স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ৫০ বছরে ছন্দযোগ নাকি ছন্দপতন

20

 

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নিল এক টুকরো স্বাধীন-সার্বভৌমত্ব বাংলাদেশ। সোনার বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুবিজুর রহমান শুরু করেছিলেন উন্নয়ন অগ্রযাত্রা। মাঝখানে ছন্দপতন হয়েছিল দেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রায়। বর্তমানে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ থেকে এখন বিশে^র উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে। ২০৩৫ সালের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা হবে বৃহৎ অর্থনীতি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। টেকসই উন্নয়নের এ অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকলে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশে^র বুকে একটি উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করেছে বাংলাদেশ। এ সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা কী পেরেছি সোনার বাংলার রূপ দিতে ? পেরেছি কী ছন্দযোগ করতে ? নাকি বিপুল উন্নয়নের পরও থেকে গেছি সীমাবদ্ধতায় ? বিভিন্ন খাতে পর্যালোচনা করলেই তার উত্তর মিলবে সহজেই।
কৃষি খাত : বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। কৃষিই প্রধান চালিকাশক্তি। ১৯৭২ সালে দেশের প্রথম বাজেটে বঙ্গবন্ধু কৃষি বিপ্লবের কথা বলেছিলেন। কৃষি উন্নয়ন খাতে বাজেট দিয়েছিলেন ১০১ কোটি টাকার। বর্তমানে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে কৃষি ও পানি উন্নয়ন খাতে বাজেট ধরা হয়েছে ৭৪ হাজার ১০২ কোটি টাকা।
২০১৬-২০১৭ সালে শ্রম জরিপ অনুযায়ী, শ্রমশক্তির ৪০.৬২ শতাংশ এখনো কৃষিতে নিয়োজিত। অর্থাৎ কৃষি এখনো বিনিয়োগের বড় ক্ষেত্র। ১৯৭২ সালের তুলনায় স্বাধীনতার ৫০ বছরে আবাদী জমির পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ৩০ শতাংশ, ৮৫.৭৭ লাখ হেক্টর। মূল কারণ কৃষি জমিতে অপরিকল্পিত স্থাপনা। কৃষিখাতে ব্যাপক উন্নয়নের পরও এখনো আমদানি নির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে পারছি না। কারণ কৃষিজমির পরিমাণ হ্রাস, দ্রæত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কৃষি ব্যবস্থায় উন্নত প্রযুক্তির অপ্রতুলতা। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণে বর্তমান সরকার একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এছাড়াও কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে বীজ বিতরণ, সরকারি-বেসরকারি ও কৃষি ব্যাংক হতে কৃষকদের ঋণ প্রদান, কৃষি গবেষণায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং কৃষি খাততে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ নিশ্চিতে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। সরকারের কৃষিবান্ধব নীতির কারণে ভবিষ্যতে কৃষিতে উজ্জ্বল বলা যেতে পারে।
মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ : ১৯৭৩-৭৪ সালে বাংলাদেশের জিডিপি’র আকার ছিল মাত্র ৭ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। মাথাপিছু আয় ছিল ১২৯ ডলার। এবং দারিদ্র্যের হার ছিল ৭০ শতাংশ। দারিদ্র্যের তকমা লাগানো দেশ কতটুকু এগিয়ে গেছে, তা আজ ৫০ বছর পর এসে ২০২০ সালের জরিপের সাথে তুলনা করলে বুঝতে পারি। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের জরিপ অনুযায়ী, বর্তমানে জিডিপি ২৭ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা, যা ৩৬৯ গুণ। মাথাপিছু আয় ২০৬৪ ডলার। দারিদ্র্যের হার কমে দাঁড়িয়েছে ২০.৫ শতাংশ। মানবসম্পদ উন্নয়নে সেখানে যোগ্যতা দরকার ৬৪ স্কোর, বর্তমানে বাংলাদেশ সেখানে পেরেছে ৭৩.২ স্কোর। তারপরও অনুন্নত কৃষিব্যবস্থা, অনগ্রসর শিক্ষাব্যবস্থা, ত্রæটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা, দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র, দুর্ভোগের ব্যাপকতা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বাস্তবমুখী নীতি ও পরিকল্পনার অভাব। এসব সমস্যা সমাধানে গৃহীত হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন পদক্ষেপ, দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন, বয়স্ক-বেকার ভাতা প্রদান, আত্মকর্মসংস্থানের জন্য ঋণদান কর্মসূচিসহ আরও নানা পদক্ষেপ।
