স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি বায়ুদূষণ

15

নিজস্ব প্রতিবেদক

৬০ বর্গমাইলের চট্টগ্রাম মহানগর এখন ধূলোর শহর। অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনা ও পরিবেশ সুরক্ষায় তদারকির অভাবে এমনটি হয়েছে। সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতায়ও পরিবেশের বারোটা বাজছে বলে মন্তব্য করেছেন পরিবেশ আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্তরা। ওয়াসার পানির পাইপ লাইন স্থাপনের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি, ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বঙ্গবন্ধু টানেল, বে-টার্মিনাল ও আউটার রিং রোড কাম বেড়িবাঁধ নির্মাণসহ বিভিন্ন প্রকল্পের কারণে রীতিমত ধূলোবালির রাজ্যে পরিণত হয়েছে এই নগর। আবার জেলার যত্রতত্র ইটভাটা নির্মাণ ও নগরীতে নির্বিচারে পাহাড় কাটার কারণেও পরিবেশের নিদারুণ ক্ষতি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে ইটভাটা আধুনিকায়ন করা গেলে বাতাসে ধুলার পরিমাণ ৪৪ মাইক্রোগ্রাম রাখা যেত। বর্তমানে ইটভাটা নির্মাণ ও পরিবেশসম্মত আধুনিকায়ন না করায় বাড়ছে দূষণ। পথচারী সাধারণ নি¤œবিত্তের মানুষ। তারা বেশ ভালভাবেই অনুভব করেন বাতাসে ভাসমান বিষাক্ত ধূলিকণা। রাস্তায় রাস্তায় ভাসমান এই বিষাক্ত ধূলিকণা ঘর বাড়িতে আকছার ঢুকছে। আর ঘরের ভিতরে বইপত্র আসবাব, গৃহস্থালির জিনিষপত্র এমন কি ডাইনিং টেবিলও ধুলোতে ভরে যাচ্ছে। পথেঘাটে চলতে কখনও দেখা যায় কোন কোন এলাকা ধুলোর চাদরে কুয়াশার মত ঢাকা। এতে শ্বাসনিঃশ্বাসে কষ্ট হয়।এ বিষয়ে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন বলেছেন, রাস্তাঘাটে অ্যাজমা, ব্রংকাইটিস, য²াসহ বিভিন্ন মারাত্মক রোগের জীবাণু ভাসছে। সাম্প্রতিককালে চট্টগ্রামে এসব রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। বিশেষ করে গর্ভবতী নারীর শরীরে ধুলোবালির সঙ্গে এসব জীবাণু প্রবেশ করলে তার গর্ভস্থ সন্তান বিকলাঙ্গ ও প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নেওয়ার কথা থাকে। সবচেয়ে বেশি ভোগেন শ্বাসকষ্টের রোগীরা।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খেঁাজ নিয়ে দেখা গেছে, হাসপাতালের তিনটে মেডিসিন ওয়ার্ডে প্রতিদিন যেসব রোগী ভর্তি হয় তাদের মধ্যে ৩০ শতাংশ রোগী ভর্তি হচ্ছে বিষাক্ত ধুলোবালির কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে।
এদিকে জলবায়ুর পরিবর্তন অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। জীবাশ্ম জ্বালানির কারণে বায়ুদূষণে বিশ্বে প্রতিবছর ৭ লাখ অপরিণত নবজাতকের মৃত্যু হয় ও প্রতি মিনিটে মারা যান ১৩ জন। বাংলাদেশে বছরে বায়ুদূষণে প্রতি ১ লাখে ১৪৯ জন (মোট মৃত্যু ২ লাখ ৪০ হাজার) মারা যান। বৃহস্পতিবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের অনুষ্ঠানে অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডবিøউএইচও) প্রতিনিধি বর্ধন জং রানা এসব তথ্য জানান।
