সোনা ফলছেই চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে

20

তুষার দেব

বিমানবন্দরে জাতীয় ও শুল্ক গোয়েন্দাদের নজরদারির পাশাপাশি আদালতে বিচারাধীন স্বর্ণ চোরাচালান মামলা নিষ্পত্তির হার বাড়লেও তদন্তে সীমাবদ্ধতার কারণে রোধ করা যাচ্ছে না স্বর্ণের চোরাচালান। এ সংক্রান্ত বিচারে বহনকারীর বিভিন্ন মেয়াদে জেল-জরিমানা হলেও আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোরাকারবারি চক্র তার পরোয়া করছে না। দেশে-বিদেশে অবস্থানরত চোরাচালান চক্রের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিরা বরাবরই বহাল তবিয়তে থাকছেন। স্বর্ণ চোরাচালান মামলার তদন্তে সীমাবদ্ধতা ও শীর্ষ চোরাকারবারিদের বিচারের আওতায় আনতে না পারার কারণেই বিমানবন্দর দিয়ে স্বর্ণ পাচার রোধ করা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্ট আইন-প্রয়োগকারী সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।
শীর্ষ চোরাকারবারিদের আইনের আওতায় আনতে না পারার কারণেই আকাশ কিংবা স্থলপথে স্বর্ণ চোরাচালান রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করেন মহানগর দায়রা আদালতে নিযুক্ত রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুঁলি মো. ফখরুদ্দিন চৌধুরী।
তিনি পূর্বদেশকে বলেন, স্বর্ণ জব্দের প্রায় সবকটি মামলার এজাহার থেকে শুরু করে তদন্ত শেষে দাখিল করা চার্জশিট পর্যন্ত কেবল গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিকেই আসামি কিংবা অভিযুক্ত করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই বিচারের আওতায়ও আসে শুধু চালানের বাহক। বিচার শেষে রায়ে অভিযুক্ত বহনকারীর শাস্তি হলেও শীর্ষ পর্যায়ের চোরাকারবারিরা আড়ালেই থেকে যায়। স্বর্ণ জব্দের মামলা তদন্তে পুলিশ আড়ালে থাকা শীর্ষ চোরকারবারিদের চিহ্নিত করতে পারে না। তাই তারা বিচার প্রক্রিয়ার বাইরেই থেকে যায়। চক্রের মূল কারবারিদের শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে চোরাচালান রোধ করা সম্ভব নয়।
চোরাচালান চক্রের শীর্ষ ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবদুর রউফ পূর্বদেশকে বলেন, স্বর্ণ জব্দের মামলার ক্ষেত্রে দেখা যায়, এগুলো সংগ্রহ করা হয় মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই ও ওমানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে। সংগ্রহের পর তা পাচার প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ হচ্ছে বিভিন্ন দেশের বিমানবন্দর। স্বর্ণ, মাদক ও মুদ্রা পাচারের মত অপরাধগুলো আন্তর্জাতিক চক্রের মাধ্যমে সংঘটিত হয়ে থাকে। চোরাচালানের মূল হোতারা অবস্থান করে সিঙ্গাপুর, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের মত মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে। সেখানে বসেই মূল হোতারা স্বর্ণের চালানের যাত্রা থেকে গন্তব্যস্থল পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করে। দেশের বিমানবন্দরে যারা ধরা পড়ে তারা বাহকমাত্র। এমনকি মূল হোতাকে তারা নিজেরাও চিনে না। ফলে ভিনদেশে অবস্থানকারী শীর্ষ চোরাকারবারিকে চিহ্নিত করা মুশকিল। কোনও কোনও ক্ষেত্রে নাম জানা গেলেও তাদের যথাযথ ঠিকানা পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে, ইন্টারপোল বা আন্তঃদেশীয় টাস্কফোর্সের মাধ্যমে চোরাচালান বা পাচার সংক্রান্ত মামলাগুলো তদন্তের পদক্ষেপ নিলে প্রত্যাশিত সুফল পাওয়া যেতে পারে। এজন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকার উদ্যোগী হলে স্ব-স্ব দেশের পুলিশ সদস্যদের নিয়ে যৌথভাবেও এ ধরনের টাস্কফোর্স গঠন করতে পারে।
