স্বপ্ন ও অবলম্বন হারাল দুটি পরিবার

17

নিজস্ব প্রতিবেদক

নগরীর পাহাড়তলী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে এবারের এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাতরাজ উদ্দিন শাহীন (১৮)। ইতোমধ্যে গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত পদার্থবিজ্ঞান প্রথম পত্রের পরীক্ষাও অংশ নিয়েছেন। বাকি পরীক্ষা আর দিতে পারলেন না। স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে পাইলট হবেন। সে স্বপ্ন আর পূর্ণতা পেল না। তার আগেই ট্রেনের ধাক্কায় জীবন প্রদীপ নিভে গেল সাতরাজের।
অন্যদিকে আহজারী থামছেই না পুলিশ কনস্টেবল মনিরুল ইসলামের (৪০) পরিবারে। দুর্ঘটনায় তিনিও প্রাণ হারান। হঠাৎ বাবাকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ দুই মেয়ে মাহমুদা ফেরদৌস ও ফাতেমা আক্তার। গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে ১০ দিকে নগরীর খুলশী থানাধীন ঝাউতলা রেলক্রসিংয়ে বাস-সিএনজি-টেম্পু ও নাজিরহাটগামী ডেমু ট্রেনের সংঘর্ষের এ দুর্ঘটনা ঘটে।
জানা গেছে, সাতরাজের বাড়ি ফটিকছড়ি উপজেলার নানুপুরের কেফায়েত নগর গ্রামে। নগরীর পাঁচলাইশ থানাধীন হামজারবাগ গাউছিয়া আবাসিকে পরিবাররের সাথে থাকতেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে সাতরাজ সবার বড়। তার বাবার নাম ফজল করিম। তিনি হামজারবাগ এলাকায় একটি ছোট্ট মুদির দোকান করে সংসার চালান। হামজারবাগ রহমানিয়া স্কুল থেকে ২০১৯ সালে এসএসসি পাস করে পাহাড়তলী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন সাতরাজ।
সাতরাজের মৃত্যুর খবর শুনে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ছুটে এসেছেন তার সহপাঠী, বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনরা। চমেক হাপাসাতালের মর্গের সামনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তার সহপাঠীরা। তাদের কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, সাতরাজ বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি) পাহাড়তলী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ শাখার ক্যাডেট আন্ডার অফিসার (সিইউও) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। বিএনসিসির পোষাক জমা দেওয়ার জন্য কলেজে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে খুলশী থানার ঝাউতলা এলাকায় ট্রেন দুর্ঘটনার শিকার হয়।
সাতরাজের সহপাঠী আলভিন আহমেদ পূর্বদেশকে বলেন, সাতরাজের সাথে আমিও বিএসনসিসি করেছি। বড় হয়ে পাইলট হওয়ার স্বপ্ন ছিল তার। সে বিএনসিসির সিইউও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিল। সে খুব ভদ্র ও শান্ত-শিষ্ট ছিল। কখনও কারো সাথে খারাপ আচরণ করতো না। বিএনসিসির কাজে সে কলেজে যাচ্ছিল।
চমেক হাসপাতাল মর্গের সামনে কথা সাতরাজের খালু সাজ্জাদ হোসেনের সাথে। তিনি পূর্বদেশকে জানান, সাতরাজ লেখাপড়ায় খুবই মেধাবী। সে খুব শান্ত ও সদালাপী ছিল। তারা মৃত্যুর খবর শুনে বাসার আশপাশের অনেক মানুষ মেডিকেলে ছুটে এসেছেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে সাতরাজ বড়। তার বাবার হামজারবাগ এলাকায় একটি মুদির দোকান আছে।
পাহাড়তলী কলেজের অধ্যক্ষ শ্যামল কান্তি মজুমদার পূর্বদেশকে বলেন, সাতরাজ আমাদের কলেজের শিক্ষার্থী। তার মৃত্যুর খবরে আমরা মর্মাহত। সে এ বছর আমাদের কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। একটি পরীক্ষা দিয়েছে। লেখাপড়ার পাশাপাশি সে বিএনসিসির কার্যক্রমের সাথে যুক্ত ছিল।
এদিকে কান্নার রোল পড়েছে ট্রাফিক পুলিশ কনস্টেবল মনিরুল ইসলামের পারিবারে। হঠাৎ বাবাকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ দুই মেয়ে মাহমুদা ফেরদৌস ও ফাতেমা আক্তার। বাবার এমন চলে যাওয়া কোনোভাবেই মেনে নিয়ে পারছেন না দুইবোন। নিহত মনির হোসেনের দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ে মাহমুদাকে বিয়ে দিয়েছেন। আরেক মেয়ে ফাতেমা আগামী বছরের এসএসসি পরীক্ষার্থী। ছোট ছেলে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। চট্টগ্রাম নগরের চন্দ্রনগর আবাসিক এলাকায় ভাড়া বাসায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকতেন তিনি। মনির হোসেনের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে। তিনি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (ট্রাফিক) উত্তর বিভাগে কনস্টেবল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। পেশাগত জীবনে ৪৯ বার পুরস্কৃত হন নিষ্ঠাবান মনির।
বড় মেয়ে মাহমুদা ফেরদৌস বলেন, আমাদের কি হবে? আমাদের দায়িত্ব কে নিবে? আমার ভাই কারে আব্বু বলে ডাকবে আল্লাহ। আম্মুকে এখন কে দেখবে? ছোট মেয়ে ফাতেমার কণ্ঠে ছিল ক্ষোভ। তার কথা, বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটে, হাজার হাজার মানুষ মরে। তারপরও কেন নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাই এসব বলে কোনো লাভ নেই।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের উপকমিশনার (ট্রাফিক-উত্তর) আলী হোসেন জানান, মনিরুল ইসলাম তাঁর দায়িত্বের ব্যাপারে খুবই আন্তরিক। জীবনের শেষ মুহূর্তেও তার প্রমাণ রেখেছেন। গেটম্যান গেট না ফেললেও মনির হোসেন নিজ থেকে গিয়ে গাড়ি থামাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজের জীবন দিতে হলো তাঁকে।

সিএমপিতে শোকের ছায়া : কনস্টেবল মো. মনিরুল ইসলামের মৃত্যুতে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশে (সিএমপি) নেমে আসে শোকের ছায়া। শোকে বিহব্বল হন সিএমপি’র সব সদস্য।
কনস্টেবল মনিরুল ইসলামের মৃত্যুতে সিএমপি কমিশনার সালেহ্ মোহাম্মদ তানভীর গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেছেন। এক শোক বার্তায় সিএমপি কমিশনার কর্তব্যরত অবস্থায় নিহত মনিরুল ইসলামের সততা, দক্ষতা ও কর্তব্যনিষ্ঠার কথা স্মরণ করেন এবং মরহুমের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ পুলিশ তার এ ত্যাগ, ভালবাসা এবং কর্তব্যনিষ্ঠা চিরদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।
উল্লেখ্য, এই দুর্ঘটনায় সাতরাজ উদ্দিন ও মনিরুল ইসলাম ছাড়াও প্রাণ হারান সৈয়দ বাহাউদ্দিন আহমেদ (৩০) নামে আরও একজন। তিনি পেশায় একজন প্রকৌশলী। এছাড়াও এ ঘটনায় আহত হন ১০ জন। সৈয়দ বাহাউদ্দিন নগরীর পাঁচলাইশ থানাধীন হামজারবাগ এলাকার সৈয়দ সোহরাফ হোসেনের পুত্র।