বর্ধন জং রানা বলেন, ধারণা করা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অপুষ্টি, ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়া ও হিট স্ট্রোকে ২০৩০ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে বিশ্বে বছরে অতিরিক্ত আড়াই লাখ মানুষ মারা যাবে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘আমরা পৃথিবীর স্বাস্থ্য ভালো রাখছি না। আবহাওয়া, বাতাস, পানি, মাটি নষ্ট হচ্ছে। জীবন নির্ভর করে আবহাওয়ার ওপর। বাংলাদেশে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার মতো রোগ বেড়েছে। যেসব রোগ আগে এখানে ছিল না।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহরে অনেক উন্নয়ন হচ্ছে, বায়ুদূষণ অনেক বেশি। ফলে মানুষের অনেক রকমের অসুখ-বিসুখ হচ্ছে। নগরায়ন এত হচ্ছে যে গাছ থাকছে না। বাংলাদেশ নিজে এত দূষণ করে না। বড় বড় দেশ আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ভারত এরাই সবচেয়ে পরিবেশ দূষণ করে থাকে।’
তথ্যমতে, অধিকাংশ বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণ ঢাকাকেন্দ্রিক হলেও সম্প্রতি প্রথমবারের মতো দেশের ৬৪টি জেলার বায়দূষণ নিয়ে গবেষণা করেছে বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত ৬৪ জেলার জেলা শহরগুলোতে সাত ধরনের ভূমির ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে ৩ হাজার ১৬৩টি স্থানের পিএম ২.৫ মান পর্যবেক্ষণ করে তা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পর্যালোচনা করা হয়েছে। সমীক্ষা অনুযায়ী দেশে সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণের শিকার গাজীপুর জেলা, ঢাকা রয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে। এই গবেষণায় ৬৪টি জেলার যেসব এলাকা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে তার মধ্যে সংবেদনশীল এলাকা ৫৩১টি (১৬ দশমিক ৭৯ শতাংশ), আবাসিক এলাকা ৪৪০টি (১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ), মিশ্র এলাকা ৪০৭টি (১২ দশমিক ৮৭ শতাংশ), বাণিজ্যিক এলাকা ৫৭৫টি (১৮ দশমিক ১৮ শতাংশ), রাস্তার সংযুক্তি এলাকা ৩৫৮টি (১১ দশমিক ৩২ শতাংশ), শিল্প এলাকা ৪৩২টি (১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ) এবং গ্রামীণ এলাকা ৪২০টি (১৩ দশমিক ২৮ শতাংশ)। বাতাসে ধুলোবালির সহনীয় মাত্রা যেখানে ৬৫ মাইক্রোগ্রামের মধ্যে থাকা দরকার সেখানে বর্তমানে চট্টগ্রামে এর পরিমাণ প্রায় ১৮৭ দশমিক ৩০ মাইক্রোগ্রাম রয়েছে। এতটা দূষণ অব্যাহত থাকলে চট্টগ্রামের জনস্বাস্থ্য যে বিপর্যয়কর অবস্থায় পৌঁছবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ৮টি বিভাগীয় শহরগুলোর গড় অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা ২.৫ এর মান ছিল প্রতি ঘনমিটারে ১১৫.০৭ মাইক্রোগ্রাম, যা অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা ২.৫ এর আদর্শ মানের চেয়ে প্রায় ১.৭৭ গুণ বেশি। ক্যপসের গবেষণা থেকে উঠে আসে ৮টি বিভাগীয় শহরের মধ্যে বায়ুদূষণের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ঢাকা (প্রতি ঘনমিটারে ২৫২.৯৩ মাইক্রোগ্রাম) ও তালিকায় সর্বনি¤েœ রয়েছে রাজশাহী শহর (প্রতি ঘনমিটারে ৫৬.৪১ মাইক্রোগ্রাম)। দূষণ অনুযায়ী বিভাগীয় জেলা শহর গুলোর ক্রম হচ্ছে- ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, সিলেট, বরিশাল, রংপুর, খুলনা ও রাজশাহী।