মহানগর দায়রা আদালত সূত্রে প্রাপ্ত নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, বিগত ছয় বছরে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে চোরাই স্বর্ণের বার জব্দের ঘটনা যেমন বেড়েছে, তেমনি সর্বশেষ তিন বছরে আদালতে এ সংক্রান্ত মামলার নিষ্পত্তির হারও তুলনামূলকভাবে বেড়েছে। বিগত ২০১৬ সালের মে মাসে পক্ষকালের ব্যবধানে স্বর্ণ চোরাচালানের পৃথক দুটি মামলার রায়ে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত দুই আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন মহানগর দায়রা জজ আদালত। মূলত ওই বছর থেকেই স্বর্ণ চোরাচালান মামলার নিষ্পত্তির হার বাড়তে থাকে। ২০১৬ সালে তৎকালীন মহানগর দায়রা জজ ডজনখানেক স্বর্ণ জব্দের মামলা নিষ্পত্তি করেন। প্রতিটি মামলার রায়েই আসামির জেল-জরিমানা হয়। ২০১৯ সালের ২৮ অক্টোবর মহানগর দায়রা জজ শেখ আশফাকুর রহমান বিমানবন্দরে ১৫টি স্বর্ণের বারসহ আটকের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় শাহাদাত হোসেন (৩১) নামে এক আসামিকে ১৪ বছরের কারাদন্ড দিয়েছেন। দন্ডিত শাহাদাত আনোয়ারার বটতলি নূর পাড়া গ্রামের আব্দুস সবুরের ছেলে। পাশাপশি এক লাখ টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। রায় ঘোষণার সময় আসামি কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন। পরে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। ২০১৭ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি তিনি বিমানবন্দরে আটক হয়েছিলেন। তারও আগে বিমানবন্দরে ২০ কেজি ওজনের ১৪৬ টি স্বর্ণের বারসহ শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার মামলায় মীর শাহনেওয়াজ মোরশেদ নামে এক আসামিকে মামলার ছয় বছর পর বিচার শেষে যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানার আদেশ দেন পঞ্চম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ জান্নাতুল ফেরদাউস চৌধুরী।
পুলিশ ও শুল্ক গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের ইতিহাসে বৃহত্তম স্বর্ণের চালান আটক করা হয় ২০১৪ সালের ২৫ মার্চ। ওই চালানে আটক হওয়া সর্বমোট ৯০২টি স্বর্ণের বারের ওজন ছিল ১০৫ কেজি ২শত’ গ্রাম। যার বাজার মূল্য ৪৫ কোটি ২০ লাখ টাকা। এই স্বর্ণ চোরাচালানের সাথে জড়িত সন্দেহে আটক করা হয় বিমানের ১০ যাত্রীকে। একই মাসে পৃথক আরেকটি চালানে আরও ছয় কেজি স্বর্ণ জব্দ করা হয়। এছাড়াও ২০১৪ সালের পুরো বছর জুড়ে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে সবচেয়ে বেশি অবৈধ স্বর্ণ জব্দ করা হয়। যার পরিমাণ ২৫৪ কেজি। এসময় গ্রেপ্তার করা হয় ২৫ জনকে। তাদের অধিকাংশই বহনকারী। এসব ঘটনায় মামলা হয় ২৪টি। আর ২০১৩ সালে মামলা দায়ের