স্বজনদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর

39

ঢাকার বনানীতে আগুনে পোড়া এফআর টাওয়ারের দায়িত্ব পুলিশের কাছে হস্তান্তরের আগে সব ফ্লোরে তল্লাশি শেষ করেছে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন। নতুন করে আগুন জ্বলে ওঠার আশঙ্কা না থাকায় ভবনটি পুলিশের কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার শাহজাহান সিকদার।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে ২২তলা ওই ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, দুপুর ১টার দিকে সার্চ অপারেশন শেষ হয়েছে। পর্যালোচনা করে দেখেছি, নতুন করে আগুন লাগার কোনো আশঙ্কা নেই।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকার কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ের ২২ তলা ওই ভবনে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ২১টি ইউনিট প্রায় সাড়ে সাত ঘণ্টা চেষ্টার পর তা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। উদ্ধার অভিযানে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যরাও অংশ নেন। অগ্নিকান্ডের এ ঘটনায় ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। ভবনের ভেতরে আর কোনো মৃতদেহ পাওয়া যায়নি বলে জানান ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা।
ভবনটির অবস্থা এখন ঝুঁকিপূর্ণ কিনা, তা চিহ্নিত করতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে জানিয়ে শাহজাহান সিকদার বলেন, ওই কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে।
বুয়েটের বিশেষজ্ঞ ছাড়াও পুলিশের ক্রাইম সিন ইউনিটের সদস্যরা শুক্রবার সকাল থেকে এফআর টাওয়ারের বিভিন্ন ফ্লোরে চ‚ড়ান্ত তল্লাশি অভিযানে অংশ নেন।
আগুন কেড়ে নিল যাদের : রাজধানীর বনানীর এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় এ পর্যন্ত ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে জানিয়ে ঢাকা জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আবু ফতেহ মো. শফিকুল ইসলাম বলেছেন, তাদের সবার মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
এরমধ্যে ঢাকা মেডিকেল থেকে ১০ জন, কুর্মিটোলা হাসপাতাল থেকে ৬ জন, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল- সিএমএইচ থেকে ৪ জন, ইউনাইটেড হাসপাতাল থেকে ৩ জন, অ্যাপোলো হাসপাতাল থেকে ১ জন এবং বনানী ক্লিনিক থেকে ১ জনের মৃতদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানান তিনি। খবর বিডিনিউজের
নিহত এই ২৫ জনের নাম-ঠিকানাসহ একটি তালিকা প্রকাশ করেছে বনানী থানা পুলিশ। এরমধ্য দিয়ে এফআর টাওয়ারে নিহতের সংখ্যা নিয়ে অস্পষ্টতার অবসান ঘটল। পুলিশের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার রাতেই ২৫ জনের মৃত্যু কথা জানানো হলেও ফায়ার ব্রিগেডের হিসাবে ওই সংখ্যা ছিল ১৯। তবে অধিকাংশ মরদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়া হস্তান্তর হওয়ায় কীভাবে কয়জনের মৃত্যু হয়েছে তা জানা যায়নি।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শফিকুল ইসলাম জানান, নিহতদের মধ্যে কেবল একজনের লাশের ময়নাতদন্ত হয়েছে। স্বজনদের অনুরোধে ময়নাতদন্ত ছাড়াই বাকিদের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে। আগুনে থেকে বাঁচতে ওই ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে মারা যাওয়া শ্রীলঙ্কান নাগরিক নিরস ভিগনারাজার মরদেহ তার দেশের দূতাবাসের প্রতিনিধির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