সড়ক ও যোগাযোগব্যবস্থা : যোগাযোগব্যবস্থায় এসেছে যুগান্তরকারী পরিবর্তন, নতুনমাত্রায় ছন্দযোগ। পুরো বিশ^ যখন বলেছিল, পদ্মাসেতু নির্মাণ করতে পারব না। আমরা তা করে দেখিয়েছি। এছাড়াও হার্ডিজ ব্রিজ, তিত্রা রেলওয়ে ব্রিজ পুনর্নির্মাণ, দীর্ঘ ৫৬ বছর পরও আবারও মিতালী এক্সপ্রেজ চালু, ২০৪০ সালের মধ্যে সমস্ত সড়ক ৪ ও ৬ লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। নির্মাণ করা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু টানেল, মেট্রোরেল। আকাশ ও নদীপথে সাধিত হয়েছে উন্নয়ন। সুগম হয়েছে যোগাযোগব্যবস্থা। এত উন্নয়নের পরও এড়ানো যাচ্ছে না সড়কদুর্ঘটনা। প্রতিদিন খবরের কাজ খুললেই দেখতে পাই, যন্ত্রদানবের তাÐবে প্রাণ অকালে ঝরে পড়ছে অগণিত প্রাণ। আমাদের বিশ^বিদ্যালয় হারিয়েছে হারুনুর রশিদের মতো উজ্জ্বল মুখ। তবে ঘাটতি কোথায়। কেন এত দুর্ঘটনা। কারণ হিসেবে দেখতে পাই, অতিরিক্ত গতি, ওভারটেকিং, প্রতিনিয়ত আইন অমান্য করা, মহাসড়কে নির্মাণে ত্রæটি ও দুর্যোগব্যবস্থাপনা, অদক্ষ চালককে লাইসেন্স প্রদান। এ থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের সম্মিলিত কাজ করে যেতে হবে। যেমন : লাইসেন্স প্রদানে জালিয়াতিরোধ, বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ গতিসীমা বেঁধে দেওয়া, যাতায়াতের ক্ষেত্রে আইন অমান্য করার সর্বোচ্চ শাস্তি ও জরিমানা নিশ্চিতকরন, অতিরিক্ত ট্রাফিক পুলিশ নিয়োগ, জেব্রা ক্রসিং ইত্যাদি। আইনের ব্যবস্থাপনার যথাযথ প্রযোগই পারে দুর্ঘটনামুক্ত নিরাপদ সড়ক উপকার।
শিক্ষা খাত : বিশে^র সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা। সাধিত হয়েছে পরিবর্তন। সাফল্যের কথা উঠলেই যে বিষয়গুলো প্রথমেই আসে তা হলো, শিক্ষা কমিশন গঠন, অবৈতনিক ও প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক নিশ্চিতকরণ, সকল স্তরের ঝরে পড়ার হার হ্রাস, উপবৃত্তি ও শিক্ষা বীমা কর্মসূচি, বিনামূল্যে বই বিতরণ, জেন্ডার সমতা ইত্যাদি। তারপরও সীমাবদ্ধতা থেকেই যায়, ফরে বৃদ্ধি পাচ্ছে কর্মসংস্থানহীন শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। এর প্রধান কারণ হচ্ছে অপরিকল্পিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অপ্রতুল বাজেট প্রণয়ন, গুণগত শিক্ষার কমতি ও কারিগতি শিক্ষার অভাব ইত্যাদি। ৫০ বছরের সফলতা ও ব্যর্থতা পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই, আমরা এখনো গবেষণাবিহীন শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরুতে পারিনি। কিন্তু থেকে নেই অগ্রগতি। বর্তমানে স্বাক্ষরতার হার ৭৫.৬০ শতাংশ।
স্বাস্থ্য খাত : চিকিৎসাক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। বর্তমানে মানুষের গড় আয়ু ৭২-৪ বছর। আমরা গড়তে পেরেছি বিশ^মানের প্রযুক্তিনির্ভর চিকিৎসাব্যবস্থা, গড়েছি পোলিওমুক্ত বাংলাদেশ। কমিয়ে এসেছি নারী ও শিশু মৃত্যুর হার। আজ দেশের জনগণকে মরতে হচ্ছে না বিনা চিকিৎসায়।
ঊনবিংশ শতাব্দী, যেখানে চারদিকে বাংলাদেশের জয়জয়কার, সেখানে আমরা আজও দেখি, নারী নির্যাতন-ধর্ষণ, শিশুশ্রমের মতো বিরাট ব্যাধি, যুবসমাজের বিরাট অংশ আজও মাদকের অন্ধকারজগতে। এ সমস্যা সমাধানে আমাদের হাতে হাত রেখে লড়ে যেতে হবে, গড়ে তুলতে হবে নাগরিকদের সোচ্চার প্রতিবাদ। তবেই এই বাংলায় থাকবে না কোন দুর্নীতি, দারিদ্র্য, কুসংস্কার ও নির্যাতন। আমরা পাবো, বঙ্গবন্ধুর দেখা সেই স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা পেরেছি ছন্দযোগ করতে।
লেখকদ্বয় : শিক্ষার্থী
আইন অনুষদ, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম