সোশ্যাল মিডিয়ার যত কথা

18

আমার পিতা

প্রফসের শায়স্তো খান

আমার পিতা আজিজউললাহ খান। ১৯৩৮ সালে চট্টগ্রাম সরকারি মুসলিম হাই স্কুল হতে ১৯৩৮ সালেকলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এন্ট্রানস পরীক্ষায়(এসএস সি) বিভাগীয় মেধা তালিকায় স্থানসহ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৪২ সালে চট্টগ্রাম কলেজ হতে ইংরেজীতে অনার্সসহ ১ম শ্রেণীতে বি, এ পাশ করেন। প্রথম জীবনে প্রায় ২০ বছর সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে চাকুরি করেন। তিনি চান্দগাঁও গ্রামের হায়দার আলী নাজির বাড়ির আমজাদ আলী খান পেশকারের পুত্র। তিনি চট্টগ্রামের কিংবদন্তি চেয়ারম্যান নুর আহমদ ‘চেয়ারম্যান’এর ভাগ্নে।
তিনি ছিলেন এক অতুলনীয় সহজ-সরল মানুষের বিরল প্রতিকূতি। এমন সহজ-সরল মানুষ আনি জীবনে আর একটা দেখলাম না। আমি যদি কয়েক বার জন্ম নিই, প্রতিবারই তার বড় সন্তান হিসেবে জন্ম নিতে চাই।

বাবা

অঞ্জন নন্দী

তুমি যখন আমার চোখের সামনে দেয়ালের ছবি হয়ে গেলে, তখন সমস্ত পৃথিবীটা আমার কাছে শূন্য মনে হলো। সেই প্রথম আমার মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ানো। আমি তখন নবম শ্রেণির ছাত্র , তারিখ – ৪ অগাস্ট ১৯৭৪। তোমার নিথর দেহকে গ্রামের মাতবররা বাড়িতেও রাখতে না দিয়ে শ্মশানে নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত দিলো, মানুষ মরে গেলে অ’ছুৎ হয়ে যায়! অথচ তুমি তাদের কতো সাহায্য করেছো,তারা তোমার কতো প্রিয় ছিল।
বিকেলে তোমাকে কাঁধে নিয়ে শ্মশানযাত্রা শুরু হলো। খই, বাতাসা আর খুচরো পয়সা ছিটিয়ে সমবেত ধ্বনি উঠল, বলো হরি, হরি বোল….
শ্মশানের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে গড়াই, পাশে শ্মশানকালী মন্দির। বাতাসে শব পোড়া গন্ধ আর কারো কান্নার শব্দ ভেসে বেড়াচ্ছিল।
ঢাকা থেকে মেজদা এলে দাহ হবে তাই সারারাত তোমার পা ছুঁয়ে বসে থাকলাম, একটুও ছাড়তে মন চায় নি, পাছে তুমি হারিয়ে যাও! কিন্তু আমার শোক অন্য কাউকে স্পর্শ করেছে বলে মনে হয়নি, উৎসবের আমেজে শ্মশানবন্ধুরা লুচি, তরকারি, ডাল, দই খেয়ে চলে গেলো।
ভোরবেলায় জামাইবাবু বললেন, ‘এবার ওঠো, একটু হেঁটে আসি।’
মেঠো পথ দিয়ে চলছি, আদিগন্ত সবুজ ধানক্ষেতে বাতাস ঢেউ খেলছে, পাশে ছোট্ট নদী, নাম তার কালীগঙ্গা। আরেকটু এগিয়ে চোখে পরলো এক মাজার, তার দাওয়ায় বসে বৃদ্ধ সাঁইজী একতারা বাজিয়ে গান গেয়ে চলেছেন, ‘ খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায় ‘ তোমার মৃত্যুশোক ছাপিয়ে আমার চোখে নামলো অশ্রুধারা, আমি লালন ফকিরের কবরের পাশে নির্বাক বসে থাকলাম । সেই আমার প্রথম ছেঁউড়ীয়া দর্শন।
তুমি ছিলে অজাতশত্রæ, লোভ ও অহংকারহীন। মন ও মননে আধুনিক, কুসংস্কারহীন কিন্তু ধার্মীক। জাগতিক সম্পদ, অর্থ কোন কিছুই তোমাকে টানেনি কোনদিন, তাই খুলনার ফুলতলার জমি, বাড়ি তুমি ফেলে এসেছো অনায়াসে।
বাবা, সেই ভোরে লালন সাঁই এর মাজারে আমি, আমাকে কবর দিয়ে এসেছি, আমি তোমার মতো হয়ে বাঁচতে চেয়েছি, জানি সবটুকু পারিনি। আমি আমার লোভ, রাগ, ক্রোধ সংবরণ করতে পারিনি, এ আমার ব্যর্থতা। চলে যাবার একঘন্টা আগে, তুমি আমাকে বলেছিলে, জীবনে আর যাই হও, সবার আগে মানুষ হোয়ো। তখন বুঝিনি, এখন জীবনসায়াহ্নে এসে বুঝি, মানুষ হওয়াটা কতো কঠিন!
চোখ বুঁজলেই দেখতে পাই, তুমি আমাকে হাত ধরে নিয়ে চলছো নীলমনিগঞ্জের রেলপথে, বাগেরহাটের দড়াটানা নদীর পাড়ে, ঢাকার ধানমÐি লেকের পথ ধরে… কখনো ছাড়োনি হাত, আজও না। তোমার শরীরের স্পর্শ যেন আমি আজও পাই।
শ্মশানে যন্ত্রচালিতের মতো তোমার মুখাগ্নি করলাম, গড়াই নদীর জলে স্নান করে, ঘড়া ভরা জল চিতায় ঢেলে চলে আসলাম।
তুমিহীন সেই আমার একা চলা শুরু।
বাবা, তুমি ভালো আছো তো ? আর তোমার বুকের ব্যথাটা !
তোমার মিলু।

অমোঘ স্মৃতি

সুলতানা কাজী

স্কুল থেকে ফিরে ফোন পাই; বাবার অসুখ বেড়েছে, যেনো দেখে আসি। রাজিয়া, আমার বাসায় ছোট্ট মিম্বরকে দেখভাল করার জন্য যে নিজের আপনজন ছেড়ে আসে! এতটাই ল²ীমন্ত মেয়ে ছিল, সব কাজ নিজের মতো করেই করতো। বললাম, বাবার জন্য একটু শুঁটকী মাছ আর মরিচভর্তা নিয়ে যাব। যে-ই বলা সেই’ই কাজ! একাই যাওয়ার জন্য প্রস্তত হয়ে, চলে গেলাম বাবাকে দেখতে। গিয়েই দেখলাম, একটু বেশিই ক্লান্ত। ঠিক মতো বসতেও পারছেন না। বাবার চারপাশ ঘিরে সবাই চিন্তিত মোটামুটি। মা’র কথা মতো বাসায় ফোন করে আমার বরকে বাচ্চা, রাজিয়াসহ চলে আসতে বললাম। এতক্ষণে বাবার অবস্থা যে মোটেই ভালো না, তা মা ঠিকই বুঝে গেলেন! সবাইকে আদেশ দিলেন, যেনো সবাই ওযু করে তাসবিহ- তাহলিল, কোরান খতম করি! আমরা আট ভাই, তিনবোন, বোনদের বরসহ সবাই উপস্থিত। এমন একটা ক্ষণ! ভুলার না কোনোদিনও! আমাদের আর্তনাদে পুরো বিল্ডিং এর মানুষ, আশেপাশের মানুষও বাসায় এসে উপস্থিত। বাবা সবার সামনেই দোয়া মুখে চোখ বন্ধ করলেন চিরদিনের জন্য! শেষ হলো একটা বিরাট অধ্যায়ের। একটা পৃথিবী, যে পৃথিবী সারাদিন স্বপ্ন দেখতেন, তাঁর সব ছেলেমেয়ে যেনো মানুষের মতো মানুষ হয় ! জানিনা, আমরা কেমন মানুষ হলাম ! তবে হ্যাঁ, কেউ অমানুষ হইনি আমরা ! গর্ব করার মতো সম্বল এটাই আমাদের।
বাবার চলে যাওয়া, এত বড় শোক ! তার জন্যও যে প্রতিষ্ঠান প্রধান থেকে ছুটি নিতে হয় জানতাম না, সদ্য জয়েন করা নির্বোধ আমি! সাতদিন পর বাড়ি থেকে এসে জয়েনিং এর প্রথম প্রহরে ধাক্কা খেলাম ! স্যারের রুমে ঢুকতেই অনেকটা হুঙ্কার দিয়েই স্যার বললেন, শোকজ না দেওয়া পর্যন্ত যেনো আমি হাজিরা খাতায় সাইন না করি ! চোখের এত পানি কোত্তেকে যে পড়েছে বুঝতেই পারিনি সেদিন ! বারবার শুধু বাবার দেওয়া কথা মনে পড়ছিলো! মারা যাওয়ার তিনদিন আগে চাকরিরত তিন মেয়েকে বলে গেলেন, জীবনে যেনো কোনো কারণে চাকরি না ছাড়ি!! হায়রে, চাকরি ! বাবার দেওয়া কথা মনে করে মুখের ওপর চাকরি না ছেড়ে আজও আমি বহাল একই প্রতিষ্ঠানে ! খুব আক্ষেপ করে বলতেন বাবা, স্কুলে পড়ে থাকার জন্যই কি কলেজ নিবন্ধন পাশ করেছিস ?
আজকে বাবা দিবসে বাবার কথা মনে পড়ার সাথে সাথে একটা কথা সবার কাছে জানাতে চাই, তা হলো….
বাবা, মা, ভাই, বোন নামের এই আপনজনগুলো যখন পৃথিবী থেকে চলে যায়! ছুটি যে নিতে হয়, ছুটি যে লাগে তা প্রতিষ্ঠান প্রধানগণ যেনো ভালো মতো মাথায় রাখেন ! আরে, আপনজন তো, যার যায় তার ! অন্যজন কী করে এর মর্ম বুঝবে ! কেনো এত পানিশমেন্ট? কিসের আবার অগ্রিম ছুটি ! ছুটি তো মৃত্যু সংবাদ শোনার সাথে সাথে কাউন্ট করা উচিত !
একজন দেশপ্রেমিক বীর মুক্তিযোদ্ধা, অফিসিয়ালি আপাদমস্তক সৎ একজন মহান মানুষ কাজী আবদুস সাত্তার হলেন আমার বাবা। আমাদের জন্য প্রতিদিনই বাবা দিবস। বাবার আদর্শিক পথেই আমরা আলো দেখি। বাবাকে আল্লাহ বেহেশ্ত নসিব করুক। আমিন।