স্কুলে দুপুরের খাবার ব্যবস্থা ঝরেপড়া রোধে সহায়ক হবে

44

একটি দেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি পথে এগিয়ে নিতে সর্বাগ্রে প্রয়োজন শিক্ষা। কারণ শিক্ষিত জনগোষ্ঠীই পারে দেশকে মেধা, শ্রম, জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়ে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে। এ কারণেই বিশ্বের উন্নত বহু দেশে শিক্ষাকে গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থাকে অবৈতনিক করা হয়েছে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তির এই যুগে শিক্ষা ছাড়া পরিবর্তিত বিশ্বে টিকে থাকা কষ্টকর। এই বিবেচনায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু’র কন্যা শেখ হাসিনা প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই প্রদান,দেশের প্রায় দুই কোটি শিক্ষার্থীকে শিক্ষা বৃত্তি প্রদানসহ নানা রকম সুযোগ সুবিধা দিচ্ছেন।
শেখ হাসিনার সরকারের নির্বাচনী অঙ্গিকারও ছিল ‘দেশে কেউ নিরক্ষর থাকবেনা,সকলের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে।’ পাশাপাশি যুগের সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষা কারিকুলাম আধুনিকায়ন, নতুন নতুন বিষয় চালু,মাল্টিমিডিয়া ক্লাশ রুম চালু,কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ও এর যথাযথ প্রয়োগ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে কারিগরিশিক্ষার প্রসারে নেয়া হয়েছে নানামুখি কর্মসূচি। এই সরকারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং অত্যন্ত জনপ্রিয় কর্মসূচির মধ্যে প্রাক প্রাথমিক এবং প্রাথমিক স্কুল পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের জন্য দুপুরের খাবার ব্যবস্থা করা। বিগত ৮/৯ বছর ধরে স্কুল পর্যায়ে এই কর্মসূচি চললেও এটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাচ্ছে শিগগিরই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিন্তাপ্রসূত অনন্য উদ্যোগ ‘স্কুল মিল নীতি’ অবশেষে মন্ত্রিসভার অনুমোদন পেলো। এর মধ্যদিয়ে সারাদেশে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের পুষ্টি নিশ্চিত করা এবং শিক্ষার প্রতি আগ্রহী করে তোলার ক্ষেত্রে মহতী এই কর্মসূচি’র অনুমোদন পেলো মন্ত্রী সভায়। এই অনুমোদনের ফলে শিক্ষার্থীদের দুপুরের খাবার সরবরাহে পাকা পোক্ত একটি ব্যবস্থা হলো। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি নীতির খসড়া অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। মূলতঃ এ ধরনের কর্মসূচি স্কুল পর্যায়ে চালুর কারণে শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার হার ক্রমশ হ্রাস পাবে। পাশাপাশি শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়বে-বাস্তবে হচ্ছেও তাই।