বনানী থানার এসআই গুলশান আরা জানান, হাসপাতাল ও স্বজনদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তারা নিহত ২৫ জনের তালিকা তৈরি করেছেন। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত আর কেউ নিখোঁজ থাকার তথ্য পুলিশের হাতে নেই।
অগ্নিকান্ডে নিহতরা হলেন, ১. সৈয়দা আমিনা ইয়াসমিন (৪৮), পিতা সৈয়দ মহিউদ্দিন আহম্মেদ, গ্রাম-রামপাশা, কেরামতনগর, থানা-কমলগঞ্জ, জেলা- মৌলভীবাজার। ঢাকায় থাকতেন এ/পি-২০৬ কাফরুলে। ২. মো. মনির হোসেন সর্দার (৫২), পিতা- মৃত মোতাহার হোসেন সর্দার, উত্তর কড়াপুর (সর্দারবাড়ি) থানা- বিমানবন্দর, জেলা- বরিশাল। ঢাকায় থাকতেন ৬৮৫/২, মোল্লার রোড, পূর্ব মনিপুরে। ৩. মো. মাকসুদুর রহমান (৩২), পিতা- মৃত মিজানুর রহমান, ১১ আলমগঞ্জ, থানা- গ্লোরিয়া, জেলা- ঢাকা। ৪. আবদুল্লাহ আল মামুন (৪০), পিতা- মৃত আবুল কাশেম, ১৫/৬/২, রোড-১, কল্যাণপুর, থানা-মিরপুর, ঢাকা-১২১৬। ৫. মো. মোস্তাফিজুর রহমান (৩৬), পিতা- মৃত আবদুর রশিদ মুন্সি, স্থায়ী ঠিকানা- চতরা, থানা- পীরগঞ্জ, জেলা- রংপুর। ঢাকায় থাকতেন ২/এ/২/১৬/ মিরপুর-২ ঠিকানায়। ৬. মো. মিজানুর রহমান, স্থায়ী ঠিকানা- কোদলা, থানা- তেরখাদা, জেলা- খুলনা। চাকরি করতেন এফআর টাওয়ারের দশম তলার হেরিটেজ এয়ার এক্সপ্রেসে। ৭. ফ্লোরিডা খানম পলি (৪৫), স্বামী- ইউসুফ ওসমান, বাসা নং-২, রোড-৪, রূপনগর হাউজিং, থানা- রূপনগর, ঢাকা। ৮. আতাউর রহমান (৬২), পিতা- মৃত হাবিবুর রহমান, বাসা-১৭/২, তাজমহল রোড, বøক-সি, থানা- মোহাম্মদপুর, ঢাকা। ৯. মো. রেজাউল করিম রাজু (৪০), পিতা- নাজমুল হাসান, স্থায়ী ঠিকানা- দক্ষিণ নাগদা, থানা- মতলব দক্ষিণ, জেলা- চাঁদপুর। ঢাকায় থাকতেন বাড়ি নম্বর-১৬, রোড-২৩, ফ্ল্যাট বি/২, বনানী ঠিকানায়। ১০. আহম্মদ জাফর (৫৯), পিতা- মৃত হাজি হেলাল উদ্দিন, স্থায়ী ঠিকানা- নবীনগর, থানা- সোনারগাঁও, জেলা- নারায়ণগঞ্জ। ১১. জেবুন্নেছা (৩০), পিতা- আবদুল ওয়াহাব, স্থায়ী ঠিকানা- লক্ষীনারায়ণপুর, থানা- বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী। ঢাকায় থাকতেন ৬৬/৩, পশ্চিম রাজাবাজারে। ১২. মো. সালাউদ্দিন মিঠু (২৫), পিতা- সামসুদ্দিন, বাসা-৩৪৯, মধুবাগ মগবাজার, রমনা, ঢাকা। ১৩. নাহিদুল ইসলাম তুষার (৩৫), পিতা- মো. ইছাহাক আলী, স্থায়ী ঠিকানা- ভানুয়ানগর, থানা- মির্জাপুর, জেলা- টাঙ্গাইল। ১৪. তানজিলা মৌলি (২৫), স্বামী- রায়হানুল ইসলাম, স্থায়ী ঠিকানা- সান্তাহার বলিপুর, থানা- আদমদীঘি, জেলা- বগুড়া। ঢাকায় থাকতেন বাড়ি ই/৩, মিতালী হাউজিং, দক্ষিণ কাফরুল ঠিকানায়। ১৫. মো. পারভেজ সাজ্জাদ (৪৬), পিতা- মৃত নজরুল ইসলাম মৃধা, স্থায়ী ঠিকানা- বালুগ্রাম, কাশিয়ানী, জেলা- গোপালগঞ্জ। ১৬. নিরস ভিগনারাজা (৩৫), বাবা- ভিগনারাজা, দেশ- শ্রীলংকা। ঢাকায় থাকতেন বাসা- ৭৬, রোড- ১৮, ব্লক-এ, বনানীতে। ১৭. ইফতিয়ার হোসেন মিঠু (৩৭), পিতা- মো. ইছহাক, স্থায়ী ঠিকানা- বানিয়াপাড়া, কুমারখালী, কুষ্টিয়া। ১৮. শেখ জারিন তাসনিম বৃষ্টি (২৫), পিতা- শেখ মোজাহিদুল ইসলাম, স্থায়ী ঠিকানা- বেস্টপাড়া, মেইন রোড, যশোর। ঢাকায় থাকতেন ৮৪/১ খিলক্ষেত বটতলা ঠিকানায়। ১৯. মো. ফজলে রাব্বী (৩০), পিতা- মো. জহিরুল হক, উত্তর ভ‚ঁইঘর, থানা- ফতুল্লা, জেলা- নারায়ণগঞ্জ। ২০. আতিকুর রহমান (৪২), পিতা- মৃত আবদুল কাদির মির্জা, স্থায়ী ঠিকানা- পূর্ব সারেনগা শৈলাপাড়া, থানা- পালং, জেলা-শরীয়তপুর। ঢাকায় থাকতেন