স্বভাব-কবি গোবিন্দ দাস

53

 

বৃহত্তর ঢাকার বর্তমান মুন্সীগঞ্জের ব্রাহ্মণগাঁ-ইতিহাসের অনেকখানি জুড়ে রয়েছেন পূর্ববঙ্গের প্রসিদ্ধ স্বভাবকবি গোবিন্দচন্দ্র দাস । তিনি পূর্ব বঙ্গে ‘মগের মুলুকের’ কবি নামেও ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছিলেন। গোবিন্দ দাসের জন্মস্থান ভাওয়াল পরগণার জয়দেবপুর গ্রামে ১৮৫৫ সালে। পিতা রামনাথ দাস এবং মাতা আনন্দময়ী দেবী। জয়দেবপুরের জমিদার রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণের আমত্য ছিলেন বিক্রমপুরের লৌহজং থানার ভরাকর গ্রামের রায়বাহাদুর কালীপ্রসন্ন ঘোষ। সাহিত্যিক ও সম্পাদক হিসেবে খ্যাতিমান কলাকোবিদ এই মানুষটি মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক বর্বরতা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেননি। তিনি নিজে সাহিত্যসেবী হওয়া সত্তে¡ও কবি গোবিন্দ দাসের উপর খড়গহস্ত হয়েছিলেন নির্দয়ভাবে। রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ ও রাজ আমত্য কালীপ্রসন্ন ঘোষের বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় সাপ্তাহিক ‘নবযুগ’ পত্রিকায় অনেক অপ্রিয় প্রসঙ্গের অবতারণা করা হয়েছিল। যেহেতু গোবিন্দ দাস একবার রাজার অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রজামন্ডলীর পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন, তাই কালীপ্রসন্ন সহজেই রাজাকে বুঝাতে সক্ষম হলেন যে প্রবন্ধটি গোবিন্দ দাসেরই রচনা। ফলে কবি রাজরোষে পতিত হয়ে নির্বাসন দন্ড নিয়ে চিরদিনের জন্যে জয়দেবপুর পরিত্যাগ করতে বাধ্য হন। অথচ গোবিন্দ দাস বাল্যকাল থেকেই রাজপরিবারে সন্তানতুল্য স্নেহে প্রতিপালিত হয়েছিলেন। অদৃষ্টের পরিহাসে গোবিন্দ ‘নবযুগে’ প্রবন্ধ না লিখেও তাঁর এই দুর্দশা ঘটল। অনন্যোপায় কবি মাতৃভূমি জয়দেবপুর ত্যাগ করে ১৮৮০ সালে মুক্তাগাছায় চলে যান এবং ১৮৮৩ সালে শেরপুরের জমিদার হরচন্দ্র চৌধুরীর চারুবার্তা পত্রিকায় যোগ দেন। পরে কবি ১৮৯২ সালে মুন্সীগঞ্জে চলে আসেন। এখানকার বিখ্যাত সাহিত্যানুরাগী দেবী প্রসন্ন রায় চৌধুরীর পরামর্শে ‘প্রকৃতি’ নামক একটি সাপ্তাহিকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করতে থাকেন ‘মগের মুল্লুক’ কবিতাটি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে রাজপরিবারের পক্ষ থেকে ১৮৯৩ সালে ‘প্রকৃতি’র সম্পাদক অনুকূল চন্দ্র মুখার্জির বিরুদ্ধে ঢাকা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে একটি মানহানির অভিযোগ করা হয়। এ মামলার ফলে ‘মগের মুল্লুক’ কবিতাটি এ দেশে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। ‘মগের মুল্লুক’ বই আকারে প্রকাশিত হয় এবং বিপুল পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে। পরে অবশ্য বঙ্কিম চন্দ্রের অনুরোধে মামলাটি প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। গোবিন্দ চন্দ্র দাসের বিখ্যাত কবিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘মগের মুল্লক’, ‘নির্বাসিতের আবেদন’, ‘হেমাঙ্গিনী ঘোষ’ ও ‘ভাওয়াল’। কবির যখন খুব দুর্দিন তখন তাঁর প্রথম স্ত্রী মারা যান। পরে বিয়ে করেন মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার ব্রাহ্মণগাঁ গ্রামের প্রমদাসুন্দরীকে। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রমদা পিতৃ সম্পত্তির একমাত্র মালিক ছিলেন। ব্রাহ্মণগাঁয় শ্বশুরের বাড়িতেই কবি জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলো অতিবাহিত করেন। কবি গোবিন্দ চন্দ্র দাস ১৯১৫ সালে বিষফোঁড়ায় আক্রান্ত হলে তাকে ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেসময় কবিকে আর্থিক সহায়তা করেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস। সারা জীবনের অভুক্ত এ দেশপ্রেমিক কবিকে নিয়ে খুব একটা লেখা হয়নি। শত কষ্ট বেদনা ও অসুস্থতার মধ্যেও কবি লিখে গেছেন অবিরত। সর্বহারা এ কবির উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো- প্রসূন, মগের মুল্লুক, চন্দন, কুঙ্কম, কস্তুরী, ফুলরেণু, বৈজন্তী, শোক ও সান্ত¡না। কবি গোবিন্দ দাস ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯১৮ সালে ঢাকার নারিন্দায় ব্রাহ্মণগাঁর জমিদার চন্দ্রকান্ত ঘোষের ৪৭ নং সা সাহেব লেনের বাড়ির একটি কুঠুরিতে মারা যান। সূত্র: মো: শাহজাহান মিয়া