স্টিল মিল ও ইটভাটার লাগাম টানা যাচ্ছে না

73

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল-ক্লিনিক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এক কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে ইটভাটা স্থাপনে আইনগত নিষেধাজ্ঞা আছে। এই নিয়ম লঙ্ঘন করলে কারাদন্ড ও আর্থিক জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রয়েছে। অথচ সাতকানিয়ার কালিয়াইশ ইউনিয়নে জাফর আহমদ চৌধুরী ডিগ্রি কলেজের পাশ ঘেঁষেই গড়ে উঠেছে কমপক্ষে ১৭টি ইটভাটা। ইটভাটার কালো ধোঁয়া ও উড়ন্ত ধূলাকনার মধ্যেই ক্লাস করছেন এ কলেজের শিক্ষার্থীরা। মাঝেমধ্যে জরিমানা করলেও অবৈধ ইটভাটার লাগাম টানতে হিমশিম খাচ্ছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
নগরীর বায়েজিদ এলাকার লোহা প্রস্তুতকারী রি-রোলিং মিলগুলোও কুন্ডলি পাকিয়ে ধোঁয়া ছড়াচ্ছে আকাশে। ইটভাটা ও রি-রোলিং মিলগুলো দূষণ প্রতিরোধে ব্যবহার করছে না উন্নত প্রযুক্তি। নিয়মিত জরিমানা গুনেই ফের পরিবেশ দূষণ করছে জেলার ৩১২ ইটভাটা ও নগরীর চারটি স্টিল মিল।
চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মুক্তাদির হাসান পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমরা যাদের জরিমানা করেছি তাদের ৮০ শতাংশই টাকা দিয়েছে। দশ কর্মদিবসের মধ্যেই জরিমানা প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয়। একইসাথে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের নির্দেশনাও দেয়া হয়। আগে কখনো জরিমানা করি নাই যাদের তাদেরকেই এনফোর্সমেন্টের আওতায় আনা হয়। পরেরবার ইটভাটাগুলো বেশি জরিমানা আদায় অথবা ভেঙে দেয়া হয়। ইটভাটা থেকে জীবিকা নির্বাহকারীদের বিষয় বিবেচনা করে স্থায়ী পদক্ষেপ নেয়ার আগে কিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। জরিমানা আদায় মূলত এমন একটি প্রক্রিয়া।’
পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সংযুক্তা দাশগুপ্ত পূর্বদেশকে বলেন, ‘বায়েজিদ এলাকার রি-রোলিং মিলগুলোকে নিয়মিত জরিমানা করা হয়। প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নির্দেশনা অমান্য করলে আবারো জরিমানা করা হয়।’
জেলা প্রশাসনের হিসাব মতে, চট্টগ্রামে থাকা ৪০৮টি ইটভাটার মধ্যে ৩১২টিই অবৈধ। ইটভাটা গড়তে পরিবেশ আইনে স্পষ্ট ধারণা দেয়া হলেও যততত্র ইটভাটা গড়ে তোলা হয়েছে। এসব ইটভাটায় পোড়ানো হয় বনের কাঠ। সরকার কয়েকদফা উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের নির্দেশ দিলেও তা মানতে নারাজ ইটভাটা মালিকপক্ষ।
সাতকানিয়ার জাফর আহমদ চৌধুরী ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী আব্দুল লতিফ পূর্বদেশকে বলেন, ‘ইটভাটার উত্তাপ ও ধোঁয়া কলেজের পরিবেশকে বিষিয়ে তুলেছে। কলেজের আশপাশে কমপক্ষে ২০টির মতো ইটভাটা আছে। ইটভাটার ধোঁয়ার পাশাপাশি ইট আনা-নেয়ায় ব্যবহৃত ট্রাক থেকেও প্রচুর ধূলাবালি ছড়িয়ে পড়ে। এমন দূষণের মাঝে আমরা নিয়মিত ক্লাস করি।’
চট্টগ্রাম ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুল মালেক পূর্বদেশকে বলেন, ‘সরকার সম্প্রতি একটি আইন পাস করেছে। আইনটি এমনভাবে করেছে কেউ আর ইটভাটা করতে পারবে না। মারাত্মক আইন করেছে। ২০ লাখ টাকা জরিমানা, জেলের বিধান রাখা হয়েছে। এভাবে তো ইটভাটা করা যাবে না। আমরা সরকারের কাছে দাবি রেখেছিলাম, দুই পক্ষকেই বাঁচতে হবে। কিন্তু আমাদের কথা রাখা হয়নি। এখন সরকার জরিমানা করে আমরা জরিমানা দিয়ে ইটভাটা চালাই।’
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি ইটভাটা রাঙ্গুনিয়া ও সাতকানিয়ায়। গত ১৭ ফেব্রæয়ারি সাতকানিয়ার ১৪টি ইটভাটাকে একইদিনে জরিমানা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। পরিবেশগত ছাড়পত্র ও নবায়নবিহীন ইটভাটা পরিচালনা করে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতিসাধনের জন্য এসব প্রতিষ্ঠানকে সাত লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ ধারা ৭এর আলোকে পপুলার ব্রিকস ম্যানুফ্যাকচার, ফোর স্টার ব্রিকস ম্যানুফ্যাকচার, নূর হোসেন ব্রিকস ম্যানুফ্যাকচার, গাউছিয়া ব্রিকস ম্যানুফ্যাকচার, শাহ আকতারিয়া ব্রিকস ম্যানুফ্যাকচার, থ্রি স্টার ব্রিকস, বিসমিল্লাহি ব্রিকস, শাহ আমানত ব্রিকস-১, শাহ আমানত ব্রিকস-২, জিলানী ব্রিকস, মোহাম্মদ আলী তালুকদার ব্রিকস, সেভেন স্টার ব্রিকস, শাহাজালাল ব্রিকস, জেবিএম ব্রিকস ম্যানুফ্যাকচার। প্রত্যেকটিকেই ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়। জরিমানা গুনলেও প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিত দূষণ ছড়াচ্ছে।
চট্টগ্রাম নগরের মধ্যে ১১টি বিলেট ও স্টিল মিল আছে। এরমধ্যে চারটি প্রতিষ্ঠান প্রতিনিয়ত পরিবেশ দূষণ করছে। এগুলো হলো- সিএসএস কর্পোরেশন লিমিটেড, মর্ডান স্টিল মিল লিমিটেড, বেঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও সালেহ স্টিল। এরমধ্যে পরিবেশ দূষণের দায়ে সিএসএস কর্পোরেশন ২০১৫ সালে এক লক্ষ ৪৯ হাজার টাকা, ২০১৬ সালে এক লক্ষ ২১ হাজার টাকা, ২০১৭ সালে ৭৮ হাজার ৯৭৫টাকা জরিমানা গুনে। সালেহ স্টিল ২০১৫ সালে দুই লক্ষ ৪৭ হাজার টাকা, ২০১৬ সালে এক লক্ষ ৬২ হাজার টাকা, ২০১৭ সালের মার্চে তিন লক্ষ ৬০ হাজার টাকা ও আগস্টে তিন লক্ষ ৭১ হাজার টাকা জরিমানা গুনে। বেঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ২০১৫ সালে ৬৫ হাজার টাকা, ২০১৭ সালে ফেব্রæয়ারি মাসে ৪১ হাজার টাকা, আগস্ট মাসে এক লক্ষ দুই হাজার ৭৫০টাকা ও ২০১৮ সালে এক লক্ষ টাকা জরিমানা গুনে। মর্ডান স্টিল মিল লিমিটেড ২০১৬ সালে দুই লক্ষ ১৮ হাজার ৮৮টাকা জরিমানা পরিশোধ করে। এ চারটি প্রতিষ্ঠান থেকে নির্গত হওয়া কালো ধোঁয়ায় বায়েজিদের আকাশ প্রায়সময় কালো থাকে। এতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ আশপাশের পোশাক কারখানার শ্রমিকরাও দূষণে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হন।
বায়েজিদ এলাকার ব্যাংক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম পূর্বদেশকে বলেন, ‘বায়েজিদের আকাশ কালো থাকে স্টিল মিলের ধোঁয়ায়। প্রতিদিন চিমনি দিয়ে বিষাক্ত কালো ধোঁয়া নির্গত হয়। মাঝেমধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর জরিমানা করে এমন সংবাদ পত্রিকায় দেখলেও স্থায়ী বন্ধের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। যে কারণে জরিমানা গুনেও প্রতিনিয়ত পরিবেশ দূষণ করছে স্টিল মিলগুলো।’