স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অবৈধ পদোন্নতির হিড়িক

175

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে নন-মেডিকেল কর্মচারী ও স্বাস্থ্য সহকারীদের অবৈধভাবে পদোন্নতি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে তদন্তও করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, বিধি ও নিয়ম মেনেই পদোন্নতি হয়েছে।
১৯৮৫ ও ২০১৮ সালের স্বাস্থ্য বিভাগীয় নন-মেডিকেল কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালা অনুযায়ী স্বাস্থ্য সহকারী পদ থেকে পদোন্নতি পেয়ে পরিসংখ্যানবিদ, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর, উচ্চমান সহকারী ও হিসাবরক্ষক হওয়ার সুযোগ নেই। স্বাস্থ্য সহকারী থেকে শুধু সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক, সিনিয়র স্বাস্থ্য পরিদর্শক, এমটি ইপিআই হওয়া যায়। কিন্তু স্বাস্থ্য সহকারী থেকে অনেকেই নিয়ম বহিভর্‚তভাবে পদোন্নতি নিয়েছেন। জানাজানির পর তদন্তও করেছে অধিদপ্তর। তারপরও ফাঁকফোঁকর দিয়ে পদোন্নতি হয়েছে ঠিকই।
২০১৩ সালের আগস্টে পটুয়াখালী সিভিল সার্জন অফিসের প্রধান সহকারী নজরুল ইসলাম কীভাবে স্বাস্থ্য সহকারী থেকে কেশিয়ার ও পরে প্রধান সহকারী হয়েছেন তা তদন্ত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তার পদোন্নতি বাতিল করে মূলপদ স্বাস্থ্য সহকারী পদে রাখার আদেশ দেওয়া হয়। এমনকি তার পদোন্নতির জন্য যদি সরকারের কোনও আর্থিক ক্ষতি হয়ে থাকে তা সিভিল সার্জনকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ইস্যুকৃত আদেশে আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়।
এমন আরও অনেকেই জালিয়াতি করে পদোন্নতি ও পদায়ন নিয়েছেন। তারা অবৈধভাবে বেতন বৃদ্ধির চাপও দিয়ছেন। এ বিষয়ে হিসাব নিয়ন্ত্রকের অফিস থেকে ২০১১ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে চিঠিও দেওয়া হয়। পরে অধিদপ্তরের তৎকালীন পরিচালক (অর্থ) ডা. মো. সাইদুর রহমান ভ‚ঁইয়া তার প্রশাসনকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চিঠি দেন।
অবৈধ পদোন্নতি পেলেন যারা:
অবৈধভাবে পদোন্নতি নেওয়া এসব ব্যক্তিদের একটি তালিকা ধরে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, সাইদুর রহমান নামের এক স্বাস্থ্য সহকারীকে হিসাবরক্ষক পদে পদোন্নতি দিয়ে পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০২০ সালের ১১ নভেম্বর পদায়ন করা হয়েছে। একইভাবে আব্দুল কুদ্দুস নামের এক স্বাস্থ্য সহকারীকে জালিয়াতি করে হিসাবরক্ষক পদে পদোন্নতি করা হয়েছে। ২০২১ সালের ২৫ জানুয়ারি তাকে পুনরায় প্রধান সহকারী পদে পিরোজপুর সিভিল সার্জনে বদলি করা হয়।
একই আদেশে স্টোর কিপার আক্তারুজ্জামানকে হিসাবরক্ষক করা হয়। নিয়ম থাকলেও তাদের পদোন্নতিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগের পরিচালকের কোনও মতামত নেওয়া হয়নি।
২০২১ সালের ৫ মে পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ওয়ার্ড বয়কে হিসাবরক্ষক, ভাÐারিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের হিসাবরক্ষক আল আমিনকে প্রধান সহকারী, বরগুনার আমতলীর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের হিসাবরক্ষক শহিদুল ইসলাম মন্টুকে প্রধান সহকারী, পটুয়াখালীর দশমিনা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অফিস সহকারী আশরাফুলকে হিসাবরক্ষক, বরিশালের বিভাগীয় পরিচালক ভাÐারিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে লতিফা আক্তারকে অফিস সহকারী পদে গত ১৮ মে পদায়ন করা হয়। কিন্তু ঢাকার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় বরিশাল পরিচালকের আদেশটি বাতিল করে। পরে জান্নাতুল ফেরদৌস নামের অপর এক নারীকে ওই পদে পদায়ন করা হয়।
এসব পদোন্নতিতেও বরিশাল বিভাগীয় পরিচালকের মতামত নেওয়া হয়নি। অথচ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বদলি, পেনশন ও পদোন্নতি বিধি অনুযায়ী বিভাগীয় পরিচালক সম্পন্ন করার কথা। স্থানীয় প্রশাসনকে না জানিয়ে অবৈধভাবে প্রধান কার্যালয় থেকে এগুলো করা হয়েছে।
এরশাদের হাতে যত কলকাঠি :