এ নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মত হচ্ছে,বাংলাদেশের মতো মধ্যম আয়ের দেশে এ ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন একটি দুরুহ ও দুঃসাধ্য কাজ। তবুও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একক প্রচেষ্টায় গৃহীত এই কর্মসূচি নিঃসন্দেহে সাহসী পদক্ষেপ ও প্রশংসিত। তাদের মতে একটি জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থায় এ ধরনের বিভিন্ন উদ্যোগ দেখা যায়। প্রসঙ্গতঃ সরকারের এই সম্মতির ফলে দেশের ১০৪ উপজেলায় প্রাথমিকের শিশুরা প্রতিদিন স্কুল খোলা অবস্থায় দুপুরে রান্না করা খাবার পাওয়া নিশ্চিত হলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তাঁর কার্যালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘জাতীয় স্কুল মিল নীতি ২০১৯’ এই অনুমোদন পায়। পরে সচিবালয়ে এক ব্রিফিং করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বর্তমানে পরীক্ষামূলকভাবে দেশের কয়েকটি জায়গায় ‘মিড ডে মিল’ চালু হয়েছে। কীভাবে তা সমন্বিতভাবে সারাদেশে শুরু করা যায়- সেজন্যই এ নীতিমালা। নীতিমালায় বলা হয়েছে, প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে এমন ৩ থেকে ১২ বছরের শিশুদের জন্য এই নীতিমালা প্রযোজ্য হবে। তাদের প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় শক্তি চাহিদার ক্যালরির ন্যূনতম ৩০ শতাংশ স্কুল মিল থেকে আসা নিশ্চিত করার বিধানও সংযুক্ত করা হয়েছে নীতিমালায়। জাতীয় খাদ্য গ্রহণ নির্দেশিকা অনুযায়ী দৈনিক প্রয়োজনীয় শক্তির ১০-১৫ শতাংশ প্রোটিন থেকে এবং ১৫-৩০ শতাংশ চর্বি থেকে আসতে হবে। খাদ্য তালিকার বৈচিত্র্য ঠিক রাখতে ১০টি খাদ্যগোষ্ঠীর মধ্যে অন্তত চারটি বেছে নিতে হবে সাপ্তাহিক ভিত্তিতে।
দেশের সকল বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে জাতীয় স্কুল মিল কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার সহকারী উপপরিচালক ও উপজেলা শিক্ষা অফিসার সম্পৃক্ত থাকবেন। এছাড়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে পার্বত্য জেলা পরিষদ এ কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত থাকবে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক গিয়াস উদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমানে তিন উপজেলার স্কুলে রান্না করা খাবার এবং ১০৪টি উপজেলায় বিস্কুট খাওয়ানো হচ্ছে। ওই ১০৪টি উপজেলার মধ্যে ৯৩টিতে সরকার ও ১১টিতে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির অর্থায়নে এ কর্মসূচি চলছে। পরীক্ষামূলক ওই কর্মসূচির মাধ্যমে স্কুলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বেড়েছে। দুপুরে স্কুলে রান্না করা খাবার দিলে উপস্থিতির হার ১১ শতাংশ বাড়ে। আর শুধু বিস্কুট দিলে উপস্থিতি বাড়ে ৬ শতাংশ। “ওইসব এলাকায় শিক্ষার্থীদের ঝরেপড়ার হার ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে এবং শিক্ষার্থীদের শারীরিক অবস্থাও আমরা অনুকূলে দেখতে পেয়েছি। রান্না করা খাবারের এলাকায় রক্ত স্বল্পতা ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ এবং বিস্কুট দেওয়া এলাকায় ৪ দমমিক ৭ শতাংশ কমেছে।
এসব দিক বিবেচনায় নিয়েই মন্ত্রিসভা জাতীয় স্কুল মিল কর্মসূচি নীতি অনুমোদন দেয়া হয়েছে। “একই বিস্কুট বাচ্চারা নিয়মিত খেতে চায় না। খাবারের বৈচিত্র্য বিবেচনায় আমরা বিস্কুট, কলা ও ডিম কমন রাখার চেষ্টা করছি। আর বৃহস্পতিবার অর্ধদিবসে শুধু বিস্কুট রাখা হবে।”শুধু বিস্কুট দিলে প্রতিদিন প্রতি শিক্ষার্থীর জন্য ৯ টাকা হারে বছরে ২ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা লাগবে। পাঁচ দিন রান্না করা খাবার ও এক দিন বিস্কুট দিলে খরচ হবে ৫ হাজার ৫৬০ কোটি ৮০ লাখ টাকা। বিস্কুট এবং ডিম, কলা ও রুটি দিলে ২৫ টাকা হারে খরচ হবে ৭ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা হবে। আমরা সব মডেলেই চালানো হবে। যেখানে যেটা প্রযোজ্য হয় সেখানে তাই করা হবে।” ভবিষ্যতে সব ইউনিয়নে এ কর্মসূচি শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে ‘২০২৩ সালের মধ্যে এই কর্মসূচি সারাদেশ বাস্তবায়ন করা হবে। তবে সরকারের সাথে স্থানীয় কমিউনিটির সম্পৃক্ততা ছাড়া সফল করা যাবে না, কারণ স্কুলগুলোতে রান্নাঘর করতে হবে। এজন্য পিপিপি মডেলে করতে পারলে সফল হবে।’
দেশে বর্তমানে ৬৬ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক কোটি ৪০ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। এর মধ্যে ১৫ হাজার ৩৪৯টি স্কুলের ৩০ লাখ শিক্ষার্থীকে এখন খাওয়ানো হচ্ছে। তাতে ৪৭৪ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। পরীক্ষামূলক এ ববস্থা ২০২০ সাল পর্যন্ত চলবে জানিয়ে গিয়াস উদ্দিন বলেন, “নীতিমালার আলোকে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে সারা দেশে বাস্তবায়ন শুরু হবে। এ কর্মসূচিতে চর, হাওর এলাকাকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। সরকারের পরিকল্পনা আছে, ভবিষ্যতে বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীকে সপ্তাহে পাঁচ দিন রান্না করা খাবার এবং একদিন উচ্চ পুষ্টিমান সম্পন্ন বিস্কুট সরবরাহ করা হবে। এই মহতী উদ্যোগের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে আমাদের পক্ষ থেকে নিরন্তর অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে প্রধানমন্ত্রীর এই মহতী ও সুদূর প্রসারি কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন। তবেই দেশে শিক্ষার হার শত ভাগে উন্নীত করা সম্ভব হবে। একই সাথে দেশ হবে নিরক্ষর মুক্ত,পাশাপাশি দেশ পাবে একটি শিক্ষিত জাতি।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট