স্বপ্নের পদ্মাসেতুর নির্মাণযজ্ঞ ও ব্যয়

34

নিজস্ব প্রতিবেদক

জাতির স্বপ্নপূরণ ও সক্ষমতার প্রতীক পদ্মা সেতু নির্মাণযজ্ঞে সময় বৃদ্ধির সাথে দফায় দফায় বেড়েছে ব্যয়ও। এসব খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে নানা মহলের পাশাপাশি জনসাধারণের মধ্যেও কৌতূহলের শেষ নেই। সেতু বিভাগ জানিয়েছে, সেতুর সংশ্লিষ্ট সব অবকাঠামো নির্মাণে ৩০ হাজার একশ’ ৯৩ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। পুরো প্রকল্পের ব্যয় এই অঙ্কের হলেও মূল সেতু নির্মাণে এর তিন ভাগের এক ভাগ খরচ হয়েছে। অনেক টাকা খরচ হয়েছে নদীশাসন, সংযোগ সড়ক নির্মাণ, পুনর্বাসন প্রকল্পসহ অন্যান্য খাতে। সেতু নির্মাণে লেগেছে এক যুগেরও বেশি সময়।

সেতু নির্মাণে খরচ: সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুসারে, পদ্মা সেতুর মোট দৈর্ঘ্য নয় দশমিক ৩৩ কিলোমিটার। এর মধ্যে জলভাগ পদ্মা নদীতে ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার, স্থলভাগে অর্থাৎ মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে পড়েছে তিন দশমিক ১৮ কিলোমিটার। প্রকল্পে মূল সেতু নির্মাণে খরচ হয়েছে ১১ হাজার নয়শ’ ১৮ কোটি টাকা। সেতুর পাশ দিয়ে চারশ’ কেভি বিদ্যুৎ লাইন আছে, সেখানে খরচ এক হাজার কোটি টাকা। মূল সেতুর রেললাইনের পাশ দিয়ে গ্যাস লাইন টানা হয়েছে। এই গ্যাস লাইন নির্মাণে খরচ হচ্ছে আরও তিনশ’ কোটি টাকা।

নদীশাসনে খরচ: পদ্মা সেতু এলাকাকে নদী ভাঙনসহ যে কোনও দুর্যোগ থেকে রক্ষায় প্রকল্প এলাকায় প্রায় ১৪ কিলোমিটার নদীশাসন করতে হচ্ছে। এর মধ্যে মাওয়া এলাকায় এক দশমিক ছয় কিলোমিটার এবং জাজিরা এলাকায় ১২ দশমিক ৪০ কিলোমিটার নদীশাসন করা হচ্ছে। এই কাজ করছে চীনের কোম্পানি সিনোহাইড্রো কর্পোরেশন লিমিটেড। খরচ হচ্ছে আট হাজার সাতশ’ সাত কোটি ৮১ লাখ টাকা।

সংযোগ সড়ক: পদ্মা সেতুকে দুই অংশের মূল সড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করতে নির্মিত হয়েছে মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তের সংযোগ সড়ক। জাজিরা প্রান্তের মূল সংযোগ সড়কটি ১০ দশমিক ৬৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে। এর সঙ্গে আশেপাশের স্থানীয় সড়কগুলোকে সংযোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হচ্ছে আরও ১২ কিলোমিটার সার্ভিস সড়ক। এছাড়া মাওয়া প্রান্তে এক দশমিক ৬৭ কিলোমিটার সংযোগ সড়কের সঙ্গে যোগ হচ্ছে আরও তিন কিলোমিটার সার্ভিস সড়ক। এই সংযোগ সড়ক নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে এক হাজার চারশ’ ৬৪ কোটি টাকা।

সার্ভিস এরিয়ায় নানা খাতে ব্যয়: সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য মতে, সার্ভিস এরিয়া-২ এর জন্য দুইশ’ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারিং সাপোর্ট এন্ড সেফটি টিমের জন্য প্রথম পর্যায়ে ৭২ কোটি ১৩ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। জলযান ক্রয় চুক্তিমূল্য ৭৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা। কন্সট্রাকশন সুপারভিশন কনসালটেন্ট- ১ বাবদ চুড়ান্ত কিস্তি পর্যন্ত ব্যয় ৮৯ কোটি ১৭ লাখ টাকা। কন্সট্রাকশন সুপারভিশন কনসালটেন্ট-২ বাবদ চুক্তিমূল্য ছয়শ’ নয় কোটি ১৪ লাখ টাকা।

