স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য টাকা খেয়ে খারাপ লোকের নাম কেন্দ্রে যায়?

1

স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন একশ্রেণির মানুষ। এদের মধ্যে সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ, দখলবাজ, মাদক কারবারি কিংবা অনুপ্রবেশকারীও আছেন। যারা দলের সুসময়ে জনপ্রতিনিধি হওয়ার মিশনে নেমেছেন। আর এ মিশন বাস্তবায়ন করতে বছরের পর বছর দায়িত্বশীল নেতাদের পেছনে অর্থকড়ি ব্যয় করছেন। সভা-সমাবেশসহ আনুসাঙ্গিক ব্যয় বহন করে নেতাকে খুশি করছেন। এমন ‘বিতর্কিতকর্মীর’ টাকার মোহে নেতা যখন আনন্দিত হচ্ছেন, তখনই নীরবে পিষ্ট হচ্ছেন দুঃসময়ের ত্যাগী নেতারা।
তৃণমূলের নেতাকর্মীদের এমন হতাশার কথা পৌঁছে গেছে কেন্দ্র পর্যন্ত। তাই আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার অনুপ্রবেশকারীদের ঠেকানোর বার্তা দিয়েছেন। আর এবার মুখ খুলেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
সম্প্রতি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য পাঠানো প্রার্থী তালিকায় যাতে টাকা খেয়ে কোনো বিতর্কিত ও খারাপ লোকের নাম না যায়, সেদিকে নজর দিতে তৃণমূল নেতাদের নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। তবে কেন্দ্রীয় নেতারা বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারাটাই ভালো খবর বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনরা।
ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির উপচার্য প্রফেসর ড. সিকান্দর খান পূর্বদেশকে বলেন, ‘নেতারা যে এটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন সেটাই ভালো খবর। এটা আরো আগে আমলে নিলে ভালো হতো। টাকা খেয়ে নাম পাঠালে খুব একটা উপকার হয়, তা নয়। তবে যাদের নাম পাঠানো হচ্ছে সেখানে যে খারাপ লোক যাচ্ছে, সেটাতো বোঝা গেলো। এখন উপরের নেতাদের এমন বক্তব্যে খারাপ লোকের নাম পাঠাতে চিন্তা করবে তৃণমূলের নেতারা। এক্ষেত্রে ভালো লোকের নাম পাঠালে ভালো লোক জনপ্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ থাকবে।’
সিরাজগঞ্জ আওয়ামী লীগের এক সভায় ভাচুর্য়ালি যুক্ত হয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, নিজের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য নয়, জনগণের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য রাজনীতি করতে হবে। টাকা খেয়ে খারাপ লোকের নাম কেন্দ্রে পাঠাবেন না। অনেকেই ক্ষমতা পেয়ে বেপরোয়া হয়ে যায়, যা মোটেই কাম্য নয়। নেতাকর্মীরা ক্ষমতার অপব্যবহার করবেন না। খারাপ মানুষ দিয়ে রাজনীতি করলে দল নষ্ট হয়ে যাবে। দুঃসময়ে বসন্তের কোকিলরা দলে থাকবে না, ত্যাগীরাই সুখে-দুঃখে দলের পাশে থাকবে। তাই সৎ ও ভালো মানুষদের দলে টানারও নির্দেশ দেন তিনি।
এছাড়া আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল সকালে তার সরকারি বাসভবনে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে নিয়মিত ব্রিফিংকালে আবারও স্মরণ করে দিয়ে বলেন, অনিয়ম করে যারা প্রার্থীদের নাম কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন বা পাঠাবেন তাদের বিরুদ্ধে খোঁজ-খবর নেয়া হচ্ছে। প্রমাণ পাওয়া মাত্রই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তিনি বলেন, কোন বিদ্রোহী প্রার্থীকে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেয়া হবে না এবং এবারও যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হবেন, তাদের ভবিষ্যতে কোন পদ-পদবী ও মনোনয়ন দেয়া হবে না।
জানা যায়, গত উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন। মনোনয়ন পাওয়ার পরও নেতাদের বিরোধীতার কারণেই দলীয় প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন। দলের চেয়ে আত্মীয়তাকেই গুরুত্ব দেন নেতারা। আবার অনেক জায়গায় উপজেলা ও জেলা নেতাদের হস্তক্ষেপে বিতর্কিত প্রার্থীরা মনোনয়ন পেলেও বাদ পড়েছেন ত্যাগী নেতারা। ব্যতিক্রম হিসেবে কেন্দ্রে পাঠানো প্রার্থী তালিকায় বিতর্কিত ব্যক্তির নাম গেলেও মনোনয়ন বোর্ডের সভায় মনোনয়ন পেয়েছেন ত্যাগী নেতারা। এতদিন ধরে ‘মনোনয়ন বাণিজ্য’ নিয়ে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে জমে থাকা বিষয়টি সেতুমন্ত্রীর বক্তব্যে সামনে এসেছে।