এসব অবৈধ পদোন্নতির সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রশাসন বিভাগের একটি চক্র জড়িত বলে জানা গেছে। অভিযোগ রয়েছে, অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. শেখ মো. হাসান ইমামের ব্যক্তিগত অফিস সহকারী আহসান সাইদ এরশাদ এসব পদোন্নতিতে ‘সহায়তা’ করেন। এই কর্মচারী নিজেও ছিলেন স্বাস্থ্য সহকারী। অবৈধভাবে পদোন্নতি নিয়ে হয়েছেন ব্যক্তিগত অফিস সহকারী।
এরশাদের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, দুর্নীতি দমন কমিশন ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। অবৈধ পদোন্নতি, বদলি এবং ভুয়া ভাউচার দিয়ে বিল আদায় এমনকি গর্ভবতী মায়েদের চিকিৎসা ভাতা আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
২০০৪ সালের জুলাইয়ে এরশাদ স্বাস্থ্য সহকারী হিসেবে গলাচিপা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগ দেন। ২০০৮ সালে বেতন আগের পদের থাকবে এমন শর্তে পরিসংখ্যানবিদ হিসেবে পদোন্নতি নেন। একইভাবে ২০১৪ সালে অফিস সহকারী হিসেবে পদোন্নতি নেন। পরে হন উচ্চমান সহকারী। ২০২০ সালে পুনরায় পদোন্নতি নিয়ে হিসাবরক্ষক বনে যান। এরপর ২০২০ সালের অক্টোবরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. শেখ মো. হাসান ইমামের ব্যক্তিগত অফিস সহকারী হিসেবে প্রেষণে আসেন এরশাদ। অভিযোগ রয়েছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সদর দপ্তরে এসে নিজেই এখন বাকিদের অবৈধ পদোন্নতির বন্দোবস্ত করে দিচ্ছেন।
দুর্নীতি দমন কমিশনে করা এক অভিযোগে দেখা গেছে, এরশাদ এসব পদোন্নতির বিনিময়ে তিন থেকে চার লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে থাকেন। পরিচালকের (প্রশাসন) ব্যক্তিগত সহকারী হওয়াতে সারাদেশে তার শক্ত সিন্ডিকেট আছে।
এ প্রসঙ্গে ডা. শেখ মো. হাসান ইমামের ব্যক্তিগত অফিস সহকারী আহসান সাইদ এরশাদ বলেন, ‘আমার কোনও সিন্ডিকেট নেই। আমি নিজে এখানে এসেছি কয়েকমাস হলো। আমাকে নিয়োগ বোর্ড পদোন্নতি দিয়েছে। আমি একা নই। সারাদেশে এমন অন্তত দুই হাজার কর্মচারী রয়েছে, যারা আগের বেতনের শর্তে পদোন্নতি পেয়েছেন।’
কী প্রক্রিয়ায় এসব পদোন্নতি দেওয়া হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে জনবলের সঙ্কট ছিল, তখন এসব পদোন্নতি হয়েছে। যারা পদোন্নতি দেয় তারা জানে, আমি জানি না।’
কেউ অবসরে, কেউ বহাল :
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাওয়া নথিতে দেখা গেছে, অবৈধ পদোন্নতি পাওয়া অনেকে এরমধ্যে অবসরে গেছেন। অনেকে বিভিন্ন হাসপাতাল ও দপ্তরে কর্মরত। এদের মধ্যে কেমলী ২৫০ শয্যা বক্ষব্যাধি হাসপাতালের হিসাবরক্ষক রেজাউল করিম স্বাস্থ্য সহকারী থেকে হিসাবরক্ষক পদে আছেন। বরগুনার আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের হিসাবরক্ষক শহিদুল ইসলাম জুনিয়র মেকানিক থেকে পদোন্নতি নিয়েছেন। ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতালের প্রধান সহকারী মাতুব্বর আবুল কালাম আজাদ স্বাস্থ্য সহকারী থেকে পদোন্নতি নিয়েছেন। এসব পদোন্নতি অবৈধ হলেও তারা এখনও পদে বহাল।
অবৈধভাবে স্বাস্থ্য সহকারী থেকে পটুয়াখালী সিভিল সার্জন অফিসের মহসিন হিসাবরক্ষক হয়েছেন। পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজের হিসাবরক্ষক সাইদুর রহমান স্বাস্থ্য সহকারী থেকে পদোন্নতি পেয়েছেন। একই প্রতিষ্ঠানের নজরুল ইসলাম হয়েছেন প্রশাসনিক কর্মকর্তা। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
২০১৩ সালের ৫ মে ও ২২ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে দেশের সকল বিভাগীয় পরিচালকদের স্বাস্থ্য সহকারী বা অন্য কোনও মাঠকর্মীকে ১৯৮৫ সালের নিয়োগবিধি বহিভর্‚তভাবে অফিস সহকারী, কেশিয়ার, হিসাবরক্ষক, স্টোরকিপার পদে পদোন্নতি না দেওয়ার জন্য কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়। তারপরও এদের পদোন্নতি ঠেকানো যায়নি।
এসব পদোন্নতির নথি, আদেশ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সবাই আগের বেতনের শর্তে পদোন্নতি নিয়েছেন। পদোন্নতির পর তারা প্রেষণে বিভিন্ন লোভনীয় দপ্তরে তদবির করে যোগ দেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা বলেন, ‘নিয়োগ বিধি মেনেই সকল পদোন্নতি ও পদায়ন হয়। এর ব্যত্যয় হওয়ার কথা নয়।’