‘স্বাধীন পূর্ব বাংলা দিবস’ ঘোষণা ছিল টার্নিং পয়েন্ট

13

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঊনিশ শ’একাত্তরে বাঙালি জাতির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে ডিআইটির টেলিভিশন কেন্দ্রে প্রায় একশ’ পাক সেনা পাহারায় থাকত। সবসময় সেনাদের নজরদারিতে থাকতেন টেলিভিশনের কর্মী আর কলাকুশলীরা। এর মাঝেই কৌশলে দেশের মানুষকে উজ্জীবিত করার কাজে, যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করার কাজে নিয়োজিত ছিলেন তাঁরা। ১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ শুরু করেছিলেন তৎকালীন টেলিভিশন কর্পোরেশন পাকিস্তান ঢাকার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে অসহযোগ আন্দোলন থেকেই টেলিভিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বীরোচিতভাবে কর্মসূচি পালন করেছিলেন। কৌশলে বাঙালিকে উজ্জীবিত করার অনুষ্ঠান প্রচার, নাটক প্রচার প্রভৃতি ছিল। তবে, সেসময় টেলিভিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সবচেয়ে সাহসিকতার কাজ ছিল ২৩ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় দিবসে পাকিস্তানের পতাকা টেলিভিশনে প্রচার না করা। ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর ঢাকা ডিআইটি ভবনের একটি অংশজুড়ে টেলিভিশন পিটিসি ঢাকা কেন্দ্র নামে যাত্রা শুরু করা পরবর্তীতে পাকিস্তান টেলিভিশন কর্পোরেশন ঢাকা কেন্দ্র নামে পরিচিতি লাভ করে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তখনও পাকিস্তানি পতাকা উড়ছিল। এসময় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবানে সারা দেশে ‘জাতীয় পতাকা দিবস’ পালিত হয়। ছাত্রলীগ ও ডাকসুর সমন্বয়ে এই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ঘর-বাড়ি ও প্রতিষ্ঠানসমূহে স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন জাতীয় পতাকা উত্তোলনের আহবান জানানো হয়। এই অভাবনীয় ঘটনা কৌশলগতভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়কে অবশ্যম্ভাবী ও অপরিহার্য করে তোলে। দিনটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটেও ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, ১৯৪০ সালের এই দিনে লাহোর প্রস্তাব পাস হয় এবং পাকিস্তান এই দিনটিকে ‘জাতীয় দিবস’ হিসাবে পালন করে। কিন্তু, স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ একে প্রত্যাখ্যান এবং এই দিনটিকে ‘প্রতিবাদ দিবস’ হিসাবে আখ্যায়িত করে। ঢাকার পল্টন ময়দানে এক লাখ লোকের সশস্ত্র কুচকাওয়াজের আয়োজন করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের তত্ত¡াবধানে গঠিত ‘জয় বাংলা বাহিনী’। চরম ঝুঁকি উপেক্ষা করেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের আকাশে সেদিন মুক্তিকামী লাখো বাঙালি বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উড়িয়েছিল।
এদিকে, বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে চলমান আলোচনা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন। এরপর ভুট্টো এবং পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাইয়ুম গ্রুপ)- এর খান আবদুল কাইয়ুম খান ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে পৃথক পৃথক বৈঠক করেন। বৈঠকের পর ভুট্টো সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচি স্বায়ত্তশাসন নয়, সার্বভৌমত্বের দাবি। তাই তিনি এটা প্রত্যাখ্যান করলেন। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ-ভাসানী) এই দিনটিকে ‘স্বাধীন পূর্ব বাংলা দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করে। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের উভয় গ্রুপ এবং অন্যান্য পেশাজীবী, নারী ও বিভিন্ন সংগঠন দিবসটি পালন উপলক্ষে সারাদেশে মিছিল করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য এটি ছিল একটি টার্নিং পয়েন্ট।