ক্যান্টনমেন্টের মানিকদী আমতলা এলাকায়। ২১. আনজিব সিদ্দীকি আবির (২৭), পিতা-আবু বক্কর সিদ্দিকী, স্থায়ী ঠিকানা- কলেজ রোড, পাটগ্রাম, জেলা-লালমনিরহাট। ঢাকায় থাকতেন ৮৫ মধ্য পাইকপাড়া, মিরপুরে। ২২. আবদুল্লাহ আল ফারুক (৬২), পিতা- মৃত মকবুল আহম্মেদ, পূর্ব বগাইর, থানা- ডেমরা, জেলা- ঢাকা। ২৩. রুমকি আক্তার (৩০), স্বামী- মাকসুদুর রহমান, স্থায়ী ঠিকানা- জলঢাকা, নীলফামারী। ২৪. মো. মঞ্জুর হাসান (৪৯), পিতা- মৃত মনসুর রহমান, স্থায়ী ঠিকানা- বোয়ালিয়া, থানা- নওগাঁ, জেলা- নওগাঁ। ঢাকায় থাকতেন কাফরুলের ইব্রাহিমপুরের ছাপড়া মসজিদ এলাকায়। ২৫. মো. আমির হোসেন রাব্বী (২৯), পিতা- মো. আইয়ুব আলী, স্থায়ী ঠিকানা- গাঙ্গহাটি (চরপাড়া), থানা- আতাইকুলা, জেলা- পাবনা। ঢাকায় থাকতেন বাসা-২৩, রোড-৯, ব্লক-এ, নিকুঞ্জ-২, খিলক্ষেত ঠিকানায়।
বাদী খুঁজছে পুলিশ : বনানীর এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় যারা নিহত অথবা আহত হয়েছেন তাদের স্বজনদের মধ্য থেকে মামলার বাদী খুঁজছে পুলিশ। সেখান থেকে বাদী পাওয়া না গেলে রাষ্ট্র বাদী হয়ে মামলা দায়ের করবে।
গতকাল শুক্রবার এফ আর টাওয়ার পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এ তথ্য দেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী। তিনি বলেন, কোনো ঘটনায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হন তারা বা তাদের স্বজনেরা মামলার বাদী হওয়ার প্রথম দাবিদার। যদি তা পাওয়া না যায় তাহলে রাষ্ট্র বাদী হয়ে মামলা করে। এই ঘটনায় যারা আহত এবং নিহত হয়েছেন তাদের স্বজনদের মধ্যে থেকে কেউ বাদী হন কিনা সেটি আমরা প্রথমে দেখছি। যদি পাওয়া না যায় তখন রাষ্ট্র চাইলে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে।
এই ঘটনায় পুলিশ ভবন মালিকের পরিচয় পেলেও তার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়নি বলেও জানান আইজিপি। তিনি বলেন, আমরা মালিকের পরিচয় পেয়েছি। তাও অন্য একটি মাধ্যম থেকে। আমাদের পুলিশের পক্ষ থেকে তার সঙ্গে এখন পর্যন্ত যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়নি।
তিনি আরও বলেন, ফায়ার সার্ভিস আমাদের কাছে ভবনটি বুঝিয়ে দেওয়ার পর আমাদের কার্যক্রম কি হবে সেটা আমরা চূড়ান্ত করবো। প্রতিটি ফ্লোরে পুলিশের নেতৃত্বে একটি করে টিম যাবে। সঙ্গে ফায়ার সার্ভিস আর অফিসগুলোর প্রতিনিধিরা থাকবেন। কারোও কোনো মূল্যবান জিনিস থাকলে সেগুলো যেন খোয়া না যায়, আমরা সেগুলো তাদের কাছে বুঝিয়ে দেবো। বুয়েটের একটি দল আন-অফিসিয়ালি এসেছে। আগামীকাল বা পরশু আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের একটি দল আসবে। তারা যদি নিরাপদ বলেন তাহলে ভবন খুলে দেবো। আর না বললে ভবন খোলা হবে না।
এর আগে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে এফআর টাওয়ারে আগুনের ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে অপরাধের ধরণ অনুযায়ী মামলা হবে বলে জানিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া।
এফ আর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ২৫ জনের মরদেহ উদ্ধার করা গেছে এবং তাদের শনাক্ত করাও সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে ২৪ জনের মরদেহ এরইমধ্যে তাদের স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