কারা টাকা দিয়ে নির্বাচনে মনোনয়ন কেনে? তৃণমূলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের কাছে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে। সাহস করে বলতে চায় না অনেকেই। কয়েকজন মনোনয়ন প্রত্যাশী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শুধু নির্বাচনের সময় নয়, সারাবছর ধরে মনোনয়ন দাতা নেতার অনুকূল্য লাভের জন্য টাকা খরচ করে যেতে হয়। নেতাদের নানা অনুষ্ঠান, এমন কি স্থানীয় দলীয় সভা-সমাবেশের ব্যয়ও বহন করতে হয়। নির্বাচনে মনোনয়নের জন্য বড় অংকতো দিতেই হয়। যারা টাকা দিয়ে মনোনয়ন কিনবে তারাতো নির্বাচিত হয়ে ঐ টাকা তোলার জন্য অপকর্ম করবেই। টাকা দেয়া যেমন প্রমাণ করার সুযোগ নেই, তেমনি খারাপ লোকের সংজ্ঞাও নেই। এখন রাজনীতি, নির্বাচন মনোনয়ন এমনই। দলের সাধারণ সম্পাদকের মন্তব্যে টাকা নেয়া বন্ধ হবে বলে তারা মনে করছেন না, তবে একটা চাপতো তৈরি হবে, সেটাই আশার দিক বলে মনে করছেন তারা। শুধু নির্বাচন নয়, দলীয় পদ পেতেও টাকা দিতে হয়।
টাকার প্রতি দুর্বল এমন অনেক নেতা আগেই পদ-পদবী ভাগিয়ে নিয়ে বসে আছেন। শুধু দলীয় নেতা নয়, অনেক এমপি এখন টাকা ছাড়া কিছুই বুঝেন না। খারাপ লোকগুলো টাকা দিয়ে পদবী ও মনোনয়ন কেনার কারণে প্রতিযোগিতায় টিকতে গিয়ে ত্যাগী নেতাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। আর এ কাজ করতে গিয়ে অনেকেই জায়গা-সম্পত্তি বিক্রি করে নিঃস্ব হচ্ছেন।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমাদের দলের সাধারণ সম্পাদকের মতের সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত। আমরা কোন বিতর্কিত প্রার্থীর নাম পাঠাবো না। গত নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন, নৌকার বিরোধীতা করেছেন- এমন কারো নাম যাবে না। মাদক, সন্ত্রাসী কর্মকাÐ, দখলবাজ, অনুপ্রবেশকারীর অভিযোগ আছে- এমন ব্যক্তিদের নাম পাঠানো হবে না। জনপ্রিয়তা ও ত্যাগের ভিত্তিতেই নাম পাঠাবো। বাকিটুকু কেন্দ্র বিবেচনা করবে।’
চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ আতাউর রহমান পূর্বদেশকে বলেন, ‘বিভিন্ন স্থানে হয়তো টাকা খেয়ে প্রার্থীর নাম পাঠানোর অভিযোগ থেকেই দলের সাধারণ সম্পাদক এমন কথা বলেছেন। কিন্তু আমাদের নেত্রী সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, দুর্নীতি ও মাদকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। সে দিকটা বিবেচনায় নিয়েই আমরা কোনো বিতর্কিত প্রার্থীর নাম পাঠানোর পক্ষে নই। ইউনিয়ন, উপজেলাসহ কেন্দ্রের অধীনস্থ যারা আছেন, সবারই এটি দায়িত্ব হিসেবে নেয়া উচিত।’
লোহাগাড়া আওয়ামী লীগের সভাপতি খোরশেদ আলম চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, ‘টাকা খেয়ে প্রার্থীর নাম কেন্দ্রে পাঠায়, সেটা প্রমাণ করা কঠিন। এমন অপকর্ম অনেকটা গোপনেই হয়। বিতর্কিত মানুষের নাম গেলে সেটা ধারণা করা যায়। অনেকেই বুঝাতে চায়, বন্ধুত্ব কিংবা আত্মীয়তার সূত্রে বিতর্কিত ব্যক্তির নাম পাঠানো হয়েছে। দলীয় মানুষ না হলে আত্মীয়তার সূত্রেও যেন কোন অনুপ্রবেশকারীর নাম পাঠানো না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। আওয়ামী লীগে মানুষ ঢুকিয়ে দিচ্ছে জামায়াত। এখন যদি সতর্ক না হই, তাহলে ওরা সফল হবে। আমাদের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যটা আমলে নেয়ার সময় এসেছে।’
কর্ণফুলী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হায়দার আলী রনি পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমাদেরকে স্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, যাতে খারাপ লোকের নাম পাঠানো না হয়। বিতর্কিত কেউ যাতে জনপ্রতিনিধি হতে না পারেন। আমরা সেদিকে লক্ষ্য রেখেই ইউনিয়ন ও থানা থেকে প্রস্তাব পাঠাবো। আমরা কোনো খারাপ লোকের নাম কেন্দ্রে পাঠাবো না। গতবার আমাদের উপজেলায় ভুল বোঝাবুঝি থেকে কিছুটা জটিলতা হয়েছিল, এবার তা হবে না।’
ফটিকছড়ি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দিন মুহুরী পূর্বদেশকে বলেন, ‘সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে যেন কোন ভুল বোঝাবুঝি না থাকে, সেজন্য সভা করেই প্রার্থীর নামের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। বর্ধিতসভায় সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রার্থীরাই নিজেদের নাম সিরিয়াল করে দিয়েছেন। আমরা তাদের মতামতের ভিত্তিতে নাম জেলাকে দিয়েছি। জেলা নির্দিষ্ট ফরমেটে কেন্দ্রে পাঠিয়েছে। সেখানে কোন বিতর্কিত প্রার্থীর নাম পাঠানো হয়নি। এরপরও কেন্দ্র যদি মনে করে কেউ খারাপ প্রার্থী, তাহলে মনোনয়ন দেয়া না দেয়ার বিষয়টি সেখানেই নির্ধারিত হবে।’