ভূমি অধিগ্রহণ: পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকায় জমি অধিগ্রহণেও খরচ হয়েছে মোটা অঙ্কের টাকা। সেখানে মোট ভূমি অধিগ্রহণ হয়েছে দুই হাজার ছয়শ’ ৯৩ দশমিক ২১ হেক্টর। খরচ হয়েছে দুই হাজার ছয়শ’ ৯৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।

পুনর্বাসন: পদ্মা সেতু নির্মাণের কারণে ওই এলাকায় বসবাসরতদের অনেককে বাড়িঘর ত্যাগ করতে হয়েছে। এসব মানুষদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছে সরকার। তাদের জন্য পদ্মা নদীর দুই প্রান্তে আধুনিক নাগরিক সুবিধা সম্মলিত সাতটি পুনর্বাসন সাইট নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে আবাসিক প্লট নিতে তিন জেলার ২২ হাজার পাঁচশ’ ৯৩ উপকারভোগীর মাঝে এ পর্যন্ত সাতশ’ ৫৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
গ্রামীণ সড়ক ও বৃক্ষরোপণে ব্যয়: পদ্মা সেতুর কারণে এলজিইডির মাধ্যমে নির্মিত বা সংস্কার হচ্ছে গ্রামীণ সড়কও। মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার ছয়টি গ্রামীণ সড়ক নির্মাণবাবদ মোট ১০ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে এবং শরীয়তপুর জেলার জাজিরা উপজেলার চারটি গ্রামীণ সড়ক উন্নয়নেও ১০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। প্রকল্প এলাকার বিভিন্ন স্থানে বৃক্ষরোপণ খাতে ব্যয় হয়েছে প্রায় নয় কোটি টাকা।
পদ্মা সেতু জাদুঘর স্থাপন: পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্প এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের মধ্যে চুক্তির আওতায় ‘পদ্মা সেতু জাদুঘর প্রতিষ্ঠা’ করা হচ্ছে। এর জন্য নমুনা সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কাজ চলমান আছে। চলতি বছরের মে পর্যন্ত সর্বমোট দুই হাজার তিনশ’ ৫৫ টি নমুনা সংগ্রহপূর্বক সংরক্ষণ করা হয়েছে। পদ্মা সেতু জাদুঘরের জন্য প্রস্তাবিত ভবন নির্মাণ কাজ বিলম্ব হওয়ায় জাদুঘরের কাজ সম্পন্ন করতে দেরি হচ্ছে। এখাতে পাঁচ কোটি ৮৩ লাখ ৫৭ হাজার ছয়শ’ ৫৩ টাকা ব্যয় হচ্ছে।

পরিবেশ খাতে ব্যয়: জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও অভয়ারণ্য ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি খাতেও সাড়ে আট কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। পদ্মা সেতু বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ঘোষণা সম্পন্ন এবং গেজেট প্রকাশিত হয়েছে। পদ্মা সেতু বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে একটি ‘খসড়া ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান’ পরামর্শক দল কর্তৃক দাখিল করা হয়েছে। এটি চূড়ান্তকরণের কাজ চলমান আছে। এ খাতে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। এছাড়া পরিবেশগত সকল কার্যক্রমে এ পর্যন্ত সর্বমোট ব্যয় ২৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা। ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট কনসালটেন্সি খাতে ব্যয় ২৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।
সর্বপ্রথম ২০০৭ সালে ১০ হাজার একশ’ ৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প একনেক সভায় অনুমোদন পায়। পরে নকশা পরিবর্তন হয়ে দৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়ায় নির্মাণ ব্যয়ও বাড়ে। ২০১১ সালে ২০ হাজার পাঁচশ’ কোটি ২০ লাখ টাকার সংশোধিত প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পায়। ২০১৬ সালে আরও আট হাজার দুইশ’ ৮৬ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ালে মোট ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার সাতশ’ ৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। সবশেষ প্রকল্পের মোট ব্যয় ৩০ হাজার একশ’ ৯৩ কোটি ৩৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর পুরো টাকাই সরকারি অর্থায়ন।