সতর্কতার নোটিশেও শোধরায়নি টাওয়ার কর্তৃপক্ষ : বনানীর ফারুক-রূপায়ণ (এফ আর) টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ভবন মালিকদের গাফিলতির প্রমাণ স্পষ্ট। পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপনের ব্যবস্থা না থাকা কিংবা জরুরি বহির্গমন পথের স্বল্পতার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিলো আগেই। এবিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে দুইবার কর্তৃপক্ষকে নোটিশ দিয়ে সতর্ক করা হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এছাড়া ১৮তলা ভবনের অনুমোদন নিয়ে ২৩তলা করার কারণ হিসেবে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য দিতে পারেনি ভবন কর্তৃপক্ষ। এজন্য ডেভেলপার কোম্পানির গাফিলতি ও ভবন পরিচালনা কমিটির সভাপতিকে দায়ী করছে মালিকপক্ষের লোকজন।
মালিকপক্ষের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ ভবনের জমির মালিক প্রকৌশলী এস এম এইচ আই ফারুক। তিনি ১৯৯৫ সালে ভবনের নকশার জন্য রাজউকে আবেদন করেন। অনুমোদন পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে রূপায়ণ গ্রæপকে ভবন বানানোর জন্য জমি দেওয়া হয়। ২০০৫ সালে কাজ শুরু হওয়া ভবনটি চালু হয় ২০০৭ সালে। তখন থেকে ভবনের প্রায় অর্ধেক অংশের মালিকানা ফারুকের। বাকি অর্ধেক রূপায়ণ গ্রুপের।
ফারুক পেশায় ইঞ্জিনিয়ার হলেও এফ আর টাওয়ারে তৃতীয় তলায় কনভেনশন সেন্টার ও ১৮তলায় অফিস স্পেস নামে একটি বিজনেস সেন্টার রয়েছে। ভবন পরিচালনা কমিটির সভাপতি তাসবিরুল ইসলামের মাধ্যমে সব কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছিল। আর ফারুকের পক্ষ থেকে তার ম্যানেজার কামাল হোসেন ভবনটি দেখাশোনা করেন।
অগ্নিকান্ডের পর ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসাইন জানিয়েছেন, ভবনটিতে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের যথেষ্ট ব্যবস্থা ছিল না। যেগুলো ছিল সেগুলো ব্যবহারের অযোগ্য ছিল। এমনকি যে পাইপটি আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজে ব্যবহার হয় সেটিও পুড়ে গেছে। যার ফলে তাৎক্ষণিক ফায়ার ফাইটিং করা সম্ভব হয়নি।
ফায়ার সার্ভিস জানায়, ভবনটির অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি ছিলো। এ বিষয়ে তাদেরকে একাধিকবার নোটিশ করা হলেও তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়নি।
ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (ডিডি) দেবাশিষ বর্ধন জানান, এর আগে আমরা এফ আর টাওয়ার ভবনটি একাধিকবার পরিদর্শন করেছিলাম। ভবনের অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থার বিভিন্ন ত্রুটিসহ সেগুলো সমাধানে কিছু সুপারিশও করা হয়েছিলো। এ বিষয়ে তাদেরকে দুইবার নোটিশ দেওয়ার পরেও ভবন কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
এদিকে, ম্যানেজার কামাল হোসেন বলেন, ভবনে অগ্নিনির্বাপক পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রয়েছে। ফায়ার ডিস্টিংগুইশার থাকলেও আগুনের পর সেগুলো খোলা হয়নি। ইমার্জেন্সি এক্সিট পয়েন্ট রয়েছে এবং সেটি সবসময় খোলা থাকে। ফায়ার সার্ভিসের নোটিশ দেওয়ার বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে কোনো ধরনের নোটিশের বিষয় আমার জানা নেই।