এদিকে ৬৪টি জেলার মধ্যে ১৮টি (২৮.১৩%) জেলায় গড় অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা ২.৫ এর পরিমাণ ছিল প্রতি ঘনমিটারে ১২১ মাইক্রোগ্রাম এর চেয়ে বেশি। একে অতিরিক্ত মানের বায়ুদূষণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সর্বোচ্চ দূষণ গাজীপুর (২৬৩.৫১ মাইক্রোগ্রাম), দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ঢাকা (২৫২.৯৩ মাইক্রোগ্রাম), তৃতীয় নারায়ণগঞ্জ (২২২.৪৫ মাইক্রোগ্রাম), চতুর্থ হবিগঞ্জ (২২০.১১ মাইক্রোগ্রাম), পঞ্চম নোয়াখালী (২০৪.০১ মাইক্রোগ্রাম), ষষ্ঠ টাঙ্গাইল (১৮৬.৩২ মাইক্রোগ্রাম), সপ্তম কক্সবাজার (১৮৩.৪১ মাইক্রোগ্রাম), অষ্টম চাঁদপুর (১৭০.৪২ মাইক্রোগ্রাম), নবম চট্টগ্রাম (১৬৫.৩১ মাইক্রোগ্রাম), দশম কিশোরগঞ্জ (১৬৫.১৩ মাইক্রোগ্রাম), একাদশ মৌলভীবাজার (১৫৪.৮১ মাইক্রোগ্রাম), দ্বাদশ লক্ষীপুর (১৪৯.০২ মাইক্রোগ্রাম), ত্রয়োদশ পঞ্চগড় (১৪২.৩১ মাইক্রোগ্রাম), চতুর্দশ ময়মনসিংহ (১৩৮.১১ মাইক্রোগ্রাম), পঞ্চদশ ব্রাহ্মণবাড়িয়া (১৩৪.৭২ মাইক্রোগ্রাম), ষোড়শ ফেনী (১২৮.৪১ মাইক্রোগ্রাম), সপ্তদশ ঠাকুরগাঁও (১২৫.৩২ মাইক্রোগ্রাম) ও অষ্টাদশ জামালপুর (১২১.৬১ মাইক্রোগ্রাম)।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বায়ুদূষণের কারণে প্রতিবছর ৪.২ মিলিয়ন মানুষের অকাল মৃত্যু হয়। সা¤প্রতিককালে বাংলাদেশের পরিবেশ দূষণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে দেশের বিভিন্ন শহরে বসবাসের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
শিকাগো ইউনিভার্সিটির এনার্জি পলিসি ইন্সটিটিউট প্রকাশিত সর্বশেষ এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্সে বলা হয়েছে যে, বায়ু দূষণের কারণে সারা বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় পাঁচ বছর চার মাস। ঢাকায় কমেছে প্রায় সাত বছর সাত মাস।
এদিকে বায়ু দূষণ বর্তমান বিশ্বে বৃহত্তম পরিবেশগত স্বাস্থ্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘আইকিউএয়ার’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২০১৮ সাল থেকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে।
নগরীতে এখন ৮৫ লাখ মানুষের বাস। বায়ুদূষণের দিক থেকে বাংলাদেশের অন্য শহরগুলোর তুলনায় চট্টগ্রামের অবস্থান মোটামুটি ভালো আগে। বর্তমানে অপরিকল্পিত নানা উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনা করার কারনে পরিবেশ দূষণে বিষিয়ে উঠেছে এই শহরের সামগ্রিক পরিবেশ।
এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুসারে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশিকা পূরণ হলে এ দেশের মানুষের গড় আয়ু আরও প্রায় সাত বছর বেড়ে যেতো।
এ বিষয়ে চট্টগ্রামে পরিবেশ আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত আলীউর রহমান জানান, নগরীতে অপরিকল্পিত ও যাচ্ছেতাই পদ্ধতিতে উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনা করার কারণে মূলত নগর পরিবেশ বিষিয়ে উঠেছে। পরিবেশ সুরক্ষায় দায়িত্ব পালন করতে বিধিবদ্ধভাবে বাধ্য এমন সংস্থাগুলোর এক্ষেত্রে উদাসীন মনোভাব দূষণকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাই চলমান উন্নয়ন কর্মকান্ডগুলো থেকে পরিবেশ দূষণের মাত্রা কমিয়ে আনতে তদারকির কোন বিকল্প নেই।