স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তীর মাস শুরু

47

শুরু হলো বাঙালির স্বাধীনতা ও গৌরবগাঁথার মার্চ মাস। পরাধীনতার শেকল ছেঁড়ার অগ্নিঝরা মার্চ একইসাথে ইতিহাস, বিষাদ ও বেদনার মাসও বৈকি! এই মাসের ২৫ তারিখ থেকে লেখা শুরু হয়েছিল বাঙালি জাতির এক অমর মহাকাব্য, যার নাম বাংলাদেশ। পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করে পূর্ব দিগন্তে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যকে ছিনিয়ে আনার চূড়ান্ত লড়াই শুরু হয়েছিল এই অবিস্মরণীয় মার্চেই।
১৯৭১ সালের মার্চে শুরু হওয়া বাঙালি জাতির স্বাধীনতা অর্জনের চূড়ান্ত লড়াই বা সশস্ত্র সংগ্রাম অব্যাহত থাকে দীর্ঘ নয় মাস।
রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর সবুজ জমিনের বুকে লাল সূর্য খচিত পতাকার দেশ বাংলাদেশ স্বাধীনতা লঅভ করে। বিশ্ব মানচিত্রে নতুন একটি দেশের অভ্যুদয় ঘটে অগণিত প্রাণের বিনিময়ে। এ দেশের শোষিত, নিপীড়িত, অধিকারবঞ্চিত মানুষ স্বাধিকারের জন্য লড়াই করে আসছিলেন দীর্ঘদিন ধরে। মহান ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ছিল জাতিসত্ত্বার স্বরূপ অন্বেষার এক একটি মাইলফলক। সত্তরের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ অর্থাৎ বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পরও তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে নানা ষড়যন্ত্র ও টালবাহানা শুরু করে। যার প্রতিবাদে করতে গিয়ে বাঙালি জাতি মহান মুক্তিযুদ্ধ রচনা করে।
আজ থেকে ৪৫ বছর আগে মার্চ মাসের এই দিনে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে কোনো স্বাধীন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিল না। তৎকালীন পাকিস্তানের পূর্ব অংশ, অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মনে লালিত একটি স্বপ্ন, একটি মাত্র আকাঙ্খাই জাগ্রত ছিল, তা হলো পরিপূর্ণ স্বাধীনতা বা শৃঙ্খলমুক্তি। দীর্ঘকাল ধরে চলতে থাকা নিগ্রহ, শোষণ, বঞ্চনা ও নিপীড়নের নাগপাশ ছিঁড়ে সগর্বে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অদম্য আকাঙ্খা ছিল প্রবল। এজন্য স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির অন্তর্নিহিত শক্তির উৎস। এ মাসেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। যার প্রেরণা ও দৃপ্ত সাহসে সাগরসম রক্তের বিনিময়ে জন্মলাভ করে স্বাধীন বাংলাদেশ।
এর আগে সাতই মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি শাসকদের হুঁশিয়ার করে বলেছিলেন, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবাইয়া রাখতে পারবা না। মরতে যখন শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাইয়ে রাখতে পারবে না। রক্ত যখন দিয়েছি, আরো দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো- ইনশাল্লাহ। এবাররে সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ এই ঐতিহাসিক ভাষণের সময় মুর্হুমুহু গর্জনে উত্তাল হয়ে উঠেছিল জনসমুদ্র। লক্ষ কন্ঠের একই আওয়াজ উচ্চারিত হতে থাকে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। ঢাকাসহ গোটা দেশের আনাচে-কানাচে পতপত করে উড়ছিল সবুজ জমিনের উপর রক্তলাল সূর্যখচিত বাংলাদেশের পতাকা।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রূয়ারি ভাষার জন্য যে আগুন জ্বলে উঠেছিল বাংলার নিপীড়িত মানুষের মনন ও চিন্তায়- সে আগুন ক্রমেই যেন ছড়িয়ে পড়ে বাংলার পথে-প্রান্তরে। এর পর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-এর ছয়দফা এবং ঊনসত্তরের অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের সিঁড়ি বেয়ে একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চ বাঙালি জাতির জীবনে নিয়ে আসে নতুন বারতা। এ বছরের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ২৫ মার্চ রাত একটার পর পাকিস্তানি সৈন্যরা বঙ্গবন্ধুকে তাঁর বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে। ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানিরা বাঙালির কন্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার লক্ষ্যে ‘অপারশেন সার্চলাইট’ নামে বাঙালি নিধনে নামে। ঢাকার রাস্তায় বেরিয়ে সৈন্যরা নির্বিচারে হাজার হাজার লোককে হত্যা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়ে ছাত্র-শিক্ষককে হত্যা করে। এরপরের ঘটনাপ্রবাহ শুধুই প্রতিরোধের ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর আহব্বানে ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলা হয়। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা যুক্ত হন বাঙালির মুক্তি লড়াইয়ে। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধের পর ষোলই ডিসেম্বর বিজয়লাভের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি অর্জন করে বহু আকাংখা ও স্বপ্নের স্বাধীনতা।