গতকাল শুক্রবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, ভবনটির ১৮তলা অনুমোদন ছিলো, কিন্তু এটি কিভাবে ২৩তলা করা হলো। ভবনটির অনুমোদন দেওয়ার সময়ে রাজউক চেয়ারম্যান কে ছিলেন সেটিও খুঁজে দেখা হচ্ছে। এ কাজে যাদেরই অবহেলা রয়েছে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। সবার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অনুমোদনের বাইরে উপরের ৫তলা তৈরির বিষয়ে জানতে চাইলে ম্যানেজার কামাল বলেন, ১৮তলার অনুমোদন থাকা স্বত্তে¡ও ২৩তলা করার বিষয়ে আমাদের আপত্তি ছিলো। কিন্তু এ ভবন পরিচালনা সোসাইটির সভাপতি তাসবিরুল ইসলাম বলেছেন সমস্যা নেই। তার ইচ্ছাতেই এটি নকশার বাইরে ৫তলা বাড়ানো হয়েছিলো।
এদিকে, ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পার হলেও এ বিষয়ে কোনো মামলা দায়ের করা হয়নি। ভবন মালিক ফারুকও রয়েছেন বহাল তবিয়তে। খবর খবর বিডিনিউজ/বাংলানিউজের

এফআর টাওয়ারের
মৃত্যুকে ‘হত্যাকান্ড’
বললেন পূর্তমন্ত্রী

বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকান্ডে মৃত্যুর ঘটনাকে ‘হত্যাকান্ড’ হিসেবে চিহ্নিত করে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলছেন, বহুতল ভবনে অগ্নিকান্ড প্রতিরোধে সুপারিশ যারা বাস্তবায়ন করেনি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে সরকার।
গতকাল শুক্রবার আগুনে পোড়া এফআর টাওয়ার পরিদর্শন শেষে পূর্তমন্ত্রী বলেন, আমার কাছে মনে হয়েছে, শুধু গাফিলতির কারণেই এ দুর্ঘটনা নয়, এটা হত্যাকান্ড। তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করব। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তিনি যেই হোননা কেন। অতীতের মত করে নয় কঠিন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। খবর বিডিনিউজের
ঢাকার বনানীর ২২ তলা ওই ভবনে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে আগুন লেগে চারটি তলা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে ২৫ জন নিহত এবং অর্ধ শতাধিক মানুষ আহত হয়।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালযয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বৃহস্পতিবার জানান, অনেকগুলো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় থাকলেও এই ভবনে অগ্নি নির্বাপনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল না। যেটুকু ছিল, সেগুলোও কার্যকর ছিল না বলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের ভাষ্য। কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ের ৩২ নম্বর হোল্ডিংয়ে ফারুক নামে এক ব্যক্তির জমিতে এই বাণিজ্যিক ভবনটি তৈরি করে রূপায়ন গ্রুপ। তবে ভবন নির্মাণে অব্যবস্থাপনা নিয়ে তাদের কারও বক্তব্য তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি। প্রতিটি অগ্নিকান্ডের পর যে বিষয়গুলোর উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়ে আসছে, সেগুলোর অভাব দেখা যায় এফআর টাওয়ারেও।
গণপূর্তমন্ত্রী বলেন, আমরা দেখেছি এফআর টাওয়ার নির্মাণে নকশায় গাফিলতি ছিল। রাজউকের নকশা অনুমোদনে কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না, তা আমরা খতিয়ে দেখব। ১৯৯৬ সালে ১৮তলা ভবন নির্মাণের অনুমোদন নেওয়া হয়েছিল জানিয়ে রেজাউল বলেন, ২০০৫ সালে (রাজউকে) কপি দাখিল করা হয় ভবনটি ২৩ তলা হয়েছে। সেটা নিয়ে সন্দেহ হওয়ার কারণে তদন্ত করা হয়, তদন্তে দেখা যায় যে কপিটা দাখিল করা হয়েছে তার সমর্থনে রাজউকে কোনো রেকর্ড নেই। ফলে তদন্তে রিপোর্টে ধরে নেওয়া হয় পরে যে নকশাটা তারা দাখিল করেছে তা ঠিক নয় এবং মূল অনুমোদিত নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। সেই সময় রাজউকের যিনি চেয়ারম্যান ছিলেন এবং যারা কর্মকর্তা ছিলেন আমরা চেষ্টা করছি তাদের খুঁজে বের করতে। গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি ভবন অনুমোদন প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়মের ব্যত্যয় হয়েছে কি না, হয়ে থাকলে কারা কারা জড়িত সে বিষয়ে প্রতিবেদন দেবে বলে জানান মন্ত্রী। তিনি বলেন, ডেভেলপার, মালিক এমনকি আমাদের সংস্থার যদি কেউ জড়িত থাকে তার সম্পর্কে রিপোর্ট দেবেন, রিপোর্ট দেওয়ার পরপরই আমরা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ- যেই হোন না কেন, যত শক্তিশালী ব্যক্তিই হোন না কেন এই জাতীয় মর্মান্তিক ঘটনা যে নরপিশাচরা টাকার লোভে ঘটায় তাদেরকে সর্বোচ্চ আইনের আওতায় এনে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার দ্রুত তা গ্রহণ করবো।

অগ্নি নিরাপত্তা
গার্মেন্টের আদলে
উদ্যোগ নেওয়ার
পরামর্শ ইইউর

বনানী বহুতল ভবন এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকান্ডে হতাহতের ঘটনায় শোক প্রকাশ করে গার্মেন্টের অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নেওয়া ব্যবস্থাগুলো অন্যান্য ভবনের ক্ষেত্রেও নিশ্চিত করার আহবান জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। গতকাল শুক্রবার ঢাকায় ইউরোপীয় মিশনগুলোর পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কর্মস্থলের নিরাপত্তার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখে এবং বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতের কর্ম পরিবেশের উন্নয়ন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ২০১৩ সাল থেকে ইইউ সরকারের সঙ্গে কাজ করে আসছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন মনে করে বাংলাদেশের অন্যান্য শিল্প খাত এবং আবাসন খাতেও বাংলাদেশ সরকারের একই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ।-খবর বিডিনিউজের
বনানীর ২২ তলা ওই ভবনে বৃহস্পতিবার ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছেন ৭০ জনের বেশি মানুষ। ভবনটি নির্মাণে ইমারত বিধি মানা হয়নি এবং সেখানে অগ্নি নির্বাপণের যথেষ্ট ব্যবস্থা ছিল না বলে সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যদের কথায় উঠে এসেছে। ২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন এবং ২০১৩ সালে সাভারে রানা প্লাজা ধসে সহস্রাধিক কর্মীর মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ এবং শ্রমিকদের স্বল্প মজুরির বিষয়টি নতুন করে সামনে চলে আসে। সে সময় তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের কর্মপরিবেশের উন্নয়ন, অগ্নি ও ভবন নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমিয়ে আনতে ইউরোপীয় ২২৮টি ক্রেতা কোম্পানির সমন্বয়ে গঠিত হয় অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ, যা সংক্ষেপে অ্যাকর্ড হিসেবে পরিচিতি পায়। তেমনি আমেরিকার ক্রেতাদের নিয়ে আরেকটি জোট হয়, তার নাম হয় ‘অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স সেফটি ইনিশিয়েটিভ’, যা অ্যালায়েন্স নামে পরিচিত পায়।
বাংলাদেশে পোশাক কারখানা ভবনের কাঠামো, অগ্নি ও বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিদর্শন ও সংস্কার কাজ তদারক করে ওই দুই জোট। ইউরোপীয় মিশনগুলোর বিবৃতিতে ওই ভবনের নিহতদের জন্য গভীর শোক প্রকাশের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর প্রতি সমবেদনা জানানো হয়েছে। সেই সঙ্গে আহতরা দ্রæত সুস্থ হয়ে উঠবেন বলে আশা প্রকাশ করা হয়েছে।