হয় মাত্র আটটি। ২০১৫ সালে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৩২টি চালানে ১০৩ কোটি টাকা মূল্যের প্রায় ২৩০ কেজি স্বর্ণের বার এবং সাড়ে ছয় কেজি স্বর্ণালংকার আটক করে শুল্ক কর্তৃপক্ষ। এসব ঘটনায় আটক করা হয়েছে ৪০ জনকে। এর বাইরে পরিত্যক্ত অবস্থায় জব্দকৃত একশ’ কোটি টাকা মূল্যের আরও অন্তত দুইশ’ কেজি স্বর্ণের বার জিডি মূলে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা করে। ওই বছর স্বর্ণ জব্দের ঘটনায় মোট ৩২ টি মামলা দায়ের করা হয় পতেঙ্গা থানায়। এর মধ্যে অধিকাংশ মামলার তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিট জমা দিয়েছে পুলিশ। কিন্তু একটি মামলার তদন্তেও চিহ্নিত করা যায়নি আড়ালে থাকা শীর্ষ চোরাকারবারিদের। চলতি বছর বিমানবন্দরের পাশাপাশি সড়কপথেও বড় দুটি অবৈধ স্বর্ণের চালান জব্দ করে নগর ও জেলা পুলিশ। বিগত ২০১৯ সালের ৪ মার্চ দুই ঘণ্টার ব্যবধানে নগরীর সিআরবি থেকে সিএমপির ডিবি পুলিশ এবং জেলার জোরারগঞ্জ থানা পুলিশ পৃথক দুটি চালানে সাতশ’ পিস অবৈধ স্বর্ণের বার জব্দ করে। এসব স্বর্ণের বাজারমূল্য ৩১ কোটি টাকা বলে পুলিশ দাবি করে। এ ঘটনায় মোট চারজনকে আটক করা রয়েছে। এর মধ্যে নগরীর সিআরবি এলাকায় একটি প্রাইভেট কারে তল্লাশি চালিয়ে একশ’টি স্বর্ণের বারসহ দু’জন আর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মীরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ সোনাপাহাড় এলাকায় একটি পাজেরো গাড়ি থেকে ছয়শ’টি স্বর্ণের বারসহ দু’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনায় সিএমপির কোতোয়ালি ও জোরারগঞ্জ থানায় পৃথক মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে জোরারগঞ্জ থানায় দায়ের হওয়া মামলায়ও পুলিশ চালানের মূল হোতা চুয়াডাঙ্গার দর্শনা পৌরসভার মোবারকপাড়ার মৃত বাদল খানের ছেলে আলমগীর খান পলাতক দেখিয়েই মোট তিনজনকে আসামি করে গত ৩০ সেপ্টেম্বর আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। স্বর্ণ জব্দের সময় গ্রেপ্তার হওয়া কালু ও রাকিব কারাগারে আটক রয়েছে। এছাড়া স্বর্ণ চোরাচালানের সাথে সরকারি ও বিভিন্ন বেসরকারি বিমান পরিবহন সংস্থার কর্মী থেকে শুরু করে কতিপয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, রাজনৈতিক প্রভাবশালী ও ব্যবসায়ীদের সম্পৃক্ততার তথ্য বিভিন্ন সময়ে তদন্তে উঠে আসে। সর্বশেষ গত ৯ অক্টোবর শাহ আমানত বিমানবন্দরে সিভিল এভিয়েশনের এক নিরাপত্তাকর্মীর কাছ থেকে ছয় কোটি ৬৫ লাখ টাকা মূল্যের নয় কেজি ২৮০ গ্রাম ওজনের ৮০টি স্বর্ণের বার জব্দ করা হয়। বিমানবন্দর সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতায় স্বর্ণ চোরাচালান নিরাপদ হয়ে উঠলেও সে তুলনায় স্বর্ণ জব্দের পরিমাণ খুব বেশি নয়। চোরাচালানে বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট অনেকেই সরাসরি জড়িত- এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের হলেও তাদের পাশাপাশি মূল হোতারাও থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। দেশে-বিদেশে স্বর্ণসহ বিভিন্ন পণ্য চোরাচালানের কারবারে জড়িত কমবেশি ৬০টি চক্র তৎপর রয়েছে বলেও জানা গেছে।