহ হচ্ছে বিশ্ব যক্ষা দিবস, বিশ্ব টিকা দিবস, বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস, বিশ্ব তামাক দিবস, বিশ্ব এইডস দিবস, বিশ্ব রক্তদাতা দিবস, বিশ্ব নিরাপদ রোগী দিবস, বিশ্ব জীবাণুমুক্ত সচেতনতা সপ্তাহ, বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস। এ সকল দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে সাধারণ মানুষের মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা। এবারের বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য হলো, ‘প্রত্যেকের জন্য স্বাস্থ্যময় বিশ্ব, দুর্নীতিমুক্ত স্বাস্থ্য’।
সর্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়েই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এ কার্যক্রম। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্যভুক্ত হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দিবসটি পালন করে আসছে। বিশ্বের সাথে একটি সুন্দর ও স্বাস্থ্যবান বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয় থাকে প্রতিবছরই। একটি সুস্থ সুন্দর পৃথিবী গড়ার অনিবার্যতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল বৈশ্বিক অতিমারি কোভিড-১৯। এই ভাইরাসের কবলে পড়ে বিশ্বের অনেক দেশের মানুষ দারিদ্র্যের কষাঘাতে নিপতিত হয়েছে, নিরাপদ খাদ্যের প্রচন্ড অভাব সামাজিক এবং স্বাস্থ্যগত ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। উন্নত স্বাস্থ্যের ভাগীদার হওয়া প্রত্যেক নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার এবং সেটা ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে এমনকি সেটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিবেচনায় নয়। সে হিসেবে মানব স্বাস্থ্যের সুস্থতার পূর্বশত সুন্দর ও স্বাস্থ্যবান পৃথিবী গড়ার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে দ্বিমতের সুযোগ নেই। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের প্রেক্ষাপটে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বৈশি^ক স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রে বৈশি^ক উষ্ণায়ন, সংঘাতময় অঞ্চল এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবার প্রধান বাধা সহ ১০টি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশ্বনেতারা প্রয়োজনীয় তহবিল বরাদ্দে ব্যর্থ হচ্ছেন। সুস্থ সুন্দর মানব অস্তিত্বের জন্য দূষণমুক্ত পরিবেশ এবং সুস্থ সুন্দর পৃথিবীর বিকল্প নেই। একই সঙ্গে পর্যাপ্ত চিকিৎসা বা স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করাও আবশ্যক। সচেতনতা সুস্থ থাকার মৌলিক উপকরণ। মানসম্মত নিরাপদ খাদ্য ও সুপেয় পানি নিশ্চিত করা এবং বায়ু-মাটি-শব্দদূষণ প্রতিরোধ ও এসব বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করার বলিষ্ঠ পদক্ষেপ থাকা খুবই জরুরি। বাস্তবতা হচ্ছে মানুষের সীমাহীন অবিবেচক উদাসীনতা ভোগবাদী তৎপরতার কারণে চরম হুমকিতে পড়েছে প্রাণ-প্রকৃতি। মানুষ নির্বিচারে পরিবেশ দূষণ করে চলেছে-ফলে বৈরী হয়ে উঠেছে-আবহাওয়া। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের জীবনে হানা দিচ্ছে।
জীবন সংহারের পাশাপাশি জীবিকা চরম হুমকির মুখে। বিজ্ঞানীদের মতে পরিবেশ দূষণের অনিবার্য পরিণামে পৃথিবী অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তারই একটি হলো বৈশ্বিক অতিমারী কোভিড-১৯। এছাড়াও নানা মারাত্মক সংক্রামক রোগ-ব্যাধি মানবজীবনে হানা দিচ্ছে। বর্তমানে করোনা ভাইরাস সমগ্র মানবজাতির ঘুম হারাম করে দিয়েছে। চরম হুমকিতে ফেলে দিয়েছে জীবন-জীবিকা। প্রাণ প্রকৃতির প্রতি মানুষের নিষ্ঠুর আচরণ ও তৎপরতা না থামলে আগামীতে আরো ভয়ংকর রোগ ব্যাধি হানা দিতে পারে। পৃথিবীতে নেমে আসতে পারে আরো বহুমাত্রিক মহাদুর্যোগ। আমাদের অস্তিত্বের স্বার্থে পরিবেশ দূষণরোধ ও প্রাণ-প্রকৃতির প্রতি সবধরনের অবিচার, অপতৎপরতা বন্ধ করে একটি সুন্দর স্বাস্থ্যবান পৃথিবী গড়ার প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশ বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদার স্বীকৃতি অর্জন করলেও এদেশকে আরো অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হবে। ধ্বংসস্তূপ থেকে ধীরে ধীরে বাংলাদেশ সামনে এগোচ্ছে সত্যি, তবে পেছনে আছে-রোগ-ব্যাধি, দুর্যোগ-দুর্বিপাক, প্রতিক্রিয়াশীলদের ষড়যন্ত্র। এদেশের অধিকাংশ মানুষ সৃজনশীল, মানবতাবাদী, ধর্মভীরু ও সহনশীল। এর বাহিরে আছে কিছু অমানুষ, দেশপ্রেম বিবর্জিত, অসহিষ্ণু ও ষড়যন্ত্রকারী। যারা এদেশটিকে সামনে এগোতে দিতে নারাজ। তারা বিকৃত মন-মানসিকতা ধারণ করে স্বদেশ, স্বজাতি ও নিজের প্রতি বৈরি আচরণ করে থাকে। তাদের মন-মানসিকতায় ধ্বংস, নৈরাজ্য ও হিংসা। সে কারণে সামনে এগোতে বহু বাধা বিপত্তির মুখোমুখি স্বাধীন বাংলাদেশ। বৈশি^ক মহামারি সত্তে¡ও বাংলাদেশ ২০২১ সালে শুভ সংবাদ নিয়ে সামনে চলছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এই বছর বাড়তে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। ৬ এপ্রিল ২০২১ মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে আইএমএফের সদর দপ্তর থেকে প্রকাশিত বৈশ্বিক অর্থনীতি পূর্বাভাস শীর্ষক রিপোর্টে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশে ২০২১ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে পাঁচ শতাংশ। এর আগে বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি বাড়বে বলে জানিয়ে ছিলো বিশ্বব্যাংক। করোনার মহামারী নিয়ন্ত্রণে আনার প্রাণান্ত প্রয়াসে বাংলাদেশ সরকার। এর অংশ হিসেবে বিশ্বের সাথে বাংলাদেশেও চলছে টিকা প্রয়োগ কার্যক্রম।
২০২১ সালে ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে চলছে গণহারে টিকা প্রয়োগ কার্যক্রম। বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে টিকা। ৮ এপ্রিল ২০২১ থেকে শুরু হয়েছে দ্বিতীয় ডোজ টিকা প্রয়োগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ‘সংক্রমণ ছড়ানোকে বাধাগ্রস্ত করতে হলে কমপক্ষে ৭০ শতাংশ মানুষের টিকা দিতে হবে।’ এ কাজটি দ্রুত সম্পন্ন করতে শেখ হাসিনার সরকার সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিয়ে সঠিক পথে হাটছে। মৃত্যু ও সংক্রমণ দ্রুত বেড়ে যাওয়ায় শংকা আরো বেড়ে গেল। দেশের স্বাস্থ্যখাত করোনাভাইরাস মোকাবেলা ও প্রতিকারে চরমভাবে হিমশিম খাচ্ছে ভয়াবহ সংকটে করোনা চিকিৎসা। গত ২০২০ সালে ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগ শনাক্ত হওয়ার পর থেকে বাড়তে থাকে সংক্রমণ। জুন-জুলাইতে সংক্রমণ গতি ছিল ঊর্ধ্বমুখী। জুলাইতে সর্বোচ্চ ৬৪ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। কিন্তু এই রেকর্ড ভেঙে ৬ মার্চ ২০২১ এ দেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে ৬৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর সংক্রমণে প্রতিদিনই তৈরি হচ্ছে রেকর্ড। ৬ মার্চ ২০২১ আক্রান্ত হয়েছে ৭ হাজার ২১৩ জন। এই বিপুল সংখ্যক রোগীর চিকিৎসা দিতে দেশের হাসপাতালগুলোতে তৈরি হচ্ছে ভয়াবহ সংকট। আক্রান্ত হওয়ার তিন দিন পার না হতেই অনেক রোগীর শারীরিক জটিলতা তৈরি হচ্ছে। ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ফুসফুস। শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছে। প্রয়োজন হচ্ছে হাইফ্লোঅক্সিজেন ও আইসিইউ। এ ক্ষেত্রে রয়েছে শয্যাসংকট। এ থেকে পরিত্রাণে প্রয়োজন সতর্কতা, সচেতনতা ও শারীরিক দূরত্ব সহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা।
সরকার ভয়ায়বহ এ সংকট থেকে দেশবাসীকে সুরক্ষ দিতে, নিয়ন্ত্রন করতে সংক্রমণ কমাতে নানামুখি বিধি-নিষেধ ও নির্দেশনা জারি করার পরও সাধারণ নাগরিক বিধি-নিষেধ মানার ক্ষেত্রে অনেকটাই উদাসীন। মানুষ অবাধে চলাফেরা করতে অভ্যস্থ মাস্ক পরা, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রেও উদাসীন। হাত ধোয়ার ক্ষেত্রে রয়েছে চরম অবহেলা। মাস্ক হাতে পকেটে বা থুতনিতে লাগিয়ে পথ চলছে। নেই কোন শংকা, নেই আতংক কেবলই অবহেলা, উদাসীনতা ও অসচেতনতা। ফলে সংক্রমন বেড়েই চলছে। এমতাবস্থায় সরকার কঠোর হলেও মানুষদের মাঝে চেতনার অভাবই থেকে যাচ্ছে। মানুষ যদি মানুষের মত মানুষ না হয়, যদি মানুষ অচেতন থাকে-তাকে সচেতন করতে আইনের কঠোর প্রয়োগ অনিবার্য হয়ে যায়। মানুষ যদি সভ্য না হয়ে অসভ্য হয়ে যায়, তাকে সভ্য করতে আইনের কঠোর প্রয়োগ অনিবার্য।
মানুষ যদি ধ্বংস ও নৈরাজ্যের পথে হাঁটে তাকে সৃজনশীল ও ধৈর্য্যশীল করার জন্য আইনের কঠোর প্রয়োগ প্রয়োজন। সুতরাং মানুষের জীবন বাঁচাতে, মানুষের জীবন-জীবিকা সচল রাখতে, স্বাভাবিক জীবন ধারন স্বার্থে করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের বিকল্প কোন পথ নেই। তাই-সজাগ, সচেতন ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা প্রতিটি নরনারীর জন্য ফরজ। আল্লাহ সান্নিধ্য, নৈকট্য লাভের জন্য যেমন ফরম ইবাদত। ঠিক তেমনি মানুষ মানুষের জন্য জীবন বাঁচাতে ফরজ হলো স্বাস্থ্যবিধি। আপনি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন, নিজে সচেতন হোন, অপরকে সচেতন হতে সহায়তা দিন, নিজে বাঁচুন-অপরকে বাঁচতে দিন-অন্যথায় ভয়াবহ সংকট থেকে রক্ষার কোন পথ ও উপায় খোলা থাকবে না।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চারনেতা স্মৃতি